শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলায় প্রয়োজন সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য

প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হোসেন মাহমুদ
দুটি ঘটনা। দুটিই অকল্পনীয়, অনাকাক্সিক্ষত, ঘৃণ্য, চরমভাবে নিন্দনীয়। প্রথমটি সংঘটিত হয় গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ১ জুলাই রাতে। ঘটনাটি ঘটে আকস্মিকভাবে। ৫ থেকে ৬ জন সন্ত্রাসী রাত ৯টার দিকে হলি আর্টিজানে প্রবেশ করে। তাদের কাছে অস্ত্র থাকলেও রেস্তোরাঁয় প্রবেশের সময় তারা গুলি করেনি। তারপরই ঘটে নারকীয় ঘটনা। সেখানে ৩ বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীসহ ২০ জনকে গুলি করে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। জানা যায়, হামলাকারীদের মধ্যে ৩ জনকে গুলি করে ও ২ জনকে চাপাতি দিয়ে কোপায় সন্ত্রাসীরা। আর এ কাজটা তারা করে খুব স্বাভাবিক আচরণের মাধ্যমে। খবর পেয়ে প্রথমে পুলিশ এসে অ্যাকশনে গেলে শুরু হয় গোলাগুলি। সন্ত্রাসীরা গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে। তাতে বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন ও গুলশানের গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম নিহত হন, আহত হন গুলশান জোনের এডিসি আহাদসহ ৪০ জন পুলিশ সদস্য। তবে এ সময় সন্ত্রাসীদের কেউই হতাহত হয়নি। এরপর সারারাত অপেক্ষার পর ২ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টায় কমান্ডো বাহিনী থান্ডারবোল্ট নামে অভিযান চালায়। কোনো প্রতিরোধ তথা পাল্টা গুলির সম্মুখীন না হয়েই তারা হলি আর্টিজানের মধ্যে প্রবেশ করে এবং ১৩ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা হয় বলে জানানো হয়। নিহত হয় ৫ জন সন্ত্রাসী। একজন সন্ত্রাসী ও শাওন নামে একজন সন্দেহভাজন আহত অবস্থায় আটক হয়। পরে শাওন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এদিকে ২ জুলাই সকালে কমান্ডো অভিযানে ৫ জন নিহত সন্ত্রাসীর মধ্যে একজন ঐ রেস্তোরাঁর পাচক ছিলেন বলে জানা যায়। অর্থাৎ তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে জানা যায় যে, সন্ত্রাসীরা হলি আর্টিজানে প্রবেশের পরপরই সেখানে ২০ জনকে সম্পূর্ণ ঠা-া মাথায় হত্যা করে।
হলি আর্টিজানের এ হামলার ঘটনা কারো কারো কাছে রহস্যময়তার আবরণে ঢাকা। অনেক কিছুই এখানে স্পষ্ট নয়, অনেক তথ্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়, গৃহীত ব্যবস্থা নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। একজন সন্ত্রাসীর ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়নি। আটক একজন সম্পর্কে এ পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। তারপর সন্ত্রাসীরা কেন পাল্টা লড়াই করল না, যেহেতু তারা কোনো দাবি জানায়নি সে জন্য আরো আগে অভিযান চালানো যেত কিনা, তাদের প্রশিক্ষণ, বিদেশ থেকে আগমন, ঘটনার পর সেখান থেকে আটক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত এখন কোথায় প্রভৃতি নানা বিষয় এখনো পরিষ্কার নয়।
হলি আর্টিজানের ঘটনার আকস্মিকতা ও নৃশংসতায় সারাদেশ যখন স্তম্ভিত তারই মধ্যে ৭ জুলাই পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে ঘটে দ্বিতীয় ভয়ংকর ঘটনা। বাংলাদেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে। ঈদের নামাজের কিছু আগে ঈদগাহ মাঠের এক কিলোমিটার দূরে পুলিশের একটি অবস্থানে কয়েকজন সন্ত্রাসী হামলা চালায়। তারা দু’জন কর্তব্যরত পুলিশকে হত্যা করে। ৬ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। সন্ত্রাসীদের একজনও ঘটনাস্থলে নিহত হয়। আটক হয় ৩ জন। অন্যদিকে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে ঝর্ণা রানি ভৌমিক নামে একজন গৃহবধূ নিহত হন। আহত অবস্থায় আটক হামলাকারী শফিউল চিকিৎসাধীন। অপর আসামী তানিমকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। জানা যায়, সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য ছিল ঈদ জামাতে হামলা। সে ক্ষেত্রে আরো কত প্রাণ যেত, কত রক্ত¯্রােত বইত কে জানে?
এ দুটি হামলার ঘটনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেমন তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বিশ্বব্যাপীও তা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। গুলশানের হামলার সাথে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক সন্ত্রাসী সংস্থা আইএস নিজেদের সংশ্লিষ্টতা দাবি করে। কিন্তু শোলাকিয়ার ঘটনায় কেউ দায় স্বীকার করেনি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এসব হামলায় আইএসের সংশ্লিষ্টতার বিষয় নাকচ করা হয়েছে। আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক পরিষ্কার জানিয়েছেন, এসব হামলা জেএমবির কাজ। তা হামলা যেই করুক না কেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি সন্ত্রাস কবলিত দেশ হিসেবে ইতোমধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া প্রভৃতি দেশের মতই সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু। কারো কারো ধারণা, সন্ত্রাসী হামলা এখানেই শেষ হবে না, এ ধরনের আরো হামলা দেশে ঘটতে পারে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্বের অন্য আরো বহু দেশের মতই বাংলাদেশেও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে হামলা-সংঘর্ষ-খুনের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু এভাবে সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হামলার শিকার হবে, এ রকম আশঙ্কা অনেকেই করেননি। আমরা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর চরমপন্থী সর্বহারা দল এবং জাসদের গণবাহিনী দেশের নানা স্থানে বেপরোয়া হত্যা, থানা লুট, রক্ষী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। এগুলো ছিল রাজনৈতিক আবরণে চরম পন্থা। পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার অবসান ঘটে। কিন্তু ক্ষুদ্র দল-উপদল পর্যায়ে কিছু গোপন গ্রুপ আঞ্চলিক পর্যায়ে তাদের সশস্ত্র তৎপরতা অব্যাহত রাখে। তাদের প্রধান কাজ ছিল এলাকা পর্যায়ে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও বিরোধী-প্রতিদ¦ন্দ্বীদের হত্যা। তবে তা জাতীয় পর্যায়ে কখনো হুমকি হয়ে ওঠেনি। বরং ১৯৭৪ পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের সন্ত্রাসী তৎপরতা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছিল। এরপর আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বিগত শতকের ’৮০-র দশকে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের সমর্থনে শুরু হয় প্রতিরোধের লড়াই। তখন স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশি সে লড়াইয়ে যোগ দেন। তারা লাভ করেন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। যুদ্ধ শেষে জীবিতরা দেশে ফিরে এসে কেউ কেউ সশস্ত্র গ্রুপ তৈরির চেষ্টা করছেন বলে শোনা গিয়েছিল। তবে তার বাস্তব প্রমাণ তেমন মেলেনি। অন্যদিকে ’৮০-র দশকেই কিছু বাংংলাদেশি তরুণ লেবাননে গিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেন। কয়েকজন মারা যান। বাকিদের প্রায় সবাই দেশে ফিরে আসেন। যাহোক, আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিনের লড়াইয়ে যোগদানকারীদের মধ্যে জঙ্গিবাদ নয়, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ বা অ্যাডভেঞ্চারিজম কাজ করেছিল। তাদের একটা নীতি-আদর্শ ছিল। তাদের কেউ উদ্বুদ্ধ বা প্রলোভিত করেনি, তারা স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়েই এ দু’ লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের জেএমবি বা হিযবুত তাহরির বা আইএসের সাথে সম্পৃক্ত সন্ত্রাসীদের কোনো নীতি-আদর্শ নেই।
বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সন্ত্রাসী তৎপরতার শিকার হয় ১৯৯৯ সালে। ৬ মার্চ উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলায় নিহত হন ১০ জন, আহত হন দুই শতাধিক। বাংলাদেশের ইতিহাসে নিরীহ মানুষকে হত্যার লক্ষ্যে বোমা হামলার সেই প্রথম ঘটনা। এ হামলার জন্য প্রথমে বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামসহ ২৭ জনকে আসামী করে মামলা করা হয়। পরে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মুফতী হান্নান গ্রেফতার হওয়ার পর এ হামলা হরকাতুল জিহাদ চালায় বলে তিনি স্বীকারোক্তি দেন। এরপর ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বোমা হামলা চালানো হয়। এতে নিহত হন ১০ নিরীহ মানুষ। তারপর ২০০১ সালের ৩ জুন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে চার্চে বোমা হামলা করা হয়। তাতে নিহত হন আরো ১০ জন নিরপরাধ মানুষ। এরপর ২০০১ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় যুগপৎ বোমা হামলা চালানো হয়। তারপর ২১ আগস্ট ঘটে পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা যা আমাদের ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজেডি।
পরবর্তী কিছু বছর বাংলাদেশ সন্ত্রাসী হামলা থেকে মুক্ত থাকার পর দেশের কয়েকটি স্থানে কয়েকজন বিদেশি নাগরিক হত্যা, কিছু হিন্দু-খ্রিস্টান হত্যা, জুন মাসে উত্তরায় শ’খানেক পিস্তল ও হাজার রাউন্ডেরও বেশি গুলি উদ্ধার করার ঘটনায় সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা সংঘটিত হয়। শঙ্কার কথা হচ্ছে এই যে, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এসব ঘটনা সুপরিকল্পিত এবং যারা ঘটিয়েছে তারা আইএস হোক বা না হোক, ঢাকাভিত্তিক তরুণ। কারো জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই, কেউবা এসেছে বাইরে থেকে। এরা কেউ অসহায় ছিল না। কেউ বিপাকে পড়ে বা অর্থ রোজগারের জন্য এসব কাজে যোগ দেয়নি। আইএসের ওয়েবসাইট আমাক-এর পোস্ট করা ৫ জনের ছবি দেখে মনে হয় তারা ইরাক বা সিরিয়ায় আইএসের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছে। কিন্তু তারা কবে বাইরে গেল ও এলোÑএ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য মেলেনি। আইএস সদস্যরা যেভাবে হাসতে হাসতে মানুষ খুন করে হলি আর্টিজানেও তারা তাই করেছে। জানা যায়, তারা কিছুই চায়নি। প্রথমে শোনা গিয়েছিল যে সন্ত্রাসীরা তিন দফা দাবি পেশ করেছে। কিন্তু পরে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। জীবিত প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায়, তারা প্রথম থেকেই মরতে, তাদের ভাষায় বেহেশতে যাওয়ার জন্য একশভাগ তৈরি ছিল। যে কারণে তাদের কাছে থাকা টাকাগুলোও মরার আগে বিতরণ করে যায়। হায়! কে তাদের হাতে বেহেশতে যাওয়ার সুনিশ্চিত অগ্রিম সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিল, কে জানে? সেই হচ্ছে মাস্টারমাইন্ড। তবে অভিযানকারীদের পক্ষ থেকে যেভাবে বলা হচ্ছে যে তাদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে সন্ত্রাসীদের কেউ পালাতে পারেনি তা অমূলক, অন্যায্য ক্রেডিট নেয়ার ও বীরত্ব প্রদর্শনের কথা। হামলাকারীরা তো বাঁচতেই চায়নি, তারা পালাতে যাবে কেন? এই ৫ বা ৬ জনের গ্রুপটি অস্ত্র প্রশিক্ষণ পেয়েছিল যতদূর মনে হয় বিদেশের মাটিতে, তাদের শতভাগ ব্রেনওয়াশ সাফল্যের সাথে করা হয়েছিল যাতে তারা জীবনের ব্যাপারে চিন্তাভাবনাহীন হয়ে একেকজন হয়ে উঠেছিল রোবোটের মতো অনুভূতিহীন খুনি। এ রকম দ্বিধাহীন, স্বচ্ছন্দ মৃত্যুবরণ অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের বিজ্ঞানসম্মত ব্রেনওয়াশ ছাড়া সম্ভব নয়। আবার এও হতে পারে যে বিশেষ কোনো মাদকসেবনে অভ্যস্ত করিয়ে তাদের এ আত্মঘাতী মিশনে পাঠানো হয়েছিল।
অতি সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, আইএস যোদ্ধাদের ক্যাপ্টাগন ও অ্যাম্ফিটামিন নামক ট্যাবলেট সেবন করিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। তারা তখন বিবেকবর্জিত নৃশংসতার পরিচয় দেয়। আবার অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমেও অনেকে উগ্রপন্থার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। খুব সম্ভবত এ তরুণদের প্রত্যেকেই তার বা তাদের কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা শিক্ষক রূপী ঘৃণ্যদের মাধ্যমে আইএসের জালে আটকা পড়েছিল যেখান থেকে তারা আর বের হতে পারেনি। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় এবং তিউনিসিয়ার মতো মুসলিম দেশগুলো থেকে শুধু তরুণরাই নয়, বহু তরুণী ও নারীরাও আইএসের ভুয়া আদর্শের প্রলোভনে পড়ে সিরিয়ায় গিয়ে বেঘোরে মৃত্যুবরণ করেছে বা নারকীয় জীবনযাপন করছে। আইএস যে কাজটি করতে সক্ষম হয়েছে তাহলো যে কোনো পন্থায়ই হোক, তারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত আত্মঘাতী হামলাকারী তৈরি করে চলেছে যারা আর কিছু না হোক, বেহেশত লাভের ব্যাপারে নিশ্চিত। এদেরকে মানুষ রোবট বলা যেতে পারে। গুলশানের হামলাকারী সন্ত্রাসীরা প্রাণের কোনো মায়া করেনি। এখন বেহেশতের প্রলোভনে এ রকম ভয়ঙ্কর মানুষ রোবট বাংলাদেশে আর কতগুলো ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, তারা কারা, কোথায় আছে, কোথায় আবার আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সর্বশক্তি সহকারে অনুসন্ধান চালানোর সময় এসে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে লক্ষ্যে কাজ করছে। কেউ কেউ মনে করেন, এ ক্ষেত্রে যদি সদিচ্ছার আশ্রয় না নিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করা হয় তা অতীতের আরো অনেক কাজের মতো এক্ষেত্রেও ব্যর্থতার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে একে যদি বরাবরের মতো রাজনৈতিক দমনের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়। আরো কথা, জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার। সরকার জাতির ঐক্যের কথা বলছে, কিন্তু প্রকৃত ঐক্য প্রতিষ্ঠার বাস্তব কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
উল্লেখ্য, কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ২০১৪ সালের ত্রুটিপূর্ণ একতরফা নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে যা জাতিকে মোটা দাগে বিভক্ত করে রেখেছে। তাদের মতে, এ কারণে দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসের মোকাবেলা করতে সফল হচ্ছে না। অবশ্য সরকার সে কথা স্বীকার করে না। তারা মনে করে গোটা জাতি আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ঐ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি তাতে অংশ না নিয়ে বড় ভুল করেছে। তার মাসুল তাদেরই দিতে হবে। সরকার যাই বলুক, এ সত্য অস্বীকার করা যায় না যে গোটা জাতি আজ মোটা দাগে বিভক্ত। এ উপলক্ষে জাতির বিভেদ নিরসনের সে অমোঘ প্রশ্নটি এসে যায়, যা শুধু একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী গুলশানের অন্তর্ঘাত ভালোভাবেই সামলেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি দেশবাসীকে তাঁর ওপর আস্থা রাখার জন্যও বলেছেন। এদিকে সন্ত্রাস মোকাবেলায় সকল ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার দৃঢ় আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শোনা যায়, প্রতিবেশী দেশের বিশেষ বাহিনীর লোকজন ঢাকায় এসেছে। সরকার সন্ত্রাসের হুমকি দমনে প্রয়োজনে উপযুক্ত অন্য দেশের সহায়তা নিতেই পারে। জনগণ তার পক্ষপাতী কি পক্ষপাতী নয় তা এখন গৌণ বিষয়। দেশের জনগণ ও এদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের জরুরি দায়িত্ব। সে জন্য যতটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন তা সরকার হবে বলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনুপস্থিত ছাত্রদের ব্যাপারেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে এটা প্রমাণিত যে সন্ত্রাসী তৎপরতার সাথে মাদরাসা ছাত্র ও অভাবী পরিবারের ছেলেরা নয়, নামি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ও বিত্তবান ঘরের ছেলেরা জড়িত। এ পরিপ্রেক্ষিতে পুরো বিষয়টি নতুন করে মূল্যায়নের অপেক্ষা রাখে।
গুলশানের পর শোলাকিয়া। এরপর কোথায়? সন্ত্রাসী হামলা কি এখানেই থেমে যাবে? নাকি এরপর যে কোনো দিন অন্য কোথাও তারা আবার রক্ত¯্রােত বহাবে? আমরা কেউই তা জানি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল সহায়তা করা সকলের জরুরি দায়িত্ব। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও জনগণের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সদাচারণ করে তাদের সহযোগিতা নেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সবিশেষ জরুরি হলো জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, যা কিনা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ তৈরি করবে। সে বিষয়ে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের কথা ভেবে দেখতে পারে।
 লেখক : সাংবাদিক
যথসধযসঁফনফ@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন