আরবের বাগদাদ হতে আগত এক সাধকের বংশে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর পিতা মরহুম শেখ লুৎফুর রহমান ছিলেন একজন সরল প্রাণ মুসলমান। একজন ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পুরুষ ছিলেন ইরাকের বাগদাদের অধিবাসী। ১৪০০ সালের দিকে হজরত বায়েজীদ বোস্তামী আমাদের দেশের চট্টগ্রামে এসেছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। তাঁর সাথে যে ক’জন শিষ্য ছিলেন তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অষ্টম পূর্ব পুরুষ দরবেশ শেখ আওয়ালও ছিলেন। (ছোটদের বঙ্গবন্ধু, পৃষ্ঠা-১১)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ বংশ মর্যাদার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর চরিত্রেও। তাঁর সেই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম-সাধনার বিবরণের জন্য আলাদা পরিসর প্রয়োজন। এখানে কেবল আমরা স্বাধীনতা উত্তর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সরকার পরিচালনাকালীন সংক্ষিপ্ত সময়ের গৃহীত কয়েকটি ধর্মীয় পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করতে চাই, যেগুলোর সাথে প্রবীণ রাজনীতিবিদ জননেতা মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এবং তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুরব্বী-উপদেষ্টা স্বরূপ। তাঁর সৎ উপদেশ বঙ্গবন্ধু বিনা দ্বিধায় মেনে নিতেন। তাই আমাদের এ আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রসঙ্গও এসে যাবে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় পদক্ষেপগুলোকে তুলে ধরতে হলে মওলানা তর্কবাগীশকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত শাসনামলে যে সব ধর্মীয় (ইসলামী) সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নরূপ:
বঙ্গবন্ধুর উক্তি, ‘আমি মুসলমানের সন্তান মুসলমান।’ তিনি গর্ব করে দেশ সম্পর্কে বলতেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র।’ বঙ্গবন্ধুর এ দু’টি ঘোষণা পর্যালোচনা-মূল্যায়ন করলে তাঁর ইসলামপ্রিয়তা ও মুসলিম উম্মার প্রতি তাঁর দরদি মনোভাব ফুটে উঠে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা কালে বিভিন্ন সমাবেশ-সম্মেলনে এবং বক্তৃতা-ভাষণের সময় তিনি আল্লাহর ওপর ভরসার কথা বার বার উচ্চারণ করতেন। উদাহরণ স্বরূপ তার ‘ইনশাল্লাহ’ উচ্চারণের কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। কোরআনের এই সংক্ষিপ্ত আয়াতটির যথার্থ মর্ম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি এবং তাতে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই তিনি ‘ইনশাল্লাহ’ বার বার বলতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের প্রত্যেক উদ্যোগ, প্রয়াসের সাথে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করাও জরুরি। তিনি তাঁর সংগ্রাম ও কর্মকান্ডের সফলতার জন্য ‘ইনশাল্লাহ’ উচ্চারণ ভুলে যেতেন না। হয়তো এ আয়াতের বরকতেই তাঁর সংগ্রাম, সাধনা সফল হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তণ করে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তখন তাঁর সামনে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির যে সব জটিল সমস্যা দেখা দেয় সেগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল, লাখ লাখ কারাবন্দী সমস্যা, বন্ধ মাদরাসাসমূহ খুলে দেওয়া, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা ইত্যাদি। এতদ্ব্যতীত আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নানা বিশৃঙ্খল অবস্থা, নানা অপরাধ-কর্মকান্ড, মদ্যপান, রেস -এর বাহুল্য সহ আরো নানা প্রকারের সমস্যা। এহেন কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে তিনি পাশে পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ঐতিহাসিক সাধারণ ক্ষমা, বের হয়ে আসতে থাকেন বন্দীগণ, যাদের মধ্যে নানা শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সংখ্যাও ছিল বিপুল। যে সব ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কারাবন্দী ছিলেন তারাও একে একে সবাই মুক্তি লাভ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতাপূর্ণ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর ‘জিকির আজকারে’ মুখরিত কারাগারগুলো হতে মুক্ত হয়ে বের হয়ে আসতে থাকেন কারাবন্দীরা এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর মধ্যে স্বজন হারা লোকদের পেয়ে স্বস্তি ফিরে আসে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি কারাবন্দী পরিবারবর্গের অন্তরের অন্তস্থল হতে আসতে থাকে দোয়ার অব্যাহত ধারা।
বঙ্গবন্ধুর সামনে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দেয় এই যে, তিনি যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তাঁর ডাকে স্বতস্ফূর্ত সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশের সকল প্রকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, সেগুলোর মধ্যে মাদরাসা, মকতব, ফোরকানিয়া মাদরাসা প্রভৃতি সমস্তই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে নবযুগের সূচনা হয়, সে আনন্দ উল্লাসে দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। নতুন সরকার দেশ শাসন আরম্ভ করে এবং বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্বহালের অংশ হিসেবে বন্ধ সকল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে থাকে, কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বুঝতেই পারেন না মাদরাসা মকতবের কপালে কী আছে। সবাই দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন এবং ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক সকলেই নানা সংশয় ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অস্থির সময় কাটাতে থাকেন। আর এ সুযোগে মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণার জন্য একটি কুচক্রি মহল উঠে পড়ে লেগে যায়, তাতে সরকারি মহলেরও কিছু কিছু লোকের সমর্থন ছিল বলে জানা যায়। তখন মাদরাসা শিক্ষা বিলুপ্ত করার পক্ষে বিভিন্ন মহলের প্রচারণা খুবই তুঙ্গে। এটি ছিল মাদরাসা পরিচালক, মাদরাসা শিক্ষাদরদি তথা সমগ্র আলেম সমাজের জন্য দারুণ পীড়াদায়ক এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিশ্চিত ভবিষ্যতে সবাই দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। এমনি এক অবর্ণনীয় অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে প্রত্যাবর্তণ করেন এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তিনি মাদরাসা বন্ধের পাঁয়তারাও উপলব্ধি করেন।
১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর ঢাকা প্রত্যাবর্তণের নবম দিবস। বন্ধ মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার দাবি নিয়ে গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব আলহাজ¦ মওলানা আবদুস সালাম ও কাপাসিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মওলানা ওয়ারেছ আলী তৎকালীন মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যান। তাদের বক্তব্য শুনে তিনি মন্ত্রীকে সঠিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। মন্ত্রী বলেন যে, ‘মাদরাসা শিক্ষা বন্ধের অফিশিয়াল কোন অর্ডার দেওয়া হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকার জরুরি ভিত্তিতে স্কুল, কলেজগুলো খোলার এবং শিক্ষাক্রম চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।’ যুদ্ধের পর মাদরাসাগুলো খোলার ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বলে বঙ্গবন্ধু মওলানা ওয়ারেছ আলী ও মওলানা আবুদস সালামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কেউ কেউ হয়তো ভাবছে বঙ্গবন্ধুর সরকার মাদরাসা শিক্ষার পক্ষে নয়। কিন্তু আমি তো মুসলমানের ছেলে, মাদরাসা শিক্ষা কী বলছেন, আমি স্কুল-কলেজেও কোরআন, হাদীসের শিক্ষাক্রম চালু করব। তবে ইসলাম নিয়ে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে তাদেরকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেবো না।’ অতঃপর তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে ডেকে অবিলম্বে মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার এবং পাকিস্তান আমলে যেভাবে যা পেতো (সরকারি অনুদানসমূহ) সেভাবেই তাদের সকল পাওনা পরিশোধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি অন্যায়ভাবে কোন আলেমের প্রতি যাতে কোন অবিচার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার কথাও বলেন।
বন্ধ মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর এসব বক্তব্য ও নির্দেশের পর আর কোন কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত উক্তির উল্লেখ করা যায়। তিনি মাদরাসা শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘মাদরাসা শিক্ষা থাকবে, তবে বর্তমান অবস্থায় নয়।’ মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এসব উক্তির পর মাদরাসা শিক্ষা বিরোধীরা নিশ্চুপ হয়ে যান, তাঁর জীবদ্দশায় মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে প্রাকশ্যে আর কেউ সাহস করেনি। এভাবে তিনি মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত হতে রক্ষা করেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু তাতে মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে কোন কথা না থাকায় বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় মওলনা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ মাদরাসা শিক্ষা পুনর্জীবিত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এবং সরকারের সহযোগিতায় শিক্ষা কমিশনের একটি ইসলামী শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠিত হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় ‘ইসলামী শিক্ষা সংস্কার সংস্থা’। এই কমিটির চেয়ারম্যান হন মওলানা তর্কবাগীশ এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় মরহুম মওলানা আলাউদ্দীন আল আজহারিকে। এই কমিটর অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. মুহম্মদ ইসহাক, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, আহমদ হোসাইন, আকবর আলী, শামসুল আলম, মওলানা বেলায়েত হোসাইন, মওলানা এম জালাল উদ্দীন ও চট্টগ্রামের মওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এই কমিটি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের একটি খসড়া রূপরেখা প্রণয়ন করেন। অতঃপর মওলানা তর্কবাগীশের একান্ত প্রচেষ্টায় মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের সুপারিশমালা গৃহীত হয়। এভাবে মাদরাসা শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অভিন্ন অঙ্গ রূপে পরিগণিত হয়।
বংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার বহুকাল পূর্ব থেকেই এখানে মদ, জুয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল, পাকিস্তান সরকার বৈধতা দিয়ে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হন তখন তিনি মদ, জুয়া নিষিদ্ধ করেন। এ সম্পর্কে তাঁর উক্তিটি বলে রাখাই যথেষ্ট। তিনি একটি প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনা কালে বলেছিলেন, ‘আপনাদের ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান তো মদ, জুয়া, রেস এর মতো অবৈধ ও ইসলাম বিরোধী কাজকেও আইন করে হালাল করে দিয়েছিলো। দেখবেন, সহসাই আমি এসব বাতিল করে দেবো। আমার ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও কী করে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, বসে বসে শুধু দেখবেন।’ বঙ্গবন্ধু মুখে যা বলতেন তা কাজেও দেখাতেন। তিনি মদ, জুয়া, রেস সত্য সত্যই নিষিদ্ধ করে দেন।
আরেকবার এক মওলানাকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান তো মুখে শুধু ইসলাম ইসলাম করেই গেলো, আর আমার ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে আইন করে আমি মদ, জুয়া, রেস খেলা বন্ধ করে দিলাম। এই রেস খেলে হাজার হাজার গরীব নিঃশেষ হয়ে গেছে। বলেন, কাজটা কি ভালো করলাম না খারাপ করলাম?’
মদ, জুয়া ও রেস এ তিনটি পাপকর্ম নিষিদ্ধ করার কথা বঙ্গবন্ধুর জবানী ওপরে তুলে ধরা হয়েছে। এবার তাঁর জীবনের সর্বশেষ সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপটির কথাও তাঁর মুখে শোনা যাক। তিনি বলেন, ‘শুনেছেন তো বোধ হয়, আমার ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আমি অর্ডিন্যান্স করে অটোনোমাস করে দিয়েছি।’ ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ এ অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা ভুল বোঝাবুঝির নিরসন কল্পে বায়তুল মোকাররম ও ইসলামিক একাডেমিকে একিভ‚ত করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমান বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও মার্কেট যে জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত, বঙ্গবন্ধু নিজে উদ্যোগী হয়ে এ তিন একর সম্পত্তি মসজিদের নামে বরাদ্দ ও বিনা সালামীতে রেজিস্ট্রি করে সরকারের পক্ষে মসজিদের নির্মাণের সরকারি কোন নামে ওয়াকফ করে দেন। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের যে কর্মসূচি পালিত হয়, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলেই তা শুরু হয়েছিল। এমনকি সিরাত মজলিসের ব্যানারে অনুষ্ঠিত ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (সা.) এর প্রথম সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পর আলিয়া মাদরাসা ছিল শিখ সৈন্যদের ঘাঁটি। এখানে তখন নাচ, গান হতো। তবে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সমাবেশ করেছিলেন এই আলিয়া মাদরাসারই মাঠে। সে দিন তিনি বলেছিলেন, ‘যারা বলেছিলেন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম থাকবে না, তারা এসে দেখে যান, এখানে যারা বসে আছেন, এই দাড়িওয়ালা আলেম ওলামা কারো প্রতি কোন অবিচার করা হয়নি, সবাই বহাল তবিয়তেই আছেন। আওয়ামীলীগ ইসলাম বিরোধী নয়। তবে, ইসলামের নামে রাজনীতি বিরোধী।’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমি মুসলমানের সন্তান মুসলমান।’ এতে তিনি ছিলেন গর্বিত। তিনি লোক দেখানো মুসলমানিত্বের ধজাধারী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, রাজনীতির সাথে ধর্মকে মিলানো উচিত নয়, ধর্মের স্বকীয়তার সাথে রাজনীতি খাপ খায়না। তাই তিনি বলতেন, ‘ইসলাম নিয়ে যারা বাণিজ্য করতে চায়, তাদেরকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’
বাস্তব ও ব্যক্তি জীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নামাজি ও রোজদার। তিনি জুমার নামাজ পড়তেন, দুই ঈদের নামাজ পড়তেন, রোজার ফিতরা আদায় করতেন এবং কোরবানী করতেন। এসব ছাড়াও তিনি দান, সদকা-খয়রাত করতেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি রাজনীতি করতেন মানবতার জন্য। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, আর মানবতার সেবা হচ্ছে ইসলামেরই অংশ। মানবাধিকার যেখানে লঙ্ঘিত হয়, তা প্রতিরোধ করাও ইসলামের শিক্ষা। সুতরাং এ দেশের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন, সংগ্রামকে সে দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম বারের মতো ছয় সহ¯্রাধিক বাংলাদেশি মুসলমান পবিত্র হজ¦ পালনের সুযোগ পান। মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে হজ¦ প্রতিনিধি দল প্রেরিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে আরব বিশে^ যে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল, মওলানা তর্কবাগীশ এ সফরের মাধ্যমে তার অবসানের চেষ্টা করেন। মওলানা তর্কবাগীশ তাঁর এ সফর শেষে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে সৃষ্ট ভুল ধারণা ও বিভ্রান্তি দূরীকরণে বাংলাদেশ বেতার হতে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রোতাদের জন্য একটি আরবী অনুষ্ঠান প্রচার করা দরকার। বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং দ্রুত এটি প্রচার করার জন্য বাংলাদেশ বেতার কর্তৃপক্ষকে জরুরি নির্দেশ দেন। ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর রাতে রেডিও’র বহির্বিশ^ কার্যক্রম হতে আরবী অনুষ্ঠান (আধ ঘণ্টার) প্রথম প্রচারিত হয়, যা এখনো চালু আছে।
মরহুম মওলানা মহিউদ্দীন খানের ‘মাসিক মদীনা’ পত্রিকাটি স্বাধীনতার পর বন্ধ হয়ে যায় এবং পত্রিকা অফিসটি অন্যরা দখল করে নেয়। তিনি পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশের জন্য পূর্ব পরিচয়ের জের ধরে তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরের স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু তিনি তাঁর সীমাবদ্ধতা ও অপারগতার কথা জানিয়ে পরামর্শ দেন সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করে বিষয়টির ফয়সালা করতে। মওলানার সাথে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো। এমনকি বঙ্গবন্ধুর পিতা মরহুম শেখ লুৎফুর রহমান ছিলেন ‘মাসিক মদীনা’র একজন নিয়মিত গ্রাহক ও পাঠক। দীর্ঘদিন পবিত্রকা না পেয়ে তিনি অগত্যা মওলানা মুহিউদ্দীন খানকে একটি পত্র লিখেছিলেন। খুঁজে পেয়ে সেই পত্রটি নিয়ে মওলানা মুহিউদ্দীন খান বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতে গিয়ে হাজির হন। ততোদিনে বঙ্গবন্ধুর পিতা ইন্তেকাল করেছেন। চিঠি পড়ে বঙ্গবন্ধুর চোখ গড়িয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। তিনি মওলানা মুহিউদ্দীনকে বলেন, ‘আপনি পত্রিকা প্রকাশের আয়োজন করেন, আমি বলে দেব।’ ব্যক্তি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এভাবে আরো বহু জনকে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
‘বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র’, বলে বঙ্গবন্ধু গর্ববোধ করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বাংলাদেশ ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এর সদস্য হয়েছে। ওআইসি’র সদস্য হওয়ার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বে তথা মধ্যপ্রাচ্যে যে ভুল ধারণা বিরাজ করছিল তারও অবসান ঘটতে থাকে এবং তখনো যে সব দেশ বাংলাদেশকে ক‚টনৈতিক স্বীকৃতি দেয়নি সেগুলোও স্বীকৃতি দানে এগিয়ে আসতে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইসলামী চিন্তাধারা ও ইসলাম প্রিয়তার এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাসের বহু উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। তবে এখানে আমরা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক মরহুম আবুল মনসুর আহমদের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা সমাপ্ত করতে চাই। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু যে হলফনামা বা শপথ বাক্য আওয়ামী সদস্যদের পাঠ করিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ বলেন, হলফনামা একটা ছাপা দলিল। আল্লাহর নামে এই হলফনামায় শুরু হয়েছিল, ‘পরম করুণাময় আল্লাহতাআলার নামে হলফ করিয়া আমি অঙ্গীকার করিতেছি...’ এতে গোটা অনুষ্ঠানের পরিবেশ ধর্মীয় গাম্ভীর্য্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। (রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা: ৬৯৪-৬৯৫)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন