প্রতারণার শিকার ৫ হাজার কর্মী অনাহারে
পালিয়েছে কালো তালিকাভুক্ত ৩৭ দালাল
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে তেল সমৃদ্ধ দেশ ব্রুনাইয়ে প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। দালাল চক্রের হাতে প্রতারণার শিকার প্রায় ৫ হাজার নিরীহ কর্মী অবরুদ্ধ অবস্থায় অনাহার-অনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছেন। করোনাভাইরাস চলাকালে দেশটির সরকারের ঘোষিত দিকনির্দেশনা মেনে চলছে অবরুদ্ধ প্রবাসী কর্মীরা। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের প্রবাসী ব্যবসায়ী কাসেম শেখ তার স্ত্রীসহ পরিবারের ছয় জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ব্রæনাই দারুসসালমস্থ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ব্রæনাই দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তা ড. আবু নাঈম এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দালাল চক্র নামে-বেনামে ব্রæনাইতে কথিত কোম্পানি খুলে অসহায় কর্মীদের ভালো বেতনে কাজ দেয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে চার লাখ টাকার বিনিময়ে দেশটিতে নিয়ে যায়। প্রতারণার শিকার এসব কর্মী কেউ কেউ ৭-৮ মাস কোনো কাজ না পেয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে বিমানের টিকিট কেটে দেশে ফিরছে। ব্রæনাই দারুসসালামস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার দালাল চক্রের অপতৎপরতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ায় দেশটি ইমিগ্রেশন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ৩৭ জন বাংলাদেশি দালালের কালো তালিকা তৈরি করে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এযাবৎ ১৭ জন দালাল চক্রকে গ্রেফতার করে জেল খাটিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বাকি দালাল চক্র ব্রæনাই সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে পালিয়ে এসেছে। কেউ কেউ আবার মালয়েশিয়ায় গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।
দালাল চক্র সেখানে নামে-বেনামে গড়ে তুলছে বিভিন্ন কোম্পানি। এই দালাল চক্রের সদস্যরা মানবপাচার, হুন্ডি ব্যবসা, মাদকসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। এ বিষয়ে বারবার স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছে না বাংলাদেশ দূতাবাস। দালালদের কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ব্রæনাইয়ের সুলতান। পরবর্তীতে হাইকমিশনারের প্রতিশ্রæতিতে ভিসা সচল রাখা হয়।
ব্রæনাইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে হাইকমিশনে অভিযোগ করেন শ্রমিকরা। এরকম অভিযোগের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালে ব্রæনাইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ১৪৫০টি অভিযোগ দাখিল করা হয়। এই অভিযোগকারীদের বেশির ভাগ ভিসা হাইকমিশন থেকে সত্যায়িত না।
২০১৮-২০১৯ সালে দেশ থেকে ৩৪ হাজার কর্মী ব্রæনাই যায়। তাদের মধ্যে বৈধপথে গিয়েছেন মাত্র আট হাজার। অবৈধপথে যাওয়া ২৬ হাজারের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কর্মহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। তাদের অনেকেই রাস্তায় ভিক্ষা করছেন।
গত ২ মার্চ সিআইডি মানবপাচার চক্রের তিন সদস্য গ্রেফতারের পর প্রকাশ পেয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেনÑ দোহারের জয়পাড়া বটিয়ার মো. জিলহকের পুত্র আব্দুর রহিম, মুন্সিগঞ্জ সদরের নান্নু মাতব্বরের পুত্র শাহিন, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির দোরাবাতি গ্রামের আব্দুর রহিম সর্দারের পুত্র ইসমাইল সর্দার। এ বিষয়ে মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় দুই দিনের রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে পাঠিয়েছেন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, মানবপাচারকারী আব্দুর রহিম চক্রের প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার শত শত ব্যক্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ হন ব্রæনাইয়ের সুলতান হাসসান আল বলকিয়াহ। নির্দেশে কিছুদিন আগে আব্দুর রহিমকে গ্রেফতার করে সেখানকার পুলিশ। তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। পরে রহিমসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
দালালদের নির্যাতনের শিকার শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার আবেদ আলী মুন্সিকান্দী গ্রামের আব্দুল মজিদ মুন্সির ছেলে আতিক জানান, প্রতারক আব্দুর রহিম আতিকের কাছ থেকে ৩৪ হাজার ৩০০ ব্রæনাই ডলার ধার নেয়। তার কথিত কোম্পানিতে ৮৩টি জাল ভিসা দিয়ে আরো ২৬ হাজার ২শ’ ব্রæনাই ডলারসহ সর্বমোট ৫৫ লাখ ২০ হাজার ৫শ’ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে নিয়ে গা-ঢাকা দেয়। এ ব্যাপারে সে ব্রæনাইস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে লিখিত অভিযোগ পেশ করেছে। প্রতারক আব্দুর রহিম গ্রেফতার হবার পর তার লোকজন আতিককে নানাভাবে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। দালাল চক্রের সদস্যরা এখনও ব্রæনাইয়ে অবৈধ কর্মকাÐ পরিচালনা করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন একটি অবৈধ কর্মকাÐের বিবরণসহ একটি প্রতিবেদন ব্রæনাইয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে।
সিআইডির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্রæনাইয়ের দালাল চক্রের মূলহোতা মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের পিরোজপুর গ্রামের মেহেদি হাসান বিজন। ২০১৬ সালে গাড়িচালক হিসেবে ব্রæনাই যায় বিজন। মাত্র তিন বছরেই প্রায় ১৫টি কোম্পানির মালিক বনে যান এই গাড়িচালক।
হাইকমিশনের প্রথম সচিব (শ্রম) জিলাল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, ব্রæনাইতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের নিশ্চয়তা, তাদের বেতন, ভাতা, ইন্স্যুরেন্সসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিতের জন্য ২০১৭ সালে ভিসা সত্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু মানবপাচারকারী চক্রটি তা না করে বিএমইটির ভুয়া স্মার্টকার্ড ব্যবহার করে শ্রমিক পাঠাচ্ছে। তাদের কাজ না দিয়ে নির্যাতন করছে। এতে দেশের এই শ্রমবাজারটি হুমকির মুখে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবগত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন