শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মহামারী প্রতিরোধে লকডাউন আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন

মুহাম্মদ আবুল হোসাইন | প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

করোনাভাইরাস নামের মহামারীর উদ্ভব নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতপার্থক্য! কেউ বলেন, চীনের সৃষ্টি, কেউ বলেন আমেরিকার সৃষ্টি! আবার কেউ বলেন, প্রাকৃতিক ভাইরাস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের আমার এক সহকর্মীর সাথে দূরালাপনীর মাধ্যমে জানতে পারলাম, তার মতে, এটি মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট একটি ভাইরাস। আবার যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দাবি করছেন, এটি একটি প্রাকৃতিক ভাইরাস। যত মতপার্থক্যই থাকুক, এটি একটি প্রাণঘাতী মহামারী সে বিষয়ে সবাই একমত। এই মহামারী অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো বিধায় সংস্পর্শ ও গণ-জমায়েতর মাধ্যমে তার বিস্তার ঘটে। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ এই দু’টিকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। আর সংস্পর্শ ও গণ-জমায়েত বন্ধ করার জন্য লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।
এই ধরনের মহামারী পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। বরং যুগে যুগে তার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থাও হয়েছে। মহামারীর প্রাদুর্ভাবের প্রাক্কালে মহান আল্লাহও মানবজাতিকে আত্মরক্ষায় সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং রাসূলুল্লাহ (দ.)ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল্-কুরআ’নে ইরশাদ হয়েছে: ‘তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না।’ সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১৯৫। প্রসিদ্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) যখন ধারাবাহিকভাবে দিনে রোজা ও রাতে ইবাদাতে কাটাতে লাগলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (দ.) তাকে ধারাবাহিকতা পরিহার করে মাঝে মধ্য রোজা পরিত্যাগ ও ঘুমে নিয়মতান্ত্রিকতা আনার নির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন: ‘অবশ্যই তোমার উপর তোমার শরীরেরও অধিকার রয়েছে।’ সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৯৭৫, ৫১৯৯ ও ৬১৩৪। অর্থাৎ শরীরের যত্ন নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
পুরো বিশ্ব এই মহামারী প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মোতাবেক লকডাউন, আইসোলেশন ও হোম কোয়ারেন্টাইনকে বেছে নিয়েছেন এবং অনেক দেশ সফলতাও পেয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশ সরকারও একই নীতি অনুস্মরণ করেছে। যার কারণে দেশের অনেক জেলা-উপজেলা লকডাউনে রয়েছে।
এই মহামারী প্রতিরোধে জনগণের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ঘোষিত ও সরকার কর্তৃক এই পর্যন্ত গৃহীত প্রায় সব প্রদক্ষেপই ইসলামসম্মত।
লকডাউন: অর্থাৎ মহামারীতে আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ ও বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। এই বিষয়ে সরাসরি হাদীসে নির্দেশনা রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, (কোন একসময়ে) ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা উমর (রা.) সিরিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। যখন তিনি ‘সারগ’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তার নিকট সংবাদ এলো যে, সিরিয়ায় মহামারী দেখা দিয়েছে। তখন আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা.) তাকে আবহিত করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো স্থানে মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কথা শোন, তখন সে এলাকায় প্রবেশ করো না। আর যদি তোমরা মহামারীতে আক্রান্ত এলাকায় অবস্থান কর, তাহলে পলায়নের উদ্দেশ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না।’ সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৫৭৩০।
আইসোলেশন: চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় মহামারী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক রাখাকে আইসোলেশন বলা হয়। হাদীসেও এই বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আবু সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি আবু হুরায়রাহ (রা.) কে বলতে শুনেছেন, নবী কারীম (দ.) বলেছেন, ‘কেউ যেন কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ ব্যক্তির সাথে না রাখে।’ সহীহ বুখারী, হদীস নং- ৫৭৭৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১৭৪৩।
হোম কোয়ারেন্টোইন: চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিভাষায় সুস্থ ব্যক্তি মহামারীতে আক্রান্তের আশঙ্কায় জনবিচ্ছিন্ন থাকাকে কোয়ারেন্টাইন বলা হয়। এই বিষয়েও হাদীসে নির্দেশনা রয়েছে। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, ‘প্লেগ রোগ বা মহামারীর সময় কোনো বান্দা (ব্যক্তি) যদি ধৈর্য ধারণ করে এই বিশ্বাস নিয়ে নিজ এলাকায় অবস্থান করতে থাকে যে, আল্লাহ তা’য়ালা তার জন্য ভাগ্যে যা লিখেছেন তা ব্যতীত কোন বিপদ তার কাছে আসবে না। তাহলে সে বান্দার (ব্যক্তি) জন্য শহীদ ব্যক্তির সমান সাওয়াব নির্ধারণ থাকবে।’ সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৫৭৩৪। অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে: প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু হুরায়রাহ (রা.) রাসূলুল্লাহ (দ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (রাসূলুল্লাহ দ.) বলেছেন, ‘কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি (ভয়ে) বাঘ থেকে দূরে থাক।’ সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৫৭০৭।
তাহলে করোনাভাইরাস নামক প্রাণঘাতী মহামারীর প্রতিরোধে জনকল্যাণের স্বার্থে গৃহীত তিনটি প্রদেক্ষেপই ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য।
আর হাদীসের ভাষ্যনুযায়ী এই মহামারীতে মৃত ব্যক্তি শহীদের মর্যাদা পাবেন। প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, ‘উদরাময় রোগে (পেটের অসুস্থতা) মৃত ব্যক্তি শহীদ ও প্লেগ বা তদানুরূপ মহামারী রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ হিসেবে গণ্য হবে।’ সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৫৭৩৩।
হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র মিসরস্থ আল্-আয¦হার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র স্কলারদের বোর্ডও গত ৩ এপ্রিল ২০২০ প্রকাশিত ফাত্ওয়ায় করোনা মহামারী প্রতিরোধে মুসলিম বিশ্বরে বিভিন্ন দেশের সরকার কর্তৃক গৃহীত লকডাউন, আইসোলেশন ও হোম কোয়ারেন্টাইন মান্য করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ওয়াজিব বলে ফাত্ওয়া দিয়েছে এবং অমান্যকারী গুণাহগার হবে বলে আখ্যায়িত করেছে।
এই দুর্যোগ মুহূর্তে সামর্থ্যবানদের গরিব, অসহায় ও অভাবী মানুষদের পাশে দাঁড়ানো খুবই প্রয়োজন এবং পবিত্র কুরআ’নুল কারীমে এই মহৎ গুণের প্রশংসা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্য দান করা, ইয়াতীম আত্মীয়স্বজনকে অথবা ধূলায় লুণ্ঠিত দরিদ্রকে।’ সূরা আল্-বালাদ, আয়াত: ১৪-১৬।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন