সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

প্রাথমিক শিক্ষাস্তর পরিবর্তনের ঘোষণা ও বাস্তবতা

প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. এম এ সবুর
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এর গুরুত্ব ও শক্তি অপরিমেয়। শিক্ষা বলতে বোঝায় কোনো বিশেষ জ্ঞান, কৌশল ও দক্ষতা অর্জন। ব্যাপক অর্থে শিক্ষার্থীর মাঝে সুপ্ত সকল প্রকার সম্ভাবনা বা প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোর মাধ্যমে সমাজের চাহিদা অনুযায়ী তার আচরণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধন। দৈহিক উন্নতি ও মানসিক প্রশান্তির জন্যও শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যক্তি চেতনা এবং সঠিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করার মাধ্যমে জাতীয় চেতনা ও জাতীয় মতের উদ্ভাবন।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্নে মানুুষের কাছে অন্ন-বস্ত্রের চেয়ে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বেশি অনুভূত হয়েছে। এজন্য ইসলামসহ সেমিটিক সকল ধর্মমতে, মহান আল্লাহ তায়ালা মানব সৃষ্টির শুরুতেই হজরত আদম(আ.)কে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ শিক্ষার গুণেই মানুষ ফেরেস্তাদের থেকে বেশি মর্যাদাবান হয়েছে। শিক্ষা সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার বিবেচনায় নিয়েই আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর, ৬ষ্ঠ থেকে (৮ম শ্রেণি পর্যন্ত নি¤œমাধ্যমিক, নবম ও দশম শ্রেণি মাধ্যমিক এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চ মাধ্যমিক স্তর) দ্বাদশ পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিসমূহকে উচ্চশিক্ষা স্তর হিসেবে গণ্য করা হয়।
তবে ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর করার নির্দেশনা আছে। আর সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর ৫ম শ্রেণির পরিবর্তে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। জাতীয় শিক্ষানীতি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাথমিক স্তর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করার মন্ত্রীর ঘোষণা যথাযথ হলেও বাস্তবতায় ভিন্নতা আছে। কারণ প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাপনার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আমাদের দেশের প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক। অধিকন্তু গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। যা প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর (৮ম শ্রেণি) পর্যন্ত প্রযোজ্য নয়। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় সকল শিক্ষক সরকারি হলেও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত নিযুক্ত বেশিরভাগ শিক্ষকগণ সরকারি নন। আর বর্তমানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়। এসব বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। এজন্য কোথাও কোথাও শিফটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। তাই একযুগে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করাও সম্ভব নয়। এমনকি ভবিষ্যতে স্থানান্তর করার পরিকল্পনাও নেই।
শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর প্রবর্তন করা হলেও শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ বর্তমানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এবং প্রচলিত মাধ্যমিক ও নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণির পাঠদান করা হবে! এতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করবেন এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিযুক্ত শিক্ষকগণ ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণির পাঠদানে নিযুক্ত থাকবেন। এতে প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রম সমন্বয়হীনতার চক্রে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে পঞ্চম শ্রেণির পর সমাপনী পরীক্ষা এবারও হবে কিনা তা নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তি লক্ষ করা গেছে। অধিকন্তু শিক্ষার একই স্তরে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকবৈষম্য ইস্যুতে আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
আমাদের দেশে শিক্ষার স্তর নিয়ে নয় বরং মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, সহজেই সনদ লাভ ও পরীক্ষায় পাশের হার বাড়ানোর প্রবণতা, গাইড বইয়ের ব্যাপকতা, সর্বোপরি শিক্ষকদের দুর্বলতাকে বেশি দায়ী করা চলে। কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান না করে শুধু শিক্ষার স্তর পরিবর্তনের ঘোষণায় শিক্ষার মান আরও অবনতি হতে পারে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, শ্রেণিকক্ষ-অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদি অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষাস্তর পরিবর্তনের ঘোষণা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। এতে শিক্ষাব্যবস্থাপনায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির আশঙ্কা বাড়ছে।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার স্তর পরিবর্তনের আগে শিক্ষার মানন্নোয়ন করতে হবে। এজন্য মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ-প্রশিক্ষণ, বিদ্যালয়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। এ ছাড়া পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাপদ্ধতিরও পরিবর্তন হতে পারে। অধিকন্তু শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ করে ধনী-দরিদ্র সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। আর এসবের জন্য জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকতে হবে। সর্বোপরি প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সনদ লাভের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তবেই শিক্ষাস্তর পরিবর্তন ফলপ্রসূ হতে পারে।
লেখক : আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স
ফসধংড়নঁৎ০৯@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন