বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমি উভয়ে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করায় অনেকের ধারণা আমাদের দু’জনের মধ্যে বুঝি দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এ ধারণা যে সঠিক নয়, তার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত তিনি ছিলেন এক জোতদার পরিবারের সন্তান। আর আমি ধর্মপ্রাণ কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান। তাছাড়াও ছিল ছাত্র জীবনের মধ্যেকার পার্থক্য। তিনি (বঙ্গবন্ধু) গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে চলে যান কলকাতা। সেখানে ১৯৪৪ সালে প্রথমে ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ এবং পরে ১৯৪৬ সালে বিএ পাশ করেন।
ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময়ই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্কে আসেন এবং তাঁর প্রভাবে ছাত্র লীগ ও মুসলিম লীগের মাধ্যমে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
পক্ষান্তরে আমি ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক সমমানের হাই মাদরাসা পরীক্ষায় বাংলা ও আমাদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মাসিক ১৬ টাকা স্কলারশিপ পেয়ে ঢাকা গভর্নমেট ইসলামিক ইন্টামিডিয়েট কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকায় হোস্টেলে থেকে ১৯৪৭ সালে আইএ পাশ করি এবং উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালে পূর্বতন বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামের দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আমার ছোটকাল থেকেই সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। এর কারণ আমার ধর্মপ্রাণ পিতা আলহাজ মুন্সী হাবিল উদ্দিন অল্পশিক্ষিত হয়েও কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক সুন্নত অল জামাত, সাপ্তাহিক হানাফী প্রভৃতি পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। আমি যখন বাড়িতে থাকতাম তখন রোজ দুপুর বেলা খাওয়ার পর আমার উপর দায়িত্ব পড়ত এসব পত্রিকা আমার পিতাকে পড়ে শোনানোর। পরবর্তীকালে আমি যে সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ি, তার মূলে এসবের প্রভাব থাকতে পারে।
১৯৪৫ সালে আমি ঢাকায় এসে আইএ পাশ করে ১৯৪৭ সালে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, একথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু আমার উচ্চতর শিক্ষার এ প্রচেষ্টার পথে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি হয়। এর একটা ছিল আমার ভাষাআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া। এসময় আমি কথাশিল্পী শাহেদ আলীর প্রভাবে ভাষাআন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি এবং এক পর্যায়ে ১৯৫০ সালে আমার অনার্স পরীক্ষার মাত্র দু’মাস পূর্বে উচ্চশিক্ষার চেষ্টা বাদ দিয়ে ভাষাআন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে যাই। এর ফলে আমার উচ্চশিক্ষার প্রয়াস বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত হয়ে পড়ে। ফলে দীর্ঘ ১১ বছর পর ১৯৬২ সালে আমি সমাজ কল্যাণ বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করি।
এদিকে ১৯৪৮ সালে তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক সৈনিক নামের একটা পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রথম সরকারবিরোধী পত্রিকা। শুধু সরকারবিরোধী পত্রিকা হিসাবেই নয়, এর আরেক পরিচয় ছিল ভাষা আন্দোলনের জনক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের অঘোষিত মুখপত্র হিসাবে। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন কথাশিল্পী শাহেদ আলী। আমি ছিলাম অন্যতম সহকারী সম্পাদক। এভাবে এক দিকে সাংবাদিকতা, অন্যদিকে ভাষাআন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবেই আমার প্রধান পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে শাহেদ আলী অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে বগুড়া চলে গেলে আমি সৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। সাপ্তাহিক সৈনিকে আমরা কাজ করতাম অবৈতনিক হিসাবে। এর পর ১৯৫৮ সালে আমার বিবাহ হওয়ায় পারিবারিক প্রয়োজনে দৈনিক মিল্লাত ও পরে দৈনিক নাজাত পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করি।
এরপর এক পর্যায়ে দৈনিক দেশ এবং দৈনিক পিপল পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করার পর ১৯৮৬ এর ৪ জুন দৈনিক ইনকিলাবে প্রথম দিন থেকেই ফিচার সম্পাদক পদে কর্মরত আছি।
এদিকে বঙ্গবন্ধু কলকাতা যাওয়ার আগেই সংগঠন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি কলকাতা যাওয়ার পর ছাত্রলীগ, মুসলিম লীগ প্রভৃতি সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে দ্রুত সক্রিয় রাজনীতিতে অধিক মাত্রায় জড়িয়ে পড়ে একজন পুরা মাত্রার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। আর আমার প্রধান পরিচিতি হয়ে পড়ে একজন ভাষা সৈনিক ও সাংবাদিক হিসাবে।
বঙ্গবন্ধু কলকাতা থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে না পারলেও তিনি মাঝে মাঝে ১৯৪২-৪৩ সালের দিকে ফরিদপুর আসতেন বলে এ সময়ে তাকে প্রথম দেখার সুযোগ পাই আমি ১৯৪২-৪৩ সালের দিকে। কারণ ঐ সময় ফরিদপুর এলে দরিদ্র অথচ মেধাবী ছাত্রদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্টুডেন্ট হোমে অবশ্যই একবার আসতেন এবং বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাবার কালে আমরা দেখি বা না দেখি, তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে হাত তুলে সালাম দিতে দিতে হেঁটে যেতেন। এটা ছিল তাঁর একটা নিজস্ব অভ্যাস। এই অভ্যাসের মধ্যেই তাঁর পরবর্তীকালে জনপ্রিয় নেতা হবার বীজ লুকিয়ে ছিল।
আমার সাথে এসময় বঙ্গবন্ধু অধিক নিকটবর্তী হওয়ার কোন সুযোগ হয়নি। এ সুযোগ আসে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় আসার পর বিশেষ করে ঐতিহাসিক ভাষাআন্দোলন কালে।
রাজনৈতিক সচেতন মহল সাক্ষ্য দেবেন, দুটি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেসম্পর্কে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই নব গঠিত রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অবাঙ্গালী উর্দুভাষীদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের সুযোগে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালিয়ে দেবার একটা গোপন প্রচেষ্টা শুরু করে দেয়া হয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পোস্ট কার্ড, এনভেলপ, মানিঅর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার থেকে।
অথচ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশের জনসংখ্যার চাইতেও এক পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল বেশি। এবং তাদের সবার মাতৃভাষা ছিল বাংলা। এই পটভূমিতে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে ভাষাআন্দোলনের স্থপতি সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে শুরু হয়ে যায় ঐতিহাসিক ভাষাআন্দোলন। উপরে উল্লেখিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকায় তিন জনের নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাহিত্যক ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ।
এখানে আরেকটি বিষয়ও উল্লেখের দাবি রাখে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও শিক্ষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার প্রতিবাদ জানান বহু তথ্য ও তত্ত¡ সমৃদ্ধ এক নিবন্ধের মাধ্যমে। এ পর্যায়ে আরেকটি বিষয়ও উল্লেখের দাবি রাখে। ভারতীয় কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এক প্রশ্ন রাখেন: ভারত স্বরাজ লাভ করলে তার সাধারণ ভাষা কী হবে? রবীন্দ্রনাথ জবাবে বলেন: হিন্দী। এ বিষয়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য ছিল, বাংলা, উর্দু ও হিন্দী এই তিনটি ভাষারই যোগ্যতা রয়েছে রাষ্ট্রভাষা হবার। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে এই তিনটি ভাষা কার্যকর হওয়ায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষা বিষয়ে বক্তব্যের বাস্তবতাই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যাই হোক আমরা এবার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ফিরে যাচ্ছি। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকায় ভাষা আন্দোলনের স্থপতি প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম তার লিখিত সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তাব তুলে ধরেন এভাবে:
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালতের ভাষা হবে বাংলা
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা
(গ) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি, বাংলা ও উর্দু। সমগ্র ভাষা আন্দোলন এই দাবিসমূহের আলোকেই পরিচালিত হয়।
আগেই বলা হয়েছে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে জন্ম নেয়া ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঐ বছরের (১৯৪৭) ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভাষাআন্দোলন শুরু হয়।
তবে অধ্যাপক আবুল কাসেম শুধু এই পুস্তিকা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের সাথে সাক্ষাৎ ও ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভাষাআন্দোলনে তাদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্য একান্ত চেষ্টা করে যেতে থাকেন।
শুধু তাই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে আলোচনা সভা চালিয়ে যেতে থাকেন। এছাড়া ভাষাআন্দোলনে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালেই ঢাকায় উপস্থিত বিভিন্ন পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ছাত্রনেতা প্রমুখের স্বাক্ষর নিয়ে সরকার সমীপে (স্মারকলিপি) পেশ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলন জোরদার করতে প্রয়াস পান। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার অধ্যাপক নূরুল হক ভুঁইয়াকে কনভেনর করে প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছাত্রদের একাংশ নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। এই ছাত্র লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান। এই ছাত্র লীগ জন্মকাল থেকেই তমদ্দুন মজলিসের সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন দিতে থাকে। ছাত্রলীগ গঠিত হওয়ার পর তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যৌথ সদস্য জনাব শামসুল আলমকে কনভেনর করে দ্বিতীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
এসময় করাচীতে পাকিস্তান পরিষদের এক অধিবেশন চলছিল। করাচীতে সে গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায়ও বক্তৃতা দানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরন্দ্র নাথ দত্ত। এ প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের আহবান জানানো হয়।
এই হরতালের প্রতি রেল কর্মচারীদের সক্রিয় সমর্থন থাকার ফলে ঐ দিন চট্টগ্রাম থেকে কোন ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতেই পারেনি। ঢাকার পরিস্থিতি ছিল আরও কঠিন। ঐদিন ভোর থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার সেক্রেটারিটের সকল গেটে ভাষাআন্দোলনের সমর্থকদের পিকেটিং চলার ফলে বহু সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতেই পারেননি। যারা প্রবেশ করেছিলেন তারাও খুব নিরাপদ বোধ করেননি। কারণ সেসময় সেক্রেটারিয়েটের চার দিকে কোন পাকা দেয়াল ছিল না। ছিল কাঁটা তারের বেড়া। এই কাঁটা তারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সমর্থকদের অনেকে ভেতরে ঢুকে পড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের রুমে প্রবেশ করে তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা না করা হলে তারা পদত্যাগ করবেন, এ ওয়াদা করিয়ে নেন।
এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ পিকেটারদের উপর লাঠিচার্জ করে। অনেক পিকেটারকে গ্রেপ্তারও করে। পিকেটারদের উপর লাঠিচার্জের খবর শহরে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন অধ্যাপক আবুল কাসেম। গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমানসহ বহু ছাত্রনেতা। পুলিশের লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তারের খবর শহরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই সেক্রেটারিয়েটের চারপাশ জনসমুদ্রে পরিণত হয় এবং সারা শহরে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এই অরাজক পরিস্থিতি দেখে প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভয় পেয়ে যান। কারণ কয়েকদিনের মধ্যেই কায়েদে আজমের ঢাকা সফরের কথা। তিনি এসে যদি ঢাকার এই অরাজক অবস্থা দেখতে পান, তার (খাজা নাজিমুদ্দিন) সম্পর্কে তাঁর ভালো ধারণা না থকারই কথা। এই অবস্থায় তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে তাদের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অবস্থা আপাতত শান্ত হয়।
যে নাজিমুদ্দিন চিফ মিনিস্টার থাকাকালে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তিনি ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণায় দেয়ায় বাংলা ভাষার সমর্থকরা একে তার বিশ্বাসঘাতকতা ধরে নেয় এবং এর বিরুদ্ধে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রতিবাদ দিবস ব্যর্থ করে দেবার লক্ষ্যে সরকার ১৪৪ ধারা জারী করে। কিন্তু এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখের তাজা রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তখন বঙ্গবন্ধু জেলে আটক ছিলেন। তিনি সরকারের এসব বাড়াবাড়ির প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করে দেন। ফলে পরিস্থিতির চরম অবনতি শুরু হয় এবং ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন