মুর্শিদা খানম
বিশ্বমানচিত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে একটি মৌল বিষয় প্রতিভাত হয়ে ওঠে তা হচ্ছে একশ’রও অধিক সার্বভৌম রাজনৈতিক এককগুলোর মধ্যে মানবজাতির বিভক্তি। প্রতিটি একক প্রকারান্তরে একেকটি রাষ্ট্র, এদের মধ্যে আছে সাদৃশ্যÑবৈশাদৃশ্য, মতভেদ, মতৈক্যÑএসব কিছু নিয়েই বিশ্ব রাজনীতি প্রতিনিয়ত প্রবাহমান। বিশ্বায়নের উদার মানসিকতায় মানুষ এখন এক বিশ্ব, এক জাতি হিসেবে শান্তির ছায়াতলে থাকতে চায়। কিন্তু পরিবর্তনশীল ও ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর বিশ্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গোষ্ঠীর এবং এগুলের বিভিন্ন পর্যায়ের পরিবর্তনশীলতা সম্পর্ককে অন্তর্ভুক্ত করে একটি গতিশীল পথে ধাবমান। একটি দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি যেমন বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, তেমনি বিশ্ব রাজনীতিও আভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে না। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সত্য অধিকমাত্রায় স্পষ্টÑপ্রতিভাত হয়ে ওঠে। নিজেদের সার্থ ও অবস্থান সুরক্ষিত ও সুসংহত করার জন্যই বিভিন্ন রাষ্ট্র পরস্পর জোট সৃষ্টি করেছিল এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে তুলেছিল।
ওআইসি তথা ইসলামি সম্মেলন সংস্থা যখন গঠিত হয়েছিল, তখন ছিল ¯œায়ুযুদ্ধের সময়। বিশ্ব মূলত আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। একটি পুঁজিবাদী অন্যটি সমাজতান্ত্রিক। ওআইসি বা ইসলামি সম্মেলন সংস্থা হিসেবে জন্ম নিয়েছিল ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে, এই উদ্যেগের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ। তিনি ইসলামী বিশ্বের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতকে কমিয়ে এনে সহযোগিতার সম্পর্ক নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, স্বতন্ত্র ইসলামিক শক্তি গড়ে উঠবে এটা, পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রবাদী দুই শিবিরের কেউ আন্তরিকভাবে দেখতে চায়নি। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের যারা ওআইসি-কে ন্যাটো বা ওয়ারশ জোটের মতো দেখতে চেয়েছিল তারা পরবর্তীতে হতাশ হয়েছিল। কারণ, ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনগুলো মুসলিম বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সৃষ্টির প্রত্যয়ে সীমাবদ্ধ থাকে। এই সংস্থাটির উদ্যোগে বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, যা আজ সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ও সমাদৃত। সৌদি আরব ছাড়াও পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ইরান, মিশর, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়ার মতো মুসলিম দেশগুলোও বিভিন্ন পর্যায়ে এতে অবদান রেখেছে। কিন্তু সদা পরিবর্তনশীল বিশ্ব রাজনীতি। ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্বের বিপ্লব এবং এর বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর সম্মিলিত প্রতিরোধ কার্যক্রম ইসলামি বিশ্বে ঐক্যের পরিবর্তে জাতিতাত্ত্বিক বিভক্তিকে চাঙ্গা করে তুলেছিল। আট বছর ধরে ইরাক-ইরান যুদ্ধ ওআইসি’র ঐক্যে প্রথম ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তবে এ যুদ্ধ বন্ধে ওআইসি’র ভূমিকা ছিল মুখ্য। আবারও গত এক দশকে জাতিতাত্ত্বিক সংঘাতে ইরান অধিক ভূমিকা পালন করেছে। এই জাতিতাত্ত্বিক সংঘাত বর্তমানে শুধু সিরিয়া, ইয়েমেন নয় ক্রমশ আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। পত্রÑপত্রিকা আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে জানা যায়, শুধু সিরিয়ায় পাঁচ লাখের মতো মানুষ মারা গেছে। এই জাতিতাত্ত্বিক সংঘাতে মুসলিম বিশ্বের চরমক্রান্তি লগ্নে গত ১৪-১৫-ই এপ্রিল ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি এর ত্রয়োদশ শীর্ষ ২০১৬ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তুরস্কের আঙ্কারায়। সম্মেলনে ওআইসির নতুন চেয়ারম্যান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ইসলামি দেশগুলোর ঐক্য সৃষ্টির ডাক দেন। তার বক্তব্য ছিল আমাদের ধর্ম ইসলাম, শিয়া বা সুন্নি নয়। এই আহ্বান কি মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে? এই প্রশ্ন সকলের।
এবারের ওআইসি সম্মেলনে দুটি সুনির্দ্দিষ্ট বক্তব্য উঠে এসেছে, এর প্রথমটি হলো, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইসলামি বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণ এবং লক্ষ্যে ওআইসি’র একটি নিজস্ব ইন্টারপোল পুলিশি সংস্থা গঠন। প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজেই এর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হলো, একটি ইসলামিক দেশকে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ দেওয়া। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ইসলাম হলেও জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদে এর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এমনকি বিশ্ব নেতৃত্ব যাদের নতুন করে সদস্য পদ দেওয়ার কথা ভাবছে সেই তালিকায়ও নেই কোনো মুসলিম দেশের নাম। ওআইসির বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হবে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এই আশা সকলের। ওআইসি নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে জাতিতাত্ত্বিক সংঘাত যে মুসলিম বিশ্বেও কল্যাণ না এনে ধ্বংসযজ্ঞ সৃস্টি করে সেই উপলদ্ধি উঠে এসেছে। এত উপলদ্ধি ও আলোচনার পরেও মুসলিম দেশগুলোর সহনশীলতা ও সহাবস্থানের লক্ষ্য অর্জিত হবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের হানাহানিকে দীর্ঘায়িত করার মতো নীতি ও কৌশলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে পাশ্চাত্যের গুরুত্বপূর্ণ নীতি পরামর্শকদের বক্তব্যে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বুশ আমলের সন্ত্রাস বিরোধী আগ্রাসী নীতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেছেন অনেক আগেই। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলো আমেরিকার নিরাপত্তার আশ্রয়ে নির্ভরশীল ছিল তারা এখন নিজ সরকার ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজস্ব হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত। একটি নিরাপত্তা বলয় ও স্থিতিশীল অঞ্চল গড়ার লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যের পথে মুসলিম দেশগুলো কতটুকু এগিয়েছে, সেটিকে সংঘাতমুখর করার গোপন তৎপরতাও একই সাথে চলমান। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের কর্মকা-ে তার প্রতিফলনও লক্ষ করা যাচ্ছে। ইসলামি দেশগুলোর ভুলে গেলে চলবে না যে, কমিউনিজমের পতনের পর পশ্চিমা চিন্তাবিদ স্যামুয়েল হান্টিংটন ‘সভ্যতার দ্বন্দ¦’ তত্ত্ব দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার সামনে ইসলামকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেছেন। গত কয়েক দশকের বৈশ্বিক ঘটনাবলীতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম বিশ্বে যে অস্থিরতা ও হানাহানি দেখা যাচ্ছে তার সাথে ওই তত্ত্বের বিশেষ সম্পর্ক লক্ষণীয়। নতুন পরিস্থিতি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যে সংঘাত তা নিজেদের আভ্যন্তরীণ সংঘাত। প্রতিনিয়ত চরমপন্থীদের উস্কে দেওয়া হচ্ছে, ইসলামিস্টদের সাথে শাসক এলিটদের ক্ষমতা হারানোর ভয় দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইসলামের মৌলিক চেতনা ধ্বংসের এরকম প্রচেষ্টা ¯পষ্ট হয়ে ওঠছে। সম্প্রতি আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক পরিচালক অবসর প্রাপ্ত জেনারেল পেট্রাডাউসের ইসলামিক চরমপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য গাইড লাইন সম্বলিত এক নিবন্ধন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তার মূল ইঙ্গিতটির ব্যাখ্যা হচ্ছে-
ইসলামকে সভ্যতার দ্বন্দ্বের তত্ত্ব দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। এটি হলে ইসলামি শক্তি এবং পাশ্চাত্য শক্তি বা খ্রিষ্টীয় শক্তি, ক্রসেড আমলের মতো মুখোমুখি হবে। এর পরিবর্তে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের তত্ত্ব গ্রহণ করা গেলে মুসলিমদের নিজস্ব শক্তিতে বিভক্তি এনে তাদের এক পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। সুবিধামতো পক্ষকে মদদ দেওয়া যাবে বিশেষ গোপন কর্মসূচীর মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে এটি দেখাও গিয়েছিল ইরাক এবং আফগানিস্তানে। এখন সেসব দেশে চরমপন্থী এক একটি গ্রুপের রহস্যজনক উত্থান ঘটানো হচ্ছে, তাদের সন্ত্রাস ও অনিয়ম তান্ত্রিক তৎপরতাকে ইসলামিস্টদের দমনের অজুহাত বানানো হচ্ছে। মিশরের আভ্যন্তরীণ ঘটনায় দেখা যায় মুসলিম ব্রাদারহুডের অহিংস আন্দোলনের সময় রহস্যজনকভাবে কিছু অন্তর্ঘাতী কাজে পুলিশ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দায় ব্রাদারহুডের ওপর চাপিয়ে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক স্থাপনাকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সিসির প্রাপ্তি কথা এবং ব্রাদারহুডের নির্মম আচরণের বাস্তবতা একটি সমোঝতা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে আছে এখনো। এজন্য চরমপন্থী চিন্তা ও তৎপরতার বিস্তৃতি ঘটার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার মাধ্যমে।
পেট্রাডাউস তার নিবন্ধে জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ইসলামি বিশ্বের অংশীদারদের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। মনে রাখতে হবে, ইসলামি বিশ্বে আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে, একই সভ্যতার ভেতরের সংঘাত।’ প্রধান প্রধান ইসলামি দেশগুলোতে সেসব দেশের নেতাদের চরম পন্থার বিস্তারে যে ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি হারানোর কিছু নেই, এই বাস্তবতাকেই কাজে লাগাতে হবে। দেখা যাচ্ছে, ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া তুর্কি খেলাফত ভাঙার জন্য সৌদি পরিবারের ভূমিকা, বিদ্রোহ ও সহিংসতার জন্য বাদশা সালমানের দাদাকে ইস্তাম্বুলে ফাঁসি দেয়ার তিক্ত ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। দু’দেশের মধ্যকার সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের স্থায়ীত্বের বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বাদশা সালমানের পূর্বসূরী আব্দুল্লাহর মিশর নীতি যদিও একপেশে ছিল বর্তমানে সেই নীতিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টায় আছেন সালমান। এটা ইতিবাচক দিক। তবে, মিসরের সমস্যা সমাধানে উভয়পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট সিসিকে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি এবং শাসনতান্ত্রিক রাজনীতি করার অধিকার মেনে নিতে হবে। নিপীড়নের পরিবর্তে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। মুরসি, বদিইসহ সকল শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে হবে। ব্রাদারহুডকে মেনে নিতে হবে মিশরের সামরিক অভ্যুত্থান উত্তর বাস্তবতাকে। ইসলামিক দেশগুলোর বৃহত্তর সার্থে প্রয়োজন বিশেষ ঐক্য। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে তুরস্ক, সৌদি আরব, পাকিস্তান, মিশর, ইরানসহ শক্তিশালী দেশগুলোকে। সেই সাথে প্রয়োজন জাতিতাত্ত্বিক সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসা। সময়ের সাহসী নায়ক মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের আহ্বানকারী রজব তাইয়েব এরদোগান। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ইসলামিক স্টেট ও আল-কায়েদাসহ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। গত ১৭ এপ্রিল রোববার ইস্তাম্বুলের সিনান আরদেম স্পোর্টস সেন্টারে তুরস্কের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কতৃক আয়োজিত ‘পবিত্র জন্ম সপ্তাহ’ অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে তিনি বলেন ‘ইসলামের চরম শত্রুরা ইসলামের যতটা না ক্ষতি করছে ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। আইএস, বোকো হারাম ও আল-কায়েদা সন্ত্রাসীরা মানুষের ওপর যে উৎপীড়ন ও নির্যাতন চালাচ্ছে তার দায় বর্তাচ্ছে মুসলিমদের ওপর।’ বক্তৃতাকালে তিনি ইসলামের সকল অনুসারীদের এক হওয়ার এবং একে অপরের সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে আরো বলেন, ‘বর্ধিষ্ণু সন্ত্রাসবাদ ও বিভাজনের মাঝেও মুসলিমরা তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’ বিশ্বের মুসলিমদের ইসলামের এক ছায়াতলে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিয়া বা সুন্নি বলে আমাদের কোনো ধর্মের কথা জানা নেই, আমাদের ধর্ম শুধুমাত্র একটি যার নাম ইসলাম।’
এই তুর্কি প্রেসিডেন্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ‘জিহাদ’ শব্দটি ব্যবহারকেও চ্যালেঞ্জ জানান এবং জোরের সাথে বলেন, জিহাদ মানে কোনো সন্ত্রাসবাদ নয়। জিহাদ মানে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়; মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা নয়। এ সময় তিনি ইসলামি দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি’র সমালোচনা করে তা পুনর্গঠনেরও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মুসলিম দেশগুলোর নিজেদের মধ্যকার সমস্যা নিরসনে সংগঠনটির বিশাল সম্ভবনাকে কাজে লাগানো উচিত।
ইস্তাম্বুলের বিশ্ব মানবিক সম্মেলনে ২৩ মে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সিরিয়ার মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ জাতিসংঘের কড়া সমালোচনা করেন। শুধু তাই নয় গত ১৫ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যা নিজ দেশ তুরস্কে আকস্মিকভাবে যখন সেনাবাহিনীর একাংশ অভ্যুত্থান ঘটায় তখন রাজধানী আঙ্কারা থেকে সাড়ে ৬০০ কিলোমিটার দূরে উপকূলীয় মারমারিস শহরে অবকাশ যাপনে ছিলেন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান। বিদ্রোহী সেনানরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখলে নেওয়ার পর ফেসবুকসহ নানা অ্যাপ বন্ধ করে রাজধানী ও দেশটির সবচেয়ে বড় শহরের বাসিন্দাদের ইন্টারনেট যোগাযোগ থেকে প্রায় বিছিন্ন করে দেয়।
সে সময় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন এরদোগান। দূরে থেকেও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন নিজের স্মার্টফোন ব্যবহার করে। আর তা যে কতটা কার্যকর হয়েছে সেটা বোঝা গেছে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর। এই ভিডিও চ্যাট অ্যাপে একটি ভাষণে এরদোগান অভ্যুত্থান ঠেকাতে জনগণকে রাজপথে, বিমানবন্দরে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। ফেইস টাইমে দেওয়া তার ওই বক্তব্য সিএনএন-তুর্ক টেলিভিশনে দেখানো হয়।
এরদোগান তার অ্যাপের ভাষণে জনগণের উদ্দেশে বলেন, আমরা অবশ্যই জয়ী হব। সমর্থকদের এই ষড়যন্ত্র রুখতে রাজপথে থাকতে হবে। আপনারা রাজপথে যান এবং তাদের (সেনাদের ) যথাযথ জবাব দিন। তাদের কাছে ট্যাংক কামান থাকতে পারে, কিন্তু জনগণের চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই। তিনি বলেন, চেইন অব কমান্ডের বাইরে গিয়ে এসব কাজ করা হয়েছে। আমি আঙ্কারার উন্মুক্ত স্থানে আসছি, যারা এই অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টায় জড়িত তাদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে। এএফপির খবরে জানানো হয়, টুইটারের দেওয়া এ বার্তায় এরদোগান বলেন, সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টায় যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন আমাদের সারারাত রাস্তায় থাকতে হবে। ফলে হাজার হাজার সমর্থকদের বিক্ষোভের মুখে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী অংশ ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়, এক পর্যায়ে সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে পুলিশের কাছে। এরদোগানের এই একনিষ্ঠ সাহসী নেতৃত্ব, বীরত্ব যেমন নিজ রাষ্ট্রকে রক্ষা করেছে, তেমনি মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর কাছে তা ঐক্যবদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেছে। বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনোবল আরও সবল এবং দৃঢ় করতে আজ অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। এখন প্রয়োজন মুসলিম বিশ্বে তথা প্রতিটি দেশের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
ইসলামি দেশগুলোর দুর্যোগের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র এই একজন এরদোগান। মুসলিম বিশ্বের চরম সংকটকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের ঐক্যের আহ্বান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা ইসলামের সাথে বাকি বিশ্বের সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়। ইসলামের মৌলিক সুশিক্ষা ও বিশ্বাসগত শেকড় থেকে বিশ্বের ইসলামী দেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় তাদের বিরূদ্ধে সোচ্চার এই কণ্ঠ বিশ্বসমাজে সচেতনতা সৃষ্টির প্রতীক। এখনই এটা উপলদ্ধি করার সময়, কেন পশ্চিমা নীতি নির্ধারক ও পরামর্শকদের মধ্যে সভ্যতার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত তত্ত্ব গুরুত্ব পাচ্ছে। এই তত্ত্ব দিয়ে ইসলামের মৌলিক চেতনাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা স্পষ্ট হচ্ছে ইসলামি দেশগুলোর অভ্যন্তরে। মুসলিম বিশ্বের সচেতন মহল ও নেতৃবৃন্দের নিকট এগুলো স্পষ্ট যে, আলকায়েদা, আইএস সৃষ্টির রহস্য কোথায়? কেন কারা ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রগুলোয় সন্ত্রাসী আঘাত হানছে। কারা কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা-কে ইসলামের বিপদ হিসেবে তুলে ধরতে উঠে পড়ে লেগেছে। ইসলামের নামে ইসলামিস্টদের একেকটি অংশকে উগ্রপন্থি বানানোর জন্য উসকে দেয়া হচ্ছে। যেসব দেশে এ প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে সেখানে জঙ্গিবাদ দমনের নামে আভ্যন্তরীণ রণক্ষেত্র বানানো সহজ হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে গৃহযুদ্ধ।
এছাড়াও তথাকথিত আইএস’র মুখপত্র দাবিক-এ প্রকাশিত আইএস’র বেঙ্গল শাখা প্রধানের সাক্ষাতকারে বাংলাদেশকে ঘাঁটি করে মিয়ানমার ও ভারতে অভিযান চালানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ দৃশ্য কত ভয়াবহ হতে পারে তা উপলদ্ধি করে সচেতন হওয়া দরকার সকলের। এক্ষেত্রে পশ্চিমা নীতি কুশলী পেট্রাউসের ‘সভ্যতার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’ তত্ত্বের কথা স্মরণে রেখে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব পরিহার করতে হবে ইসলামী দেশগুলোর। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন যে অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার সংকটে পড়েছে তা থেকে উত্তরণে সমঝোতা, সহাবস্থান ও ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ইসলামি সম্মেলন সংস্থার নতুন চেয়ারম্যান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের ইসলামিক ঐক্যের আহ্বান এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া হবে মুসলিম বিশ্বের শান্তি, অগ্রগতি এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলনের সার্থকতা।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সশযধহধস.ৎঁ@মধসরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন