শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক প্রসঙ্গে

প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
দেশে একটি জাতীয় ঐক্যের আওয়াজ উঠেছে। আওয়াজটি তুলেছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলার পর, এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। তাতে মানুষ দেশের রাজনীতি নিয়ে যেমন আশান্বিত হয়, তেমনি ফিরে পেয়েছে শক্তি ও সাহস। খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক একটি সময়োপযোগী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সমগ্র জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তে। দেশে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন জাতীয় ঐক্য চায়। কোনো রাজনৈতিক দল বা শক্তি এর বাইরে থাকতে পারে না, সরকারও নয়। সবার উচিত বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দেয়া এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলা। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যদি ঐক্যের ব্যাপারে দৃঢ় ভূমকিা নেয়, তাহলে গোটা জাতি আশান্বিত হবে, দেশের ইমেজও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, সর্বোপরি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে।
বেগম খালেদা জিয়া আরো বলেছেন, ‘দোষারোপের রাজনীতির সময় এখন নয়, কে ক্ষমতায় থাকবে, কে ক্ষমতায় যাবে তাও বিবেচ্য বিষয় নয়, এখন সময় দেশ রক্ষা করার এবং দেশের স্বার্থে কাজ করার।’ একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছেÑ খালেদা জিয়ার এই কথায়। তিনি সঠিক সময়ে, সঠিক কথাটিই বলেছেন। শাসক দলসহ সবার উচিত, জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া এবং এটিকে বাস্তব রূপ দেয়া। কিন্তু শাসক দলের মুখে আমরা শুনছি ভিন্ন সুর। তারা জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে বিভিন্ন শর্তজুড়ে দিচ্ছেন, যা কোনোভাবেই কাঙ্খিত নয়। জাতীয় ঐক্য হলে সবচেয়ে লাভবান হবে শাসক দল। কেননা, তারা আছেন ড্রাইভিং সিটে তথা চালকের আসনে। দেশ ভালো চললে, দেশের উন্নতি হলে; দেশের মানুষ শান্তিতে থাকলে, তার বেনিফিশিয়ারি হবে শাসক দলই। কাজেই কোনো শর্তারোপ না করে শাসক দলের উচিত খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দেয়া এবং দেশে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা।
আমাদের রাজনৈতিক বিবেচনায়, এটি শাসক দলের জন্য একটি বিরাট রাজনৈতিক সুযোগ, যা সবসময় আসে না। এই সুযোগ হেলায় হারানো কোনোভাবেই সমীচীন নয়। তাতে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা যেমন উৎসাহিত হবে, তেমনি ভাবমর্যাদা নষ্ট হবে দেশেরও। কেননা দেশে যখন সংকট তৈরি হয়, তখনই নেতৃত্ব প্রকাশের সময় হয়; খালেদা জিয়া সেই নেতৃত্ব প্রকাশ করেছেন, আমরা আশা করি শাসক দলও নেতৃত্ব প্রকাশ করবে এবং দেশেরে ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করবে।
গুলশান ট্র্যাজেডিতে দেশের ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পত্রিকায় এসেছে, বহু তৈরি পোশাক ক্রেতা তাদের নির্ধারিত সভা ঢাকা থেকে অন্যান্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছেন। এটা দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মোটেও সুখবর নয়। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের জন্য এটা একটা অশনি সংকেত। এসব দেখে রাজনীতিবিদরা চুপ থাকতে পারেন না। তাদের মধ্যে অনৈক্য ও ভেদাভেদ কাম্য নয়। এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য হলে, দেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হবে; দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পাবেন, তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।
একটি সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব যে কোনো নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া। রাষ্ট্রে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলা হলে কোনো নাগরিক গুম হলে, খুন হলে দোষীদের গ্রেফতার করা এবং বিচারে সোপর্দ করা। সরকার যদি তা করতে অপারগ বা ব্যর্থ হয় তাহলে বুঝতে হবে সরকার নিজে তা করেছে বলে বিচার করতে অনিচ্ছুক। নয়তো সরকার অপরাধী শনাক্ত করতে বা অপরাধীর বিচার করতে অক্ষম বা অসমর্থ। যদি এর কোনোটিও সত্য না হয় তাহলে সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার থাকে কোথায়? মানুষের নিরাপত্তা ও জীবন যদি রাষ্ট্র কেড়ে নেয় তাহলে সে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন থাকে কোথায়? বা রাষ্ট্রটিও থাকে কোথায়? রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ। জনগণকে সার্বক্ষণিক আতঙ্কে রেখে রাষ্ট্র সঠিকভাবে চলতে পারে না। জনগণের নিরাপত্তা ও সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের এবং এ শপথ নিয়েই তারা ক্ষমতাসীন হয়।
রাজনীতিতে কেউ কারো শত্রু নয়, প্রতিপক্ষ মাত্র; এ অনিবার্য বাস্তবতা মেনেই রাজনীতি করতে হয়। বিএনপির ক্ষতি আওয়ামী লীগের জন্য হিতকর নয়। অনুরূপ আওয়ামী লীগের ক্ষতিও বিএনপির জন্য কল্যাণজনক নয়। কেননা এ দুটি দল একে অপরের ভারসাম্য ও সমার্থক শক্তি। ভারসাম্য ছাড়া কোনো কিছুই সঠিকভাবে চলতে পারে না, যেমন বাংলাদেশ সঠিকভাবে চলছে না। বিএনপিকে ছাড়া আওয়ামী লীগ যেমন অচল, তেমনি আওয়ামী লীগকে ছাড়াও বিএনপি অচল। এ অনিবার্য সত্য উভয় দলকেই মানতে হবে, তাহলেই দেশে জঙ্গি হামলা, মারামারি ও রক্তারক্তি বন্ধ হবে; নয়তো কোনো নেতা-নেত্রীর পক্ষেই দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ ঐক্যের দিক থেকে পৃথিবীতে একটা নিদর্শন ছিল। কিন্তু এটি ভেঙে চুরমার  হয়েছে। এখন জাতি হিসাবে সবদিক দিয়ে আমরা বিভক্ত। ক্ষুদ্র একটি আঘাত সহ্য করার মতো শক্তিও আমাদের নেই। গুলশানের সন্ত্রাসী হামলায় তা প্রমাণ হয়েছে। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। আমরাও আজ এক বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছি। জঙ্গি হামলা, গুম-খুন ও অপহরণ আতঙ্কে দেশের একটি মানুষও শান্তিতে ঘুমাতে পারে না, রাস্তায় চলাচল করতে পারে না; ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে না। এভাবে একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না।
বলতে দ্বিধা নেই গণতান্ত্রিক শাসনের একটি সংকটময় সময় এখন বাংলাদেশ অতিক্রম করছে। এই সংকট এখন প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে। দেশে এক অশান্ত ও বেদনাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সংকট থেকে বেড়িয়ে আসতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের বিকল্প নেই, কেননা যে কারণেই হোক গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে, দেশ ও জনগণ যে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে এটি বলাই বাহুল্য। সুতরাং রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐক্য তথা জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি। জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে যে আওয়াজ দেশে উঠেছে, তাকে অবশ্যই বাস্তবরূপ দিতে হবে; এই ঐক্যের বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না। যে দল এই ঐক্যের বাইরে থাকবে, সে দল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে; সেই দলের রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটবে।
১০টি ভালো কাজ ক্ষতিগ্রস্ত করতে, একটি খারাপ কাজই যথেষ্ট। গুলশানের হামলা তেমনই একটি খারাপ কাজ। গুলশানে জঙ্গি হামলায় জড়িতরা উচ্চ শিক্ষিত ও বয়সে তরুণ। তারা কেন জঙ্গি হামলায় ঝুঁকছে তা অনুসন্ধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রকে অবশ্যই পালন করতে হবে। খতিয়ে দেখতে হবে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। তাহলেই রাষ্ট্র নিরাপদ থাকবে, নিরাপদ থাকবে রাষ্ট্রের জনগণও।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
kamrul hasan ২২ জুলাই, ২০১৬, ১:১১ এএম says : 0
excellent
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন