শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

আদিগন্ত

জঙ্গিবাদী সহিংসতা প্রতিরোধে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পরিবেশ

প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আহমেদ জামিল
বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার এখনো দাবি করে আসছে যে, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু গুলশান এবং শোলাকিয়ার সন্ত্রাসী ঘটনা দেশে-বিদেশে অনেকের মধ্যে এ ধারণা আরো বদ্ধমূল করেছে যে, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে। এতদিন ধরে মসজিদের ইমাম, হিন্দুপুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্য, এমনকি ব্লগার ও কথিত উন্মুক্তমনাদের হত্যাকা-ের সাথে জেএমবি, আনসারউল্লাহ বাংলাটিম, হুজিসহ বেশ কিছু লেবাসধারী চরমপন্থি গ্রুপকে দায়ী করা হচ্ছিল। গুলশান ও শোলাকিয়া ট্র্যাজেডির পর সরকার এই সংগঠনগুলোকেই দায়ী করে চলেছে।
গত ১ জুলাই রাত ৯টার দিকে মিডিয়ার ভাষ্য মতে, ৮ জনের মতো জঙ্গি গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে (রেস্টুরেন্ট) প্রবেশ করে অবস্থানরত সব দেশি-বিদেশিকে জিম্মি করে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর সকালে সেনাবাহিনী নামানো হয়। সেনা অভিযানে ৫ জঙ্গি নিহত হয় এবং ১৩ জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়। দুই পুলিশ কর্মকর্তা এবং ৫ জঙ্গিসহ মোট ২৮ জন নিহত হয় গুলশানের সন্ত্রাসী ঘটনায়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, জঙ্গিরা ১৭ বিদেশিসহ ৩ বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গুলশান ট্র্যাজেডির ক্ষত না শুকাতেই ৭ দিনের কম সময়ের মধ্যে পবিত্র-ঈদুল ফিতরের দিনে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত শোলাকিয়ার ঈদগাহ ময়দানের কাছে জঙ্গি-পুলিশ সংঘর্ষে ২ পুলিশসহ এক জঙ্গি এবং এক নিরীহ গৃহবধূ নিহত হন। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এ যাবৎকাল জঙ্গিরা বিভিন্ন নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে টার্গেট করে খুন করলেও সরাসরি পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি এবং কোনো পুলিশকেও হত্যা করেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় জড়িত জঙ্গিরা উচ্চ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলেই এমন ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস তারা দেখিয়েছে।
গুলশানে নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন গোয়েন্দা শাখার সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল এবং বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন। অন্যদিকে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় নিহত দুই পুলিশ কনস্টেবল হলেন জহিরুল এবং আনসারুল। এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ৪ পুলিশ হত্যার ঘটনা পুলিশ বাহিনীর মনোবলে চিড় ধরাতে পারে বলে কেউ কেউ শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। যা হোক, গুলশান ও শোলাকিয়া ট্র্যাজেডির পর সিরিয়ায় আইএসের হেডকোয়ার্টার রাকা থেকে এক ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশি তিন আইএস সদস্য বাংলাদেশে আবারো নতুন করে হামলার হুমকি দিয়েছে। অন্যদিকে বেশ কিছু জাতীয় দৈনিকের খবরে প্রকাশ, সাম্প্রতিক সময়ে ৭৭ জন তরুণের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। নিখোঁজের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এদের অনেকেই উগ্রপন্থা বেছে নিয়েছে। আইএস আলকায়দাসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে এরা ভিড়তে পারে।
নিঃসন্দেহে এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের জনজীবন এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি প্রচ- হুমকি সৃষ্টি করেছে। লক্ষ্যণীয় দিক হলো, এ যাবৎকাল মাদরাসায় অধ্যয়নরত তরুণ ও কিশোরদের জঙ্গি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করত মহলবিশেষ। মক্তব-মাদরাসা জঙ্গি তৈরির কারখানা বলে প্রচার করা হতো। কিন্তু গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে নিহত জঙ্গিদের দু-একজন ছাড়া বাদবাকি সবার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড হলো- এরা ঢাকার নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং স্কলাসটিকার ছাত্র। এদের তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এরা আইএসসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং ইসলাম ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
নিহত, পলাতক ও হুমকিদাতা জঙ্গিদের বেশির ভাগ শ্রেণী অবস্থানগত দিক হতে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ধারণা করা যায়, আমাদের সমাজ ও পারিবারিক জীবনে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটেছে এসব তরুণ তার শিকার। হয়তো এদের অনেকেই মা-বাবার ¯েœহ থেকে বঞ্চিত কিংবা মা-বাবার নানা অনৈতিক জীবন-চারণ ও কর্মকা- সম্পর্কে জ্ঞাত। হতাশাগ্রস্ত এসব আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়–য়া তরুণ ইন্টারনেটের মধ্যে মানসিক সান্ত¦না ও মুক্তির পথের সন্ধান করে থাকে। এভাবে আইএসের মতো বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাথে তাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। প্রভাবিত হয়ে একপর্যায়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তাদের দলে ভিড়ে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিনাশে ষড়যন্ত্রকারী দেশি-বিদেশি কুচক্রীমহল এদেরকে বিভ্রান্ত করে চক্রান্তের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
সরকার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অতীতের মতো সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গি হামলার জন্য বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতকে দুষছেন। তারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের মদদে জেএমবি এসব সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাস্তবে এ ধরনের অভিযোগ যে ভিত্তিহীন সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে এর প্রমাণ মিলেছে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টোটিই দেখা যাচ্ছে। গুলশানে নিহত জঙ্গি মীর সাবিহ মুবাশ্বিরের পিতা ইমতিয়াজ খান বাবুল হলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক। অন্যদিকে সিরিয়ার রাকায় অবস্থানকারী বাংলাদেশে পুনরায় জঙ্গি হামলার হুমকিদাতা তিন তরুণের একজন হলেন কট্টর আওয়ামীপন্থি সচিব সফিউর রহমানের ছেলে তাহমিদ রহমান শাফি। জনাব সফিউর রহমান সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং জনতার মঞ্চের নেতা ছিলেন। সুতরাং এক্ষেত্রে জঙ্গি হামলার সাথে বিএনপি-জামায়াতকে যুক্ত করে অভিযোগ আনাটা কতটা যুক্তিযুক্ত! আর ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান তো সরাসরি বলেই দিয়েছে জঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে।
রাজনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, যে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটলে সরকারের তরফ হতে বিএনপি ও জামায়াতকে কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়া দোষারূপের সুযোগ নিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের শক্তিকে সংহত করে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা করে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। গুলশানের ঘটনার পর ইতালির প্রধানমন্ত্রী অভিযোগের সুরে বলেছেন, বাংলাদেশের বিভাজিত রাজনীতিই জঙ্গিবাদীদের উত্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, গুলশানে জঙ্গিদের হাতে যে ১৭ বিদেশি নিহত হন তাদের ৯ জনই ইতালির নাগরিক। গুলশানের আর্টিজান এবং শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা রুখতে ব্যর্থতার জন্য অনেকেই সরকারকে দায়ী করেছে। এক্ষেত্রে বেশি করে আলোচিত হচ্ছে গুলশানের আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনাটি।
প্রশ্ন উঠেছে, কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত গুলশানে চারস্তর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে জঙ্গিরা কীভাবে নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওই রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতে পারল। এত অস্ত্রশস্ত্রের জোগান তারা কোথা থেকে এবং কার মাধ্যমে পেল। পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবি জঙ্গি মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার পরও সেনাবাহিনীকে এত দেরিতে নামানো হলো কেন। একে অনেকে পিলখানা ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলছেন। হাতে অনেক সময় পাওয়ায় জঙ্গিরা দেশি-বিদেশি এতগুলো মানুষকে হত্যা করার সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তাই নয়, গুলশানের ঘটনার বিষয়ে ইতালি ও জাপান যৌথভাবে তদন্তের প্রস্তাব দিলেও সরকার এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। তবে ভারতের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ভিন্ন। গুলশানে জঙ্গি হামলার সময় বাংলাদেশে প্রেরণের জন্য ভারত তার স্পেশাল ফোর্স প্রস্তুত রেখেছিল বলে জানা যায়।
শোলাকিয়ার ঘটনার পর ভারতের বোমা বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে আসার কথা শোনা গিয়েছিল। শোনা গিয়েছিল ব্লাকক্যাট কমান্ডো বাহিনী নামানোর কথাও। অথচ ভারতের এসব তথাকথিত বাহিনী মুম্বাই ও পাঠানকোটে সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলায় কতটা অসহায়ত্বের পরিচয় দিয়েছিল তা এদেশের অনেকেই জানেন। জঙ্গি দমনে আমাদের সেনাবাহিনীর সাথে পুলিশ ও র‌্যাব যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তা অতীতে বিভিন্ন সময় প্রমাণিত হয়েছে। আরো উল্লেখ্য যে, দেশ-বিদেশের অন্য কোনো মিডিয়া না পারলেও আর্টিজান রেস্তোরাঁর ভিতরের হতাহতের সংখ্যা এবং ঘটনার বিবরণ ভারতের স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল এনডিটিভি তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারল কীভাবে?
আরো উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ইইউর নির্দেশনায় কনফ্লি¬ক্ট আরমানেন্ট রিসার্চ (সিএআর) যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, আইএস বা ইসলামিক স্টেটকে যে ২০টি দেশের কোম্পানি বিস্ফোরক সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে তার মধ্যে ভারতের ৭টি কোম্পানিও রয়েছে। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জায়োনবাদী ইসরাইলের মতো ব্রাহ্মণবাদী ভারতও জঙ্গি আইএসের পৃষ্ঠপোষক। আইএসসহ অন্য জঙ্গিদের দিয়ে নানা সহিংস কর্মকা- করিয়ে ভারত বাংলাদেশকে সিরিয়ার মতো অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে চূড়ান্ত দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে গ্লোবাল টেরোরিজমের ডাটাবেস অনুযায়ী গত বছর বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪৬৫। ২০১২ সালে এ ধরনের ঘটনা ঘটে ১৮টি। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশে গণতন্ত্র না থাকলে, ভোটাধিকার ও মত প্রকাশের সুযোগ না থাকলে এবং মূলধারার বিরোধী দলগুলোকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে জঙ্গিবাদের মতো চরমপন্থি শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এ বাস্তবতার কারণেই জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে বলেও মতামত ব্যক্ত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। পরিস্থিতি সামলাতে না পারলে জাপানের মতো উন্নয়ন সহযোগীরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। বিদেশি বায়াররা বাংলাদেশে আসা বন্ধ করলে পোশাকসহ রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। সুতরাং পরিস্থিতি সামাল দেয়া না গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই বাংলাদেশের সব মানুষের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়রোধ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার হাত থেকে এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আর এ ধরনের জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশে। তাই চলমান সংকট নিরসনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সবার অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদের নতুন করে আরেকটি নির্বাচন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
য় লেখক : কলামিস্ট
লধসরষ২০১৩১২@ষরাব.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন