শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইন মানতে হবে

এম. এ. কাদের | প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০২০, ১২:৩৮ এএম

সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে জাতীয় সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। কোনভাবেই তা থামানো যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু ঘটছে। এসব সড়ক দুর্ঘটনার হতাহতের বেশির ভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। প্রতিদিনই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (এ.আর.আই) গবেষণায় সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বৎসরের মধ্যে। বাকী ১৮ শতাংশ শিশু। যাত্রী কল্যাণ সমিতি’র মতে, চলতি বছরে (জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি) সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১ হাজার ১শত ৮০ জন আহত হয়েছে ২ হাজার ২শত ১০ জন। গত ১ বছরে (২০১৯) সালে ৪ হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ২শত ২৭ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৯শত ৫৩ জন। মানবসৃষ্ট এসমস্ত সড়ক দুর্ঘটনায় কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে, কত কর্মক্ষম পিতা নিহত হওয়ায় অসহায় সন্তানদের লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে ভবিষ্যত অন্ধকার নেমে আসছে, স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়ে শিশু-সন্তানদের নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে, মা-বাবা তার বুকের সন্তানকে হারিয়ে সারা জীবন চোখের পানি ফেলছে, তার ইয়ত্তা নেই। স্বজন হারানো বেদনা যে হারায় কেবল সেই বোঝে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের আতংকে সময় কাটে, তার আপনজন যেন সড়ক দুর্ঘটনায় না পড়ে, নিরাপদে বাড়ি ফেরে। যে কোনো মূল্যে এই বেপরোয়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা দরকার।

মানবসৃষ্ট এই সমস্ত দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো সবারই জানা। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক নির্ধারণ, নেশাগ্রস্ত ও ঘুম অবস্থায় বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালানো, গাড়ি চলন্ত অবস্থায় ফোন ব্যবহার করা, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, সড়কে চলাচল জনগণের জনসচেতনতার অভাব, মহাসড়কের সাথে হাট-বাজার, গাড়ি পার্কিং ও বিভিন্ন মালামাল দিয়ে রাস্তা দখল, যানবাহনের তুলনায় স্বল্প ও সরু রাস্তা, নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী বা মালামাল উঠা-নামা করানো, যেখানে সেখানে গাড়ি অভারটেক করা, মহাসড়কে তিনচাকার নসীমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক, সিএনজি, রিকসা, ভ্যান চলাচল করা, ফিটনেস বিহীনগাড়ি রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেওয়া, সড়কে চাঁদাবাজি, চালক, হেলপার, শ্রমিকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা মালিক কর্তৃক চালকের প্রতি অবমূল্যায়ন ও অতিরিক্ত কাজে চাপ দেওয়া ইত্যাদি সড়ক দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ।

আমাদের দেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা হয় তার বেশির ভাগই চালকের অদক্ষতা ও খামখেয়ালীপনার জন্য হয়ে থাকে। এ আর আই সংস্থা গত ২০ বছরের বিশ্লেষণে বলেছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালানোর কারনে। চালকের অদক্ষতার কারণে টার্নিংয়ে (মোড়) সতর্ক অবস্থা না নেওয়া, দেখে-শুনে গাড়ি ওভারটেক না করা, সড়ক সংলগ্ন হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের সামনে গাড়ির গতি না কমানো। নেশাগ্রস্ত, ঘুম ও ক্লান্ত অবস্থায় ও হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো। একাধারে বিশ্রাম না নিয়ে গাড়ি চালানো। ট্রাফিক আইন না মানা। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ না থাকা, অনেক সময় চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করা। তাছাড়া অনেক বাস-ট্রাক মালিকগণ, অধিক লাভের আশায় ড্রাইভার-হেলপারদের বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ক্লান্ত ও ঘুম অবস্থায় গাড়ি চালাতে বাধ্য করে, যাতে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

আমাদের দেশে এখনও অনেক মানুষই রাস্তা চলাচলের নিয়ম কানুন না জানার কারণে বা শাস্তি না হওয়ার কারণে যেখানে সেখানে রাস্তা পারাপার এবং অন্য মনস্ক হয়ে চলাচলের জন্য সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। প্রতিদিন দুর্ঘটনার কারণে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও তদন্ত সাপেক্ষে এ পর্যন্ত দোষী ব্যক্তিদের তেমন কোনো শাস্তি হয়নি। একারণেও দোষী ব্যক্তিরা পুনরায় বেপরোয়া হয়ে আবার দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।

সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য আমাদেরকে প্রথমেই কমপক্ষে এস.এস.সি ও সমমানের পাশ করা ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের (ড্রাইভিং ইনস্টিটিউট) মাধ্যমে দক্ষ, উপযুক্ত চালক তৈরি করে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। চালকদের মালিক কর্তৃক সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, বিশেষ করে ট্রাক চালকদের ক্ষেত্রে বেতন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে এবং এক টানা ছয় ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনভাবেই মহাসড়কের উপর দিয়ে ভারী যানবাহনের সাথে তিন চাকার যান চলাচল করতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে মহাসড়কের পাশে আলাদা রাস্তা তৈরি করে ছোট ছোট যানবাহন ও তিন চাকার গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এতে করে দেশে শতকরা ৬০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা এমনিতেই কমে যাবে। তাছাড়া চালক নেশাগ্রস্ত হয়ে চোখে ঘুম নিয়ে বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করা অবস্থায় গাড়ি চালালে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মহাসড়কের সাথে কোন অবস্থাতেই হাটবাজার রাখা যাবে না, কারণ এতে করে যানজট সৃষ্টি হয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যায় ও অসুস্থ রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সের দ্রুত চলাচলের বিঘ্ন ঘটিয়ে মৃত্যু হয়ে থাকে। এসমস্ত দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে মানুষের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে সমাধানগুলো বাস্তবায়নে সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য অধিক যানবাহনের তুলনায় সড়ক পথ, রেলপথ একেবারেই কম, এগুলো বৃদ্ধি ও চওড়া করলে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই কমে যাবে। দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ চালক অমনস্ক হয়ে ওভারটেক করা। যদি অভারটেক করতেই হয় তাহলে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এবং নির্দিষ্ট স্থানে করতে হবে। প্রয়োজনে গতি নিয়ন্ত্রক সিল ব্যবহার করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি কোনভাবেই রাস্তায় চলাচল করতে দেওয়া যাবে না। সড়কে বিভিন্ন সংস্থার নামে, মাসোহারা, বিটের টাকা, শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদাবাজি, ফেরিঘাটে চাঁদাবাজি, গাড়ির কাগজপত্র দেখার নামে হয়রানি ও চাঁদাবাজি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। জনগণকে সচেতন করার জন্য পাঠ্যবইয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। সমাজের গরিব লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাঁর পরিবারকে সরকার বা গাড়ি মালিকদের দেখাশুনার ভার গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দলমত নির্বিশেষে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন