মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
বলতে দ্বিধা নেই যে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে একটি কঠিন সময় পার করছে। এটা শুরু হয়েছে এক-এগারোর সময় থেকেই। বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাই হামলা-মামলা ও বিভিন্ন অত্যাচার-নির্যাতনে জর্জরিত। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। তাদের অবস্থা খুবই করুণ। সরকারের সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের পরিবার পরিজন আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তাছাড়া গত প্রায় ১০ বছর ধরে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ভয়াবহ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। অনেকে হারিয়েছেন ব্যবসা-বাণিজ্য, অনেকে হারিয়েছেন আয়ের পথ; আবার অনেকে হারিয়েছেন শেষ সম্বলটুকুও। নির্যাতন আর হামলা-মামলায় জর্জরিত নেতাকর্মীরা পরিবার পরিজন নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকের দু-বেলা ভাতও জুটছে না। এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে, জাঁকজমকভাবে প্রতিদিন ইফতার মাহফিল করছেন। তাতে এক ব্যক্তিই ঘুরেফিরে বিভিন্ন ইফতার অনুষ্ঠানে ইফতার খাচ্ছেন। তাতে বিএনপির কী ফায়দা হচ্ছে? এ প্রশ্ন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। তারা মনে করেন, এই অনর্থক ইফতার মাহফিলে যে টাকা খরচ হচ্ছে, তা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পেছনে খরচ করলে তারা ভীষণভাবে উপকৃত হতেন। তাই আমি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে অনুরোধ করছি, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দিকে দৃষ্টি দিন, তাদের পাশে দাঁড়ান; তাদেরকে রক্ষা করুন। নইলে বিএনপির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট, বিএনপি নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা তৃণমূলের পাশে দাঁড়াতেও ব্যর্থ হচ্ছেন, কোথায় রাখবেন এই ব্যর্থতার বেদনা? কোথায় রাখবেন এই ব্যর্থতার গ্লানি? কাজেই সময় থাকতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ান, তাদেরকে সবধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করুন।
একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই বিবৃতি আর ব্রিফিং ছাড়া। আওয়ামী লীগ যেমন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে পারেনি, বিএনপিও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। আসলে একটি রাজনৈতিক দল জনগণের কাছে টিকে থাকে তার রাজনৈতিক স্ট্যান্ড ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। অদ্য পর্যন্ত বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, তার একটিও সঠিক ও বাস্তবধর্মী ছিল বলে জনগণ মনে করে না। বিএনপির নেয়া সিদ্ধান্তগুলো পরোক্ষভাবে সরকারের হাতকেই কোনো না কোনোভাবে শক্তিশালী করেছে। যার জন্য বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কোনো বেরিফিশিয়ারী হয়নি। এটি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী কথা, এটি আজ জনগণের মুখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে। মানুষ প্রকাশ্যেই বলছে, নিজস্ব কোনো চিন্তাধারা ও রাস্তা বিএনপির নেই; সরকারের দেখানো পথেই বিএনপি হাঁটে; সরকারের এজেন্ডাই তারা বাস্তবায়ন করে। প্রশ্ন হলো, এমন অগোছালো ও এলোমেলো রাজনীতি করে বিএনপি কী অর্জন করবে? দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই বা কী? বিএনপির এই সিদ্ধান্তহীন ও হঠকারী রাজনীতির কারণেই সরকার অনায়াসে তার মেয়াদ পার করতে পারবেÑএতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
রাজনীতিতে বিএনপির একমাত্র শক্তি হচ্ছে জনগণ। একের পর এক ভুল রাজনীতির কারণে, জনগণ যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়; তাহলে দলটি টিকে থাকবে কোন ভিত্তির ওপর? এসব আজ যৌক্তিক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে বিএনপির রাজনীতির জন্য। জনগণ বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই কর্মসূচি পালন করতে গেছেন, সেখানেই মানুষের স্রোত উপচে পড়েছে। কেননা জনগণ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়। তাই জনগণ বিএনপির পেছনে ঐক্যবদ্ধ আছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ নেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই একটি চরম বিতর্কিত নির্বাচন করে বর্তমান সরকার অনায়াসে দেশ চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করা এখন অর্থহীন। আওয়ামী লীগ কোনো কিছুই গোপনে করছে না। পথ বাঁকা হলেও তাদের ছকে ও পরিকল্পনায় কোনো গোপনীয়তা নেই। তাদের যাত্রা পথ কিংবা অগ্রযাত্রার নিশানা-ঠিকানা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সংসদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে যে প্রক্রিয়ায় হয়েছে, ভবিষ্যতেও এই ধারা আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে বলেই মনে হয়।
বন্যা কিংবা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেলে পিঁপড়াও একত্রিত হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু এক হতে পারল না বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কয়েক মাস হলো বিএনপির সম্মেলন হয়েছে কিন্তু কমিটির কোনো খবর নেই। বিএনপির কাজ ছিল সংগঠনকে শক্তিশালী করতে দল গোছানো। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে দল গোছানোর কাজ শুরু করলেও, এই কাজের কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নেই। ফলে তৃণমূলে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। আন্দোলনের মাঠে যারা নিস্ক্রিয় ছিল, তারাই এখন আবার চলে এসেছেন লাইম লাইটে। বিএনপির আবার আন্দোলনের প্রয়োজন হলে, তারা আবার চলে যাবেন বেকফুটে; তাদের আর রাজপথসহ কোথাও দেখা যাবে না বলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা মনে করেন। কাজেই এভাবে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল চলতে পারে না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দলটির সুস্পষ্ট স্ট্যান্ড থাকা দরকার, যার মাধ্যমে দলটির কাছ থেকে জনগণ একটি সঠিক ও সময়োপযোগী দিক নির্দেশনা পাবে। কিন্তু এসব যৌক্তিক চিন্তা কি বিএনপির ভেতর কেউ করেন? আমাদের তো তা মনে হয় না। করলে দলটির সিদ্ধান্ত জনগণের বিরুদ্ধে যাওয়ার কথা নয়, জনগণ যেটি চায় নাÑসেটি করা থেকে দলটি অবশ্যই বিরত থাকত।
দেশের জনগণের দাবি একটি সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে আগে হবে এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে। এর জন্য জনগণ রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে; দিয়েছে সম্পদও, জেল-জুলুম-হামলা ও গুম-গ্রেফতার এবং মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত হয়ে অনেকেই ফেরার জীবনযাপন করছেন। বিএনপির কাছে আমাদের প্রশ্ন, জনগণের এই দাবিটি এখন গেল কোথায়? এর উত্তর বিএনপিকে জনগণের কাছে দিতেই হবে। কারণ বিএনপি জনগণের ওপর নির্ভরশীল একটি রাজনৈতিক দল।
পরিশেষে বলতে চাই বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। কোনো নির্বাচনই বিএনপি বর্জন করুকÑএটি আমরা চাই না। কারণ গণতন্ত্রের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো দেশে নির্বাচন হবে এবং সে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলও অংশ নেবে। বিএনপি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা শঙ্কিত, আওয়ামী লীগ তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত। কারণ জনগণের কেড়ে নেয়া ভোটাধিকার তাদের ফেরত দিতেই হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকলে, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে; বিএনপির ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো। কিন্তু পাল্টানো দৃশপটে বিএনপির রাজনীতি কোথায়? সেটিই আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে দলটির জন্য।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধুবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন