কয়েক বছর ধরে বিশ্ব এক গভীর সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। দিন যত গড়াচ্ছে, সংকট তত ঘনীভূত হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যখন ইউক্রেন পুড়ছে, ঠিক তখন পাল্লা দিয়ে ইউরোপসহ আমেরিকা তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। ওদিকে ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে চলছে প্রচন্ড দাবদাহ। এই দাবদাহ যেন প্রকৃতিরই এক নীরব প্রতিশোধ। বৈশ্বিক উন্নয়নের চাকচিক্যের মোহে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে মানবসভ্যতার এই মেকি উন্নয়ন যে টেকসই হবে না, তা-ই টের পাইয়ে দিচ্ছে এই দাবদাহ। সতর্ক করে জানান দিচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা নয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘এ যেন পুরো মানবজাতির এক সঙ্গে আত্মহুতি দেওয়া।’ নানা বাধা-বিপত্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়াসহ প্রাচ্য ও পাশ্চত্যের দেশগুলোতে উৎপাদন কমছে। ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়ছে, যা বৈশ্বিকে নিয়ে যাচ্ছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। কোনো কোনো দেশে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক সংকট। এমন-ই এক কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বিশেষ করে তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে, শেয়ারবাজারের গতি-প্রকৃতি গভীর পর্যবেক্ষণে আছেন।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরাও। শেয়ারবাজারের ওপর ভরসা একেবারে তলানিতে। তাতো পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারগুলোতে দরপতনের হার গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। লেনদেন হওয়া ৫০টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত এসএন্ডপি সূচক কমেছে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যান্য সূচক-নাসডাক ও ডাও-জোনসের শেয়ারদরও ক্রমাগত পড়ছে। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়েছে তাতে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে সে দিকেই ছুটছে বিনিয়োগকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এশিয়ার দেশগুলোর শেয়ারবাজারেও পতন হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এফটিএসই-২৫০ সূচক এ বছর ২০ শতাংশ পতন হয়েছে। ইউরোপের স্টকস-৬০০ সূচকেরও ১৭ শতাংশ পতন হয়েছে। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের শেয়ারের দরও পড়েছে ১৮ শতাংশ। আর বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের এই দাহের ইতিহাসতো নতুন নয়। এটি এক যুগের একটি নিয়মিত চিত্র। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যখন এই দাহ নেভানোর ভুল পরিকল্পনা গ্রহণসমেত ব্যর্থ চেষ্টা করে, তখন দৈবাৎ সূচকের ঘুরে দাঁড়ানোর বৃথা চেষ্টা দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু বছরান্তে ঘুরেফিরে আগেরকার অবস্থানে। বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের সঙ্গে আমাদের শেয়ারবাজারের বৈশাদৃশ্য কোথায়? বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশে^র অন্যান্য শেয়ারবাজারের সূচক এই ১৫-২০ শতাংশ কমে যাওয়ার আগে ছিল বেশ ভালো অবস্থানে।
অপরদিকে আমাদের শেয়ারবাজার এক যুগ ধরে প্রতি বছরই ২০-২৫ শতাংশ উত্থান-পতনের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। এখানে প্রশ্ন ওঠে, সূচকতো এখন ৬০০০ পয়েন্টের আশপাশে? করোনা মহামারীর শুরুর দিকে সূচক ছিল ৪০০০ পয়েন্টে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই দুই-আড়াই বছরে শেয়ারবাজারে নতুন অনেক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। ফল হিসাবে ক্রমেই বাজার মূলধন বেড়ে সূচকের এই অবস্থান। বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কিছু বছর আগেও ২০১০ সালের মহাধসের পর, ক্রমাগত সূচক কমে এক কাপ চায়ের দামে (পাঁচ টাকা) শেয়ার পাওয়া যেত। বর্তমানে সূচকের এ অবস্থান থেকে শেয়ারদর যে খুব বেশি বেড়েছে ব্যাপারটি তা নয়। এখনো দেখা যায়, ব্যাংক খাতের প্রায় অর্ধেক শেয়ারের দরে (এই ঊচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগে) টং দোকানের এক কাপ চা পাওয়া যায়। অন্যান্য খাতেরও প্রায় একই হাল। এর কারণ হলো, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা বেশিরভাগ সময়েই বিনিয়োগ না করে পর্যবেক্ষণ মুডে থাকে। এই বছর ধরে নিষ্ক্রিয়তাই শেয়ারবাজারে দেখা দেয় দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কোরবানি ঈদের বন্ধের পর সূচক টানা কমেছে। এভাবে টানা পতন বাজারের প্রতি তীব্র অনাস্থারই প্রকাশ। শুধু শেয়ারদরের পতনই নয়, লেনদেনেও দেখা দেয় মন্দাভাব। তবে এটি আমাদের শেয়ারবাজারে নতুন নয়। সূচকের পতনে বরাবরই বিনিয়োগকারীরা বাজারবিমুখ হয়। শেয়ারবাজারের নিজস্ব গতিতে, একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে সাপোর্ট লেভেল তৈরি হওয়ার কথা, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা কখনো হয় না।
অবশেষে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হাই নেটওয়ার্ক ইন্ডিভিজুয়াল বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দারস্থ হয়। বড় বিনিয়োগকারীরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুরোধে নিজেদের মোক্ষম সময়ে বাজার থেকে কম দামে শেয়ার কিনতে থাকেন। ফলে লেনদেন চাঙা হয়, সূচকেও দেখা যায় উল্লম্ফন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে বেড়ায়, বাজার ভালোর দিকে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আবার বাজারমুখী হয়। অবশেষে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে বেশি দরে শেয়ার চাপিয়ে দিয়ে প্রস্থান করে বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আবার তারা পর্যবেক্ষণে থাকে এবং দূরে বসে বাজারের তামাশা দেখেন। এ ঘটনার আবর্তেই চলছে আমাদের শেয়ারবাজার। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। টানা পতনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দিশাহারা। কোনো নীতিমালা বা কৌশলই যখন বাজারে কাজ করছে না, অবশেষে চলমান সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে হাই নেটওয়ার্ক ইন্ডিভিজুয়ালদের বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং শোনা যাচ্ছে, তারা নাকি মার্কেট মেকারের ভূমিকা পালন করবে, যা তারা বরাবরই করে আসছেন। ফলে আজকে শেয়ারবাজারের এই হালচাল। এটি বাজারসংশ্লিষ্ট অনেকে বুঝলেও কেন যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বোঝে না, তা জনসাধারণের বোধগম্য নয়। এরা কি প্রকৃত বিনিয়োগকারী? সূচক যখন আবার ৭০০০ পয়েন্টে উঠবে বা তারা যখন লাভে থাকবে, তখন বাজারের স্থিতিশীলতা উপেক্ষা করে তাদের হাতে থাকা শেয়ার যে বিক্রি করবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে?
যেখানে লাভ হলে বিক্রি করে পর্যবেক্ষণ মুডে থাকাই আমাদের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা একমাত্র সফল ‘বিনিয়োগ কৌশল’ ও ‘বিনিয়োগ আদর্শ’ বলে মনে করে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের কোনো বালাই নেই। নীতি-নৈতিকতা বা মৌলিক বিনিয়োগের কোনো দেখা নেই। এদিকে শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে শেয়ারবাজারে কারসাজিচক্রের শাস্তি চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এখানেও বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা বেড়েছে। পাছে শেয়ারের দর আরও কমে যেতে পারে, এই ভয়ে চলছে হাতে থাকা শেয়ার বিক্রির মহোৎসব। কিন্তু এমন হওয়ার কথা নয়। এটি তো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী তথা শেয়ারবাজারের জন্য ভালো খবর। এবারের বাজার পতনে যে কারণগুলোর কথা জানা যায়-এর মধ্যে লোডশেডিং, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও সর্বোপরি বৈশ্বিক অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অশনিসংকেত। ভেবে দেখার বিষয় হচ্ছে, আমরা যে রিজার্ভের কথা বলি, তা কিন্তু এই করোনার মধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আর লোডশেডিং সেটিও কিন্তু এ রিজার্ভের কথা চিন্তা করে জ¦ালানির আমদানি খরচ কমানোর পরিকল্পনা। সত্যিকার অর্থে, আমাদের শেয়ারবাজার কখনো আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির সহযাত্রী ছিল না। তাই তো এক যুগ ধরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক যে এত উন্নয়ন, এর মধ্যে শেয়ারবাজারের দৈন্যদশা।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে অর্থনীতির এই নিয়ামকগুলো বিবেচনা করা আবশ্যক। তবে এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন, বিনিয়োগকারীরা যে শেয়ারে বিনিয়োগ করবে সেটি বিনিয়োগযোগ্য কি না তা বিশ্লেষণ। পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে সেই মানের বিনিয়োগকারী গড়ে ওঠেনি। আর এটিও কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রকারান্তরে এক বড় ব্যর্থতা। কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সকাল-সন্ধ্যা বিভিন্ন নীতিমালার পরিবর্তন, বিতর্কিত বড় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়ে রোড শো বা প্রকাশ্যে কারও প্রশংসা করা, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা শেয়ারের চলতি বাজারমূল্যে নাকি ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করা হবে তা নিয়ে এই এক যুগেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য লেগেই আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার বরাবরই একই বুলি- শেয়ারবাজারকে টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে শক্তিশালী করতে হবে, শেয়ারবাজারে কারসাজি করে এখন আর কেউ পার পাবে না, আবার আগামী দিনগুলোতে বাজার খুব ভালো যাবে অর্থাৎ লেনদেন বেড়ে যাবে ও সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে অথবা আমাদের অর্থনৈতিক শক্তিই বাজারকে গতিশীল করবে ইত্যাদি। এই আপ্তবাক্যগুলো বিনিয়োগকারীরা এক যুগ ধরেই শুনে আসছে। কিন্তু এর কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক শেয়ারবাজারে দেখতে পাচ্ছে না। ফলে শেয়ারবাজার এখন আপামর জনসাধারণের কাছে এক জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই মিথ্যা আস্ফালন বিনিয়োগকারীদের কাছে মনে হয়, আজগবি গল্প, যা বোঝা দুরুহ। তাই রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলতে হয়, ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি। তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।’ তাহলে আমাদের শেয়ারবাজারের এই সঙ্কটের সমাধান কী? এর সমাধান বিনিয়োগকারীদের কাছেই। তবে তা খুব সহজ নয়।
যেহেতু আমাদের শেয়ারবাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগনির্ভর। তাই কারও পানে না তাকিয়ে শেয়ারবজারের দীর্ঘ এই বন্ধুর পথ অত্যন্ত ভেবে চিন্তে চলতে হবে। সাহস করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। না হয়, সহসা বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না। এ কথাটিতো সবারই জানা: ‘স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইনস দ্য রেস।’ এর অর্থ ‘যে টিকে থাকে, সে-ই জয়ী হয়।’ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে লোভ পরিহার করে টিকে থাকতে হবে। বিনিয়োগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামষ্টিক অর্থনীতির এই টানাপড়েনের মুহূর্তে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে নিজে কোনো ব্যবসা করার ঝুঁকি না নিতে পারলে, প্রতিষ্ঠিত ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির সঙ্গে থাকা কম ঝুঁকিপূর্ণ। একটু মাথা খাটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যেসব বিনিয়োগকারী পাঁচ-সাত বছর আগে এক কাপ চায়ের পয়সা দিয়ে শেয়ার কিনেছেন, তারা শুধু শেয়ারের লভ্যাংশ দিয়েই টাকা তুলে নিয়েছেন। আসল টাকা তো বিনিয়োগ আকারে রয়েই গেছে। আর মূলধনী লাভ, তা তো হিসাব করলেই পাওয়া যায়। তাই শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগের পাশাপাশি ধৈর্র্য ধারণ করতে হয়। আর ধারাবাহিক বিনিয়োগ, বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যই শেয়ারবাজারে সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
monirulislammi888@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন