বাংলাদেশে এখন অন্যায়, অবিচার, আর অনাচারের বন্যা বয়ে চলছে। মানুষের সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা এখন সম্পূূর্ণরূপে তিরোহিত। ক্ষমতাসীন জবরদখলকারীরা জনগণের ওপর চালাচ্ছে সীমাহীন জুলুম, জনগণকে শ্বাসরুদ্ধ করতে তাদের সব অধিকার কেড়ে নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১১ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে এমনসব ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে, ইতিহাসে যার নজির নেই। সরকার মিথ্যাচার করে জনগণকে অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে। পরিবর্তনের স্লােগান নিয়ে ক্ষমতায় এসে তারা শুধু নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। গত ১১ বছরে বিরোধী দল ও বিরোধী মতের দমন, দুষ্টের লালন, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গগুলি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, দখল, হামলা-মামলা, দলীয়করণ, মিডিয়া দলনের বিরল নজির সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। জিনিসপত্রের দাম কমানোর অঙ্গীকার থাকলেও লাগামহীনভাবে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। দশ টাকা কেজি চাল, বিনামূল্যে সার, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি স্বপ্নই রয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতি ও লুটপাট এমন পর্যায়ে গেছে যে, সেটা এখন আর দেশের মানুষ এবং বিরোধী দলই শুধু বলছে না, দাতা দেশ এবং বিদেশি সংস্থাগুলোও জোরালোভাবে বলছে। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতায় এ সরকারের আমলেও শেয়ারবাজার লুটপাট করা হয়েছে। এ সরকারের আমলে ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও পাচার হয়েছে।
সরকারি দলের ক্যাডার, বিশেষ করে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য শিক্ষাঙ্গনের গন্ডি পেরিয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। ছাত্রলীগ ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সরকার এবারও ভারতের পদতলে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে। ভারতকে ট্রানজিট প্রদান, তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়া, রামপালে ভারতের স্বার্থে বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি তার উদাহরণ। এ সরকারের আমলে অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে। ছেড়ে দেয়া হয়েছে ফাঁসির আসামিদেরও। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মী দিয়ে জেলখানা ভরে ফেলা হয়েছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের প্রায় আট হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে ওইসব মামলা থেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রায় এক লাখেরও বেশি আসামি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বিপরীতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে।
দেশে দুর্নীতি যেন ক্রমেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে চলেছে। সরকারের এমন কোনো খাত নেই, যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। সম্প্রতি সড়ক খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আর যাঁরা এসব কাজ মনিটর ও দুর্নীতি রোধ করার দায়িত্বে আছেন, তাঁরা নিজেরাই ক্রমে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে দুর্নীতির তদন্ত নিয়েও ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছে। অভিযোগ আছে, তদন্তের নামে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়ারই চেষ্টা চলছে। তাহলে এ সর্বগ্রাসী দুর্নীতি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? ওাাষ্ট্রীয় দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় কি চলতেই থাকবে? দুর্নীতিবাজদের কি প্রতিরোধ করা যাবে না? আসলে এসব দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাকে প্রতিরোধ করার জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন ছিল, তা লক্ষ করা যায়নি।
বর্তমান সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলে অনেক হোমরাচোমরার জস হয়েছে। তারা খুবই ক্ষমতাশালী। প্রশাসন তাদের কাছে অসহায়। এই সুযোগে প্রশাসনেও এক শ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। শুরু হয়েছে দুর্নীতির মহোৎসব। উন্নয়নকাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উন্নয়ন কাজের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত। তাই তৃণমূল পর্যায়ের জনগোষ্ঠির কল্যাণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার এখন সময়ের দাবি। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য, বর্তমান সরকার জনগণের কথা না ভেবে দুর্নীতিবাজ দলীয় নেতা-কর্মী তোষণকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে লম্বা লম্বা আশ্বাসের কথ শোনালেও বাস্তবে নিত্য পণ্যের মূল্য সেই যে আকাশের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল তার আর নিচের দিকে নেমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে আরো কয়েক দফায়। পরিণতিতে বাজারে গিয়ে জিহবা বেরিয়ে আসছে সাধারণ মানুষের। এই পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মাঝখানে আবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। বিগত মাসে প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে বেশি হারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মূল্যস্ফীতির বিষয়টি এরই মধ্যে জনমনে প্রবল ভীতি ও আশংকার সৃষ্টি করেছে। একথা সত্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় আহামরি কোনো পরিবর্তন এমনকি সাধারণ মানুষও আশা করেনি। তা সত্তে¡ও ধারণা করা হয়েছিল, যেহেতু ব্যাপকভাবে নিন্দিত-সমালোচিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন সেহেতু ক্ষমতাসীনরা সম্ভবত এবার অন্তত মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন। অন্যদিকে পরিস্থিতি সেই যাহা ৫২ তাহা ৫৩-ই রয়েছে। পণ্যের নাম ধরে ধরে পৃথকভাবে উলেখ করার পরিবর্তে এক কথায় বলা যায়, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি দেখে বলার উপায় নেই যে, সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য কোনো চিন্তা করে। কারণ, কোনো পণ্যের দামই রাতারাতি বাড়েনি। বেড়ে আসছে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। কিন্তু কোনো পর্যায়েই ধমক দেয়ার এবং লম্বা আশ্বাস ও গালগল্প শোনানোর বাইরে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বাস্তবসম্মত ও ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মন্ত্রীরা বড়জোর ধমকের পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং কখনো কখনো ‘কঠোর নজরদারি’ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তারা সেই সাথে সবকিছুর মধ্যে ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করেছেন এবং প্রায় নিয়মিতভাবে ‘অসৎ ব্যবসায়ীদের’ ওপর দোষ চাপিয়েছেন। কিন্তু বলেননি, এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের নিজেদের তথা সরকারের ‘অতি চমৎকার’ সম্পর্কের পেছনে ঠিক কোন বিষয়টি ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে ভ‚মিকা রেখে এসেছে। নাহলে কথিত ‘কঠোর নজরদারি’ তারা কখনো করেননি কেন? শুধু তা-ই নয়, অনেক উপলক্ষেই জানা গেছে, ‘অসৎ ব্যবসায়ীদের’ জন্য মুনাফা লুণ্ঠনের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়েই মাঝে-মধ্যে সরকার এমনকি মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা উল্টো প্রত্যাহারও করেছে। এর সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ীরা আর সে কারণে দাম চলে গেছে মানুষের নাগালের বাইরে।
এভাবে পর্যালোচনায় অনস্বীকার্য হয়ে উঠবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো সফলতাই দেখাতে পারেনি সরকার। সুচিন্তিত ঔদাসীন্যের আড়ালে সরকারের প্রশ্রয় বরং ব্যবসায়ীদের বেপরোয়া করে তুলেছে, যার মাশুল গুনতে গিয়ে সাধারণ মানুষের তো বটেই, নাভিশ্বাস উঠছে এমনকি মধ্যবিত্তদেরও। আমরা মনে করি, অসৎ ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত কঠোরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এবং পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করা।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধা ও রাজনীতিবীদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন