পূর্ব প্রকাশিতের পর
শব্দটি আরবী শব্দ সাওম থেকে প্রথম ফার্সী ভাষায় এবং পরে ফার্সী থেকে অপরিবর্তিতভাবে বাংলা ভাষায় এসেছে। মূল আরবী শব্দ সাওমের অর্থ হচ্ছে সংযম, বিরত থাকা বা উপবাস যাপন। আর পরিভাষা হিসেবে এর অর্থ হছে, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকা। সাওম বা রোযা শুধু মুসলমানদের উপরই নয়, পূর্ববর্তী জাতিসমূহের উপরও আল্লাহ তায়ালা রোযা ফরজ করে দিয়েছেন।
সওমের তাৎপর্য :
কুরআন অবতীর্ণের মাস রমজানুল মুবারকে আল কুরআনের আদেশ নিষেধ জীবনের সকল ক্ষেত্রে মেনে পানাহার, ব্যভিচার, কামাচার, পাপাচার তথা মহান আল্লাহ তায়ালার মর্জির বিপরীত সকল নিষিদ্ধ কর্ম হতে ব্যক্তি জীবনে বিরত থাকা। নিজের পরিবারের সকল সদস্যকে আল্লাহর তরফ হতে অবতীর্ণ আল কুরআন ও আল কুরআনের জীবন বিধানের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা কুরআনের জীবন্ত প্রতীক রাসুল (সা.) কর্তৃক নিন্দনীয় ও বর্জনীয় সকল ক্রিয়াকান্ড থেকে বিরত রাখা। আর মুসলিম বৃহত্তম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সমাজ ও রাষ্ট্রকে আল্লাহ ও রাসুল কর্তৃক অশ্লীল ও নিষিদ্ধ সকল কর্মতৎপরতা মানব রচিত আইন ও অপসংস্কৃতি হতে বিরত করার লক্ষ্যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। আর তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পারো; কেননা তিনি তোমাদের হেদায়েত দান করেছেন, যেন তোমরা আল্লাহর শুকর আদায় করতে পারো।(সূরা বাকারা: ১৮৩ ও ১৮৫ )
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ তায়ালা সিয়াম পালনের নির্দেশ দানের সঙ্গে সঙ্গে সিয়ামের উদ্দেশ্য বলে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে তিনটি। ক. মুত্তাকি হওয়া, খ. হেদায়েত প্রদানের জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা, গ. তার শোকর আদায় করা। উদ্দেশ্য তিনটির মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে মুত্তাকি হওয়া। মুত্তাকি বলতে কি বুঝায়? মুত্তাকী শব্দিটি এসেছে আরবী তাকওয়া থেকে এবং যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে তিনি হচ্ছেন মুত্তাকী। তাকওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে সংযম ও আল্লাহভীতি এবং মুত্তাকী শব্দের অর্থ হচ্ছ সংযমী, পুণ্যবান ও আল্লাহভীরু। সিয়াম বা রোজা পালনের দ্বারা মানুষ যদি সংযমী ও খোদাভীরু হতে পারে, তাহলেই সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। কেননা একজন সংযমী বা আল্লাহভীরু ব্যক্তির দ্বারা সমাজে কোন অন্যায় বা জুলুম হতে পারে না। যেহেতু আল্লাহভীরু ব্যক্তি সর্বদাই আল্লাহর নিকট পরকালে জওয়াব দেওয়ার ভয়ে ভীত থাকে। তার মনে সর্বদাই এ ভয় বিরাজ করবে যে, তিনি যদি অন্যায় করেন দুনিয়াতে রেহাই পেয়েও যান, পরকালে তিনি নিস্তার পাবেন না। সেখানে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। আল্লাহর কাছে এই জবাবদিহি ও পরকালে শাস্তির ভয়ই মানুষকে যাবতীয় অন্যায় থেকে বিরত রাখবে। মানুষ যদি এভাবে সংযমী হয়, কেউ কোন অন্যায় অত্যাচার না করে,কারো অধিকার হরণ না করে, কারো ইজ্জত আবরুর উপর হামলা না করে, কাউকে বে আইনিভাবে হত্যা না করে। যার যার অধিকার তাকে যথাযথভাবে প্রদান করে, তাহলেই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে মুত্তাকী হলেই শুধু এরূপ সংযমী হওয়া সম্ভব। আবার রোজা পালন করতে হয় বছরে এক মাস এবং তা রমজান মাসে, কুরআন নাজিলের মাসে। আল কুরআন হচ্ছে, মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এ কুরআনের মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালা মানুষকে হেদায়েত তথা পার্থিব জীবনের জন্য সঠিক ও কল্যাণকর পথ প্রদর্শন করেছেন। কুরআনে রয়েছে মানব জীবনের সকল ক্ষেত্র যথা তার ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকারিত্ব, উপার্জন ও ব্যয় ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার ও প্রশাসন, এক কথায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যত কাজ মানুষকে করতে হয় তার প্রতিটির জন্য সর্বোত্তম পথের দিশা।
আল্লাহ তায়ালার প্রদর্শিত পথ সর্বোত্তম কেনো? কারণ, তিনি সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী, কুশলী ও সর্বোপেক্ষা ক্ষমতাবান। তিনি হচ্ছেন অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে সম্যক অবগত। তার নির্দেশেই এ বিশ্বজগত পরিচালিত হচ্ছে আবার তার নির্দেশেই সব একদিন ধংস হয়ে যাবে। আবার তিনিই সবাইকে পুনর্জীবিত করে হিসেব-নিকাশ সম্পন্ন করে যার যার প্রাপ্য শাস্তি বা পুরস্কার তাকে তা দিয়ে দিবেন। এ ক্ষমতা একমাত্র তারই করায়েত্তে। কাজেই তার শাস্তি এড়িয়ে পুরস্কার পেতে হলে তার নির্দেশিত পথেই মানুষকে চলতে হবে। তিনি যদি দয়া করে মানুষকে এ পথ প্রদর্শন না করতেন তাহলেও তার কোন ক্ষতি হত না। তা সত্তে¡ও তিনি মানুষকে সর্বোত্তম পথের সন্ধান দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামীন আরও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রদর্শিত পথ ছাড়া অন্য কোন পন্থা বা পদ্ধতি তার কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না। মানুষ যেন এ কথা উপলব্ধি করে যে শাস্তি ও পুরস্কার প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র তারই আছে, অন্য কারোই নাই। এ জন্য সকলেরই উচিত তার ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তার শোকর আদায় করা। মানুষ যদি আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েও তার শোকর আদায় না করে , তাহলে সে হবে অকৃজ্ঞ। তিনি যদি মানুষকে সঠিক পথের দিশা না দিতেন, তাহলেই কেউ উত্তম পথ পেত না। দুনিয়াতে কোন মুমিন-মুসলমানের অস্তিত্বও থাকতো না। সকলেই কাফের, মুশরিক বা সংশয়বাদী হিসেবে জীবন যাপন করে পরকালে জাহান্নামের ইন্ধন হতো। শুধু পরকালেই নয়, আল্লাহ তায়ালার প্রদর্শিত পথে না চলে এ পৃথিবীতেও বহু লোক আজও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে চরম অশান্তির অনলে দগ্ধ হচ্ছে।আর যারা তার হেদায়েত মেনে নিয়ে জীবন যাপন করেন, তারা এ পৃথিবীতেও অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেন। পরকালের শান্তিতো তাদের জন্যই অপেক্ষা করছেই। কাজেই মহান রাব্বুল আলামীনের প্রদত্ত হেদায়েতের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শোকরিয়া স্বরুপ তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জীবনপথে চলার জন্য আল্লাহর হেদায়েতের দরকার কি? মানুষ কী নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে সুন্দর জীবন গঠন, সমাজ-সংসার, দেশ-রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় সক্ষম নয়? এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলা প্রয়োজন যে, মানুষ যখনই আল্লাহর হেদায়েত উপেক্ষা করে স্বীয় জ্ঞান-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে জীবন ও পরিবার, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার চেষ্টা করেছে, তখনই দেখা গেছে, মানব-সমাজে বিপর্যয়, ধ্বংস ও সংঘাত। অতিত ইতিহাস ও বর্তমান যুগে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। অতীতে আদ ও সামুদ জাতি, হযরত লুত (আ.) ও হজরত শোয়াইব (আ.)-এর জাতিসহ আরো অনেক প্রাচীন জাতি ও জনপদ ধংস হয়েছে একমাত্র আল্লাহর হেদায়েত অস্বীকার করে স্বেচ্ছাচারী জীবন-যাপন করার জন্য।কারণ মানুষের শুধু সুবুদ্ধিই নয়, ভয়ানক কুবুদ্ধিও আছে। আরও আছে নানা পাশবিক প্রবণতা , নীচতা, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি।
এ রোজা অর্থাৎ সারাদিন অনাহারে থাকাসহ সংযমী জীবন-যাপনের মাধ্যমে তার মাঝে খারাপ দোষগুলো নিস্তেজ হয়ে ফেরেশতা সুলভ উত্তম গুনাবলী বিকশিত হয়। মানুষের মধ্যে এ উত্তম চরিত্রের গুণাবলি যত বেশি বিকশিত হবে,সমাজে তত বেশি শান্তি-শৃংখলা ও সপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। রোজার মাধ্যমে মানুষের মাঝে উত্তম গুণাবলী সৃষ্টি ও সমাজে তার প্রতিপালন সম্পর্কে সায়্যদি আবুল হাসান আলী নদভী বলেছেন, দেহ ও আত্মায় মিলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি ব্যতীত খিলাফতের এ গুরুদায়িত্ব পালন করা মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই মহা প্রজ্ঞার অধিকারী,বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মানব জাতির আধ্যাতিক প্রশিক্ষণের জন্য নাজিল করেছেন সিয়ামের বিধান। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন