মীর আব্দুল আলীম : সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার একটি শিরোনাম ছিল ‘ত্রিপুরায় রেল বিপ্লব’। একই দিনে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ছিলো ‘ভাড়া বৃদ্ধি না রেল ধ্বংসের ষড়যন্ত্র’ এবং ‘৫৬ রেল স্টেশন বন্ধ’। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনটি ছিলো এমন ‘প্রতীক্ষার অবসান। অবশেষে ব্রডগেজ রেল ইঞ্জিন আগরতলাতেই নয় বিশালগড়ের মাটি স্পর্শ করিল প্রচ- গণ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়া। ত্রিপুরার রেলের ইতিহাসে এই দিনটি উল্লেখযোগ্যভাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে। আজ যখন রাজ্যে ব্রডগেজ রেল একেবারে বিশালগড় পর্যন্ত পৌঁছিয়া গিয়াছে তখন তাহার আনুষ্ঠানিক সূচনায় কেন্দ্রের রেল রাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অংশ নিবার ঘটনাও ঐতিহাসিক সন্দেহ নাই। রেলের জয়যাত্রার ইতিহাস ত্রিপুরায় নবযুগের সূচনা করিবে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।’ বাংলাদেশের পত্রিকায় যা ছেপেছে ‘এখন থেকে প্রতিবছরের শুরুতেই রেলের ভাড়া বাড়ানো হবে। কিন্তু বাড়বে না সেবার মান। ক্রমাগত লোকসান কমাতে এবং এডিবির ঋণ শর্তের কারণে সরকার রেলের ভাড়া প্রতিবছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। চলতি বছর বাড়া বাড়বে গড়ে ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং আগামী ফেব্রুয়ারি থেকেই তা কার্যকর হবে। প্রতিবছরই ভাড়া বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তে স্পষ্টই বোঝা যায় রেলকে পরিবহন ব্যবস্থায় একটি প্রতিকূল প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন এটা কি রেলকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা? সেবার মান না বাড়িয়ে একমাত্র ভাড়া বাড়িয়ে রেলের লোকসান কমানোর সরল অঙ্ক কর্মকর্তারা কষতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিবছর ভাড়া বাড়ছে। সেবার মান কমছে। এ অবস্থায় ৫৬টি রেল স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। রেলে সেবার মান না থাকলে অব্যবস্থাপনা থাকলে, বাড়তি ভাড়ায় মানুষ কেন রেলে চড়বেন?’
বিষয়টি কি দাঁড়ালো? কোথায় ভারতের রেল বিভাগ, কোথায় বাংলাদেশের রেল বিভাগ? দিনদিন এগিয়ে যাচ্ছে ভারতের রেল বিভাগ। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশের রেল বিভাগ পিছিয়ে যাচ্ছে। অথচ সড়ক নয়, নৌপথ নয়, আকাশ পথও নয়; বাংলাদেশের পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি সম্ভাবনার সেক্টর হলো রেলওয়ে। এর পরও রেল বিভাগ কি ভ্রমণে অধিকতর উন্নত সেবা এ দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে? দীর্ঘ সময়ে ঘটেছে কি রেলের আধুনিকায়ন? কেবল পত্রপত্রিকায় রেলের আধুনিকায়ন এর উন্নয়নের খবর পড়ি। সম্প্রতি রেলের আধুনিকায়ন এবং নতুন ইঞ্জিন-বগিযুক্ত হবে বলে পত্রিকায় জেনেছি। ফি বছর ধরেই শুনছি রেলের উন্নয়নের কথা। এদেশে রেল যোগাযোগ কতটা উন্নত হয়েছে?
আন্তর্জাতিক অটোমোবাইল লবি এবং দেশের লুটেরা ধনিকগোষ্ঠীর কুপরামর্শে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ে চরম অবহেলিত। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে রেল নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। আজও মতলববাজ দেশি-বিদেশি পরামর্শকরা নতুন প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাজির হয় এবং ঋণ দেয়ার নামে শর্ত হিসেবে আত্মঘাতী তথাকথিত সংস্কার সরকারকে গলাধঃকরণে বাধ্য করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এ জাতীয় প্রচেষ্টাগুলোকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছি। ফলে নিত্যনতুন সংস্কারের নামে রেলওয়ে দিনদিন সংকুচিত হয়েছে, দক্ষ জনবল হারিয়েছে, শূন্যস্থান পূরণে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। এমনকি চালু লাইনগুলোকে নিয়মিত সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতার পরে একমাত্র ব্যতিক্রম বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে নতুন রেললাইন স্থাপন। যেখানে সরকারের প্রতিমাসে এ খাত থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় আসার কথা সেখানে কেন রেল বিভাগকে লোকসান গুনতে হয় ফি বছর। রেললাইন ও বগির সংখ্যা বৃদ্ধির বদলে সংকোচন, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শ্লথ গতি, অদক্ষতা আর অনিয়মে ভরা আমাদের এ বিভাগটি। অব্যবস্থাপনার কারণে এ দেশে মানুষ তেমন একটা রেলেগাড়িতে চড়ে না; চড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কেন চড়ে না; চড়তে কেন ভাললাগে না তা সবারই জানা। রেল মানে বিলম্ব; রেল মানে বিরক্তিকর এক পরিবহন ব্যবস্থা। রেলওয়ে এখন দেশবাসীর কাছে লেটওয়ে! অথচ বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি সম্ভাবনাময় খাত। শুধু অধিক যাত্রী নয়, রেল পথে পণ্য পরিবহনও সহজসাধ্য। সড়ক পথের যানজট এড়িয়ে স্বল্প ভাড়ায় অধিক পণ্য পরিবহন করলে পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে। সড়কপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে রেলপথে সে তুলনায় অনেক কম দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়। এ সমস্ত কারণে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পর্যটকরাও রেলপথে ভ্রমণকে নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন মনে করেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের রেল ব্যবস্থা অনেক উন্নত। সেখানকার ৭০ ভাগ লোক কোন না কোনভাবে রেলে চড়ে যাতায়াত করেন। তাই ভারতের রেল বিভাগ অনেক লাভজনক। সময় বাঁচে; অর্থ বাঁচে আর ঝুঁকিও কম তাই ভারতে সবাই রেলে চড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমাদের দেশে পুরটাই উল্টো।
আসলে আমাদের দেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা যাতে উন্নত না হয় এজন্য আন্তর্জাতিক একটি চক্র দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ স্বার্থে এরা এ দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হতে দিচ্ছে না। সুখের বিষয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রেল যোগাযোগ উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাস্তবায়ন হলে দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় সাফল্য আসবে বলে মনে হচ্ছে। বিলম্বে হলেও সরকার সম্প্রতি রেল ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ও অর্থ বরাদ্দ করেছে। সরকারের নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রেল যাতায়াত ব্যবস্থাতেও যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হবে। রেলে যাতায়াত সহজ ও খরচ কম। এ কারণে গরিব মানুষ এখনো রেলে যাতায়াত করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পকেট কেটে টাকা নেয়ার ব্যবস্থা করতে এদেশে রেল পথের পরিবর্তে সড়কপথকে পরিকল্পিতভাবে শক্তিশালী করা হচ্ছে। সেখানে ভাড়ার ক্ষেত্রে কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ করবে কারা? যারা নিযন্ত্রণ করার কথা তারা নিজেরাই পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
এদেশে রেল যোগাযোগ ভালো হলে যা হবে-
১) যাত্রী সাধারণ কম ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারবে, ২) যানজট কম হবে, ৩) যোগাযোগের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় কমে আসবে, ৪) দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৪ ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে, ৫) বিদেশ থেকে কম ডিজেল আমদানি করতে হবে, ৬) পরিবহন আমদানি কমবে, ৭) সড়ক পথের যানজট এড়িয়ে স্বল্প ভাড়ায় অধিক পণ্য পরিবহন করলে পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকবে। পাঠক নিশ্চয়ই আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে তা সম্ভব? একটি ডিজেলচালিত লোকোমটিভ ট্রেন ইঞ্জিন একসঙ্গে বিশ থেকে ত্রিশটি বগি টানতে পারে। প্রতিটি বগিতে ৪০ জন যাত্রী বসলে (দাঁড়ানো ছাড়া) চল্লিশটি বগিতে ১৬০০ যাত্রী একসাথে বহন করতে পারে। অর্থাৎ একটি ট্রেন প্রায় ৪০টি বাসের সমপরিমাণ যাত্রী বহন করতে পারে। ১ শ’ কিলো মিটার পথ যেতে একটি বাসের ৬০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন হলে ৪০টি বাসের ডিজেল লাগবে ২ হাজার ৪ শত লিটার। পক্ষান্তরে একই পথ যেতে ১৬০০ যাত্রী বহনকারী ট্রেন ইঞ্জিনের প্রয়োজন হবে ৯ শত লিটার তেল। যা বাসের তুলনায় ৩ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এর পরও আমাদের রেল লাভজনক নয় কেন? রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এককালীন ব্যয় হয় বেশি। কিন্তু একবার রেল পথ তৈরি করে নিলে তা দীর্ঘ দিন চলতে থাকে। একটি রেল ইঞ্জিন ক্রয় করার পর তা চলে অনেক বছর ধরে। রেলের বগির ক্ষেত্রেও তাই। একবার তা কেনা হলে সহজে নষ্ট হয় না। তার পরও কেন আমাদের রেল ব্যবস্থা এমন নাজুক ?
দাতারা রেলওয়েকে কখনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, কখনো সরকারি অধিদফতর, কখনো বোর্ড, কখনো কর্পোরেট বডি আবার কখনো বা মন্ত্রণালয়/ডিভিশন নামে পরিচালনা করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। বর্তমানে রেলওয়ে একটা অথরিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যার শীর্ষে রয়েছেন একজন মন্ত্রী। এ অথরিটির পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্যের মধ্যে অর্থ সচিব, যোগাযোগ সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, ডিজি রেলওয়ে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়াও বেসরকারি শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। এই রেলওয়ে অথরিটি আপাতদৃষ্টিতে খুবই হাই পাওয়ার্ড এবং শক্তিশালী বলে মনে হয়। তারপরও তাদের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে কি অসুবিধা হচ্ছে, এটা কি প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা, না ব্যক্তিগত সমস্যা এগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। পূর্ণ মন্ত্রণালয় বা ডিভিশন হলে নতুন কি হবে বা তাতে পার্থক্য কি হবে এটাও পরীক্ষা করা দরকার। সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনা। আমাদের বিবেচনায় বাংলাদেশে পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি সম্ভাবনার সেক্টর হলো রেলওয়ে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি হয়েছে, তাতে বিদেশি সাহায্য ছাড়াই আমরা রেলওয়ের উন্নয়নে অনেক কিছুই করতে পারি। বিশেষ প্রয়োজনে সাহায্য যদি নিতেই হয়, সেটা আমাদের শর্তেই নেব, দেশের স্বার্থে নেব। দাতাদের শর্ত ও স্বার্থের দিকে তাকিয়ে নয়। এ জন্য প্রয়োজন হবে আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি এবং স্বনির্ভরতা অর্জনের মানসিকতা। নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, রেলওয়ের শত বছরের অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহ্য, প্রতিবেশী দেশ এবং আধুনিক বিশ্বের নিত্যনতুন পরিবর্তন বিবেচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন সরকারের উচিত জনগণকে আস্থায় নেয়া, মুক্ত আলোচনা করা, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে মতবিনিময় করা এবং এর মাধ্যমে একটি দক্ষ এবং যুগোপযোগী রেলওয়ে গড়ে তোলা। দেশে রেলওয়ে এবং যোগাযোগ বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ লোক রয়েছেনÑযাদের পরামর্শ, অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-চেতনা কাজে লাগানো যেতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং রেলওয়ের অগ্রগতি ঘটাতে হলে রেল খাতে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন। এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে এর অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
হবংিংঃড়ৎব১৩@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন