মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শেয়ারবাজারে করোনার প্রভাব ও এর যৌক্তিকতা

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২০, ১২:১০ এএম

অনেকের আশঙ্কা ছিল, এবারের বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের হাত ধরেই আসবে। কিšুÍ সব ধারণা উল্টে দিয়েছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। মিল এক একটাই, ভাইরাস ছড়িয়েছে চীন থেকেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বলা হচ্ছে যে, স্বাস্থ্যঝুঁকির চেয়েও করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক বিপদ আরও বেশি। কেননা এর কারণে যত মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ দেউলিয়া হবে। চাকরি হারাবে বহুসংখ্যক মানুষ। ক্ষতির চ‚ড়ান্ত হিসাব করার সময় এখনো আসেনি। কেননা প্রতিদিনই পরিস্থিতির বদল হচ্ছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে সংবাদ সংস্থা বøুমবার্গের বিশেষজ্ঞরা হিসেব করলেন, করোনার জন্য বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হবে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ধনী দেশগুলোর সংস্থা ওইসিডি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দেড় শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। আবার ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স বলেছে, জিডিপি কমবে ১ শতাংশ। আর এখন তা শূন্যে নেমে আসবে কিনা, সেই প্রাক্কলনের কথাও কেউ কেউ বলছেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো ২০২০ সালের বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ। সুতরাং বোঝাই যায় অর্থনীতির মহাবিপদটি কীভাবে আসছে। ফলে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। গত ৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে পতনের হার ৭ শতাংশের ওপরে ওঠে, তখনই লেনদেন স্থগিত কার হয়। ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট পরবর্তী ১২ বছরে এটিই এসঅ্যান্ডপি সূচকের সর্বোচ্চ পতন। বিশ্লেষকরা দিনটাকে নতুন ‘বøাক মানডে’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এদিন লন্ডনের শেয়ার বাজারে লেনদেন শুরু হতে না হতেই প্রধান সূচক এফটিএসই ১০০ সূচকের ৫৩৫ পয়েন্ট বা ৮ শতাংশের বেশি পতন ঘটে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে ফ্রান্স ও জার্মানির প্রধান শেয়ার সূচক ৭ শতাংশ এবং নরওয়ের প্রধান সূচকটি ১২ শতাংশ পড়েছে। ভারতীয় শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকগুলো ৬ শতাংশের বেশি কমেছে, যা এযাবৎকালে দেশটির শেয়ারবাজারের ইতিহাসে একদিনের লেনদেনে বৃহত্তম দরপতন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাকিস্তানের করাচি স্টক এক্সচেঞ্জের (কেএসই) ১০০ সূচকও ৩ শতাংশের বেশি পড়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে জাপানের টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক নিক্কি ২২৫ সূচক ৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার এএসএক্স সূচক ৭ শতাংশের বেশি পতন হয়েছে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, করোনা আক্রান্তের খবরে, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সূচকের ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। ভালো-মন্দ নির্বিশেষে সব শেয়ারের দাম পড়ে গেছে। গত ৮ বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে সূচকের সর্বোচ্চ পতন ঘটে। দিন শেষে ডিএসইএক্স সূচকটি ২৭৯ পয়েন্ট বা সাড়ে ৬ শতাংশ কমে চার হাজারের (৪০০৮) ঘরে নেমে এসেছে। যা ছিল ২০১৩ সালের চালু হওয়া ডিএসইএক্স সূচকটির সর্বোচ্চ পতন। পতন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে ৯৯ শতাংশ শেয়ারের দাম কমায়, একদিনে বাজার মূলধন কমেছে ১৭ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। বাজারের আচরণটা ছিল বিশ্ব বিবেচনায় স্বাভাবিক। মনে হয়, আমাদের বিনিয়োগকারীরা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বিচক্ষণ। তাই তারা বিশ্বের অন্যান্য শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীর সঙ্গে তাল মিলিয়েছে এবং তা এখনও অব্যাহত রেখেছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, এর আগেও বেশ কয়েকদিন ধরে বাজার পতনের ধারায় ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ দিনে ডিএসইএক্স ইন্ডেক্স ৮০৬ পয়েন্ট পড়ে ১৮ মার্চ বুধবার ১৬৮ পয়েন্ট বা সাড়ে ৪ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৬০৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে বিশেষ করে তেল, পর্যটন ও পরিবহন খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরই সবচেয়ে বেশি কমেছে। অপরদিকে আমাদের শেয়ারবাজার পতনের দিন কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই সংশ্লিষ্ট সকল খাতের পতন হয় এবং দাম বাড়ার শীর্ষে ১০টি কোম্পানি খুঁজে পাওয়া যায় না। যা এই মুহূর্তে শেয়ারবাজারের দীর্ঘ ৬৬ বছরের ইতিহাসে লজ্জাজনক অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের প্রায় প্রতিটি দেশ এখন তাদের বাজারের ইতিহাসে সূচকে সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছে। সেখানে করোনার আতঙ্কে ধস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অদক্ষ শেয়ারবাজার গত এক দশক ধরে অর্থাৎ ধসের পরে এখনো মহাসংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

২০১৯ সালের টানা পতনের পর, ২০২০ সালে জানুয়ারি মাসে সূচক যখন গ্রামীণফোন ও বিটিআরসি দ্ব›দ্বকে কেন্দ্র করে ৪ হাজার পয়েন্ট, ঠিক সেই সময় বাজারে তারল্য বাড়াতে গত ১০ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারির মাধ্যমে বিদ্যমান আইন শিথিল করে প্রতিটি বাংকেই ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল করার সুযোগ করে দিয়েছে। ব্যাংক যদি এই তহবিল থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে তাহলে স্বাভাবিকভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকটির নির্ধারিত সীমার বাইরে থাকবে এটি। আমাদের দেশে ৫০টি ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। এদের সবাই ২০০ কোটি টাকা করে এভাবে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিলে নতুন করে ১০ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজারে ঢুকবে এবং বাজারে তারল্য সংকট দূর হবে। এই পদক্ষেপের পরেই বাজার নড়ে চড়ে উঠতে শুরু করে, সূচক ও লেনদেনে তার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়, বিনিয়োগকারীদের মনে আশা সঞ্চার হয়। লেনদেন ছাড়িয়ে যায় হাজার কোটি টাকা। ফলে ডিএসইএক্স সূচকটি ১৭ ফেব্রæয়ারি এছরের সর্বোচ্চ ৪৭৬৮ পয়েন্ট ওঠে। কিন্তু ব্যাংক খাতে নয়-ছয় সুদহার যা ছিল ব্যবসায়ী মহলের সময়ের দাবি এবং বহু আকাক্সিক্ষত। তা শেয়ারবাজারে নতুন করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। তাই ২৪ ফেব্রæয়ারি ব্যাংকের সুদহার কমানোর প্রজ্ঞাপন জারির পর শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দর পতন ঘটে। বলা হয়, সুদহার কমে গেলে ব্যাংকের আয়ও কমে যাবে, এমন আশঙ্কা কাজ করছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। তাই ব্যাংক খাতের শেয়ারে নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা, কিন্তু তারা কি ভেবে দেখেছেন ব্যাংক খাতের এই দুর্দশার পিছনে আসল রহস্য কী? মোটা দাগে বললে অসাধু পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতা, যার ফল এই ঋণ খেলাপি। এত উচ্চ ঋণের সুদহার পৃথিবীর কোথাও কি আছে? এই সুদে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা করা কি সম্ভব? ধারণা করা হয়, ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ কমে যাবে। অথচ শেয়ারবাজারে তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ হলো এই ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের হার। তাই আশা করা যায়, ব্যাংক খাতের নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন হলে কালক্রমে শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট দূর হবে। পাশাপাশি শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে, গতিশীল ও স্থিতিশীল করতে ভালো শেয়ার সরবরাহর বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ৯ ফেব্রæয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৪টি ব্যাংক শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের বাইরে সরকারি আরও ৭টি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ারও ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।

উল্লেখ্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত দায়িত্ব পালনকালে ২৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। নানাভাবে চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসা যায়নি। ভেবে দেখতে হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ারবাজারে নিয়ে এসেও কী লাভ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ভালোভাবে চলছে না। বিশেষ করে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বাজারে নিয়ে আসতে হবে। এমনকি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়ার সময় কত শতাংশ শেয়ারবাজারে ছাড়তে হবে, সে বিষয়ে শর্তারোপ করা যেতে পারে। দেশের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্যক্তি খাত। বিশ্বব্যাংক গ্রæপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০০-এর বেশি পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত বড় শিল্প গ্রæপ আছে। তবে এর মাত্র ১০ শতাংশ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত, যা খুবই হতাশাজনক। এদিকে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিক ভ‚মিকা পালন করতে পারছে না। তারা প্রচুর মানহীন আইপিও অনুমোদন দিয়েছে, যা প্রায় সবগুলোই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই লোকসানে চলে গেছে। অথচ শেয়ারবাজারে আসার আগে ঔ কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা দেখিয়েছে। এ ব্যর্থতা কাদের? লোকসানে পড়া এসব কোম্পানির বিষয় যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া কারসাজির অংশ কিনা তা জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাস হঠাৎ আসা দুর্যোগের মতো। বাংলাদেশে এখনো পরিস্থিতি এত খারাপ হয়নি যে বাজারে এভাবে সব শেয়ারের দাম কমে যাবে। কারণ, আমাদের বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা চলমান রয়েছে। কারখানা, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারও সচল রয়েছে। করোনার উৎপত্তি স্থল চীনের জনজীবনও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তাই আতঙ্কিত হয়ে এভাবে শেয়ার বিক্রির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। বুঝতে হবে এভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে, বাজারে পতন ঘটিয়ে কম দামে শেয়ার কেনা কারসাজির অংশ, যা আমাদের শেয়ারবাজারে সব সময় হয়ে থাকে। সরকারকে এই কারসাজিচক্র খুঁজে বের করতে হবে। তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন