শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে নানা বিতর্ক

প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আহমেদ জামিল : প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান ও পরীক্ষা নিয়ে বিতর্ক সূচনালগ্ন হতেই চলে আসছে। তবে সম্প্রতি এই বিতর্ক নতুনভাবে ব্যাপক পরিসরে শুরু হয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘সৃজনশীল পদ্ধতির নামে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে বলে অনেকেই অভিমত পোষণ করেছেন। ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, সৃজনশীল পদ্ধতি ভালো হলেও এর প্রয়োগ ঠিকভাবে হচ্ছে না। বরং এই পদ্ধতি প্রবর্তনের পর শিশুদের পাঠ্যবইয়ের বোঝা বেড়েছে। বইয়ের ব্যাগের চাপে ওদের নুয়ে পড়তে হয় বলে নাভিশ্বাস উঠছে।’ এদিকে রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন (রেইস) শীর্ষক জরিপে আরো জানানো হয়েছে, মোট শীক্ষার্থীর এক-চতুর্থাংশই পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে অক্ষম এবং তাদের কাছে কঠিন মনে হয় বিশেষত গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়। এই জরিপ রিপোর্টে আরো বলা হয়, শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশই গাইড বইনির্ভর। ওদের দুই-তৃতীয়াংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহশিক্ষকের সাহায্য নিচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের ৪৫ শতাংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন এবং তাদের ৪২ শতাংশ অল্প অল্প বুঝতে পারেন। বাকি ১৩ শতাংশ এই পদ্ধতি বুঝতেই পারেননি। আবার যারা বুঝতে সক্ষম, সেসব শিক্ষকের অর্ধেক পড়ানোর জন্য গাইড বইয়ের দারস্থ হয়ে থাকেন। অন্যদিকে গত জানুয়ারি মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মনিটরিং শাখার ‘একাডেমি তদারকি প্রতিবেদন’ জানিয়েছে, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। তাদের মধ্যে ২২ শতাংশ শিক্ষকের অবস্থা খুবই নাজুক। বাকিরা এ সম্পর্কে যে ধারণা রাখেন, তা দিয়ে আংশিক প্রশ্নপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। আর উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও প্রায় একই চিত্রের সন্ধান মিলেছে।
বলা চলে, কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য ও মূল্যায়ন না করে, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া এবং গোটা দেশের তৃণমূল স্তরের শিক্ষার্থীদের মেধা ও ধারণ ক্ষমতার বাস্তব দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়ে অনেকটা তড়িঘড়ি করে যুগোপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি চালুর নামে ২০০৮ সালে দেশে মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। এ লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ১৮ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। ২০১০ সালে বাংলা ও ধর্ম বিষয়ে এ পদ্ধতিতে প্রথম এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হয়। এরপর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দু-একটি বিষয় ছাড়া বেশির ভাগ বিষয় সৃজনশীল পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। সরকারের বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ হতে প্রচার করা হয়, শিক্ষার্থীদের মুখস্ত বিদ্যা পরিহার, গাইড বই ও কোচিংনির্ভরতা কমানোর জন্যই এই সৃজনশীল পদ্ধতি।
আর বাস্তবে এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতিকে চার অংশে ভাগ করা হয়েছে। জ্ঞান, অনুধাবন প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা। প্রতি প্রশ্নের মোট নম্বর ১০। সত্যি বলতে কী একজন পরীক্ষক জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তর সঠিক হলে নম্বর কাটতে পারেন না। অন্যদিকে প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নের উত্তর সঠিক হলে সেখানেও নম্বর কাটা কঠিন। যে কারণে একজন পরীক্ষার্থী ১০ নম্বরের মধ্যে ৮ কখনো বা ৯ নম্বরও পাচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে তথাকথিত মেধাবীর সংখ্যা। কারণ গোল্ডেন জিপিএ কিংবা জিপিএ ৫ পেলেও শিক্ষার মান বাড়ছে না। দুর্বল থেকে যাচ্ছে শিক্ষার ভিত্তি। এ কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গিয়ে এসব মেধাবী বেশির ভাগ নাকানিচুবানি খাচ্ছে। ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে এদের যে কী হবে জানা নেই।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা দরকার তা হলো, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে গিয়ে শিক্ষকরা কতটা সৃজনশীল হতে পেরেছেন সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে। সৃজনশীল প্রশ্নে যে উদ্দীপক থাকে প্রশ্নের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে তা প্রণয়নের জন্য প্রশ্নকারী শিক্ষকের সমসাময়িক বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও মেধার প্রয়োজন। কোনো কোনো শিক্ষক উদ্দীপকে এমন সব ঘটনা ও বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন, যা বেশির ভাগেরই অজানা থাকে এবং এর নিরিখে প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নসমূহের উত্তর লিখতে শুধু পরীক্ষার্থী নয়, নম্বর দিতে পরীক্ষকদেরও সমস্যায় পড়তে হয়। বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী আনসিন প্রশ্ন বলে কথিত প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নগুলো দায়সারাভাবে লিখে থাকে। কোনো উপায় না থাকায় পরীক্ষকরাও নম্বর দিতে বাধ্য হন।
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, জ্ঞান, দক্ষতা ও মেধার অভাবের কারণে বেশিরভাগ শিক্ষক গাইড বই থেকে প্রশ্ন কপি করে পরীক্ষার কাজ চালিয়ে থাকেন। এ তো গেল সৃজনশীল পদ্ধতির কথা। ৬০ নম্বরের সৃজনশীলের সাথে ৪০ নম্বরের এমসিকিউ পদ্ধতিও চালু রয়েছে। এই এমসিকিউ বা বহু নির্বাচনী প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক ক্রমে জোরদার হওয়ার প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১০ নম্বর কমিয়ে ৩০ নম্বরের এমসিকিউ প্রশ্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রবর্তনের কথা বলেছিল। এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন ঘটেনি। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের প্রশ্ন পদ্ধতিতে যে বিজ্ঞানসম্মত পন্থা অনুসরণ করা হয় তা বাংলাদেশে মোটেই অনুসরণ করা হয় না। যে কারণে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মতে পদ্ধতিটি ভালো হলেও সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাওয়া যায়নি।
মুখস্ত প্রবণতা কমিয়ে পুরো বই ভালো করে অধ্যয়নের ওপর গুরুত্বারোপের চিন্তা থেকে এ পদ্ধতি চালু করা হলেও সঠিক প্রশ্ন প্রণয়নের অভাবে মূলত শিক্ষার্থীরা মুখস্ত করেই এমসিকিউর উত্তর দিয়ে থাকে। এমসিকিউ পদ্ধতির কারণে শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকদের একাংশের মধ্যেও দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রবণতা বাড়ছে। কেবল মুখে নয়, আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েও পরীক্ষার্থীকে জানিয়ে দেয়া হয় কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর কোন স্থানে গোল চিহ্ন দিয়ে পূরণ করতে হবে। যে কারণে প্রশ্নপত্রের সৃজনশীল অংশে ৬০-এর মধ্যে ৫ থেকে ১০ নম্বর পেয়েও ওই পরীক্ষার্থী এমসিকিউ বা বহু নির্বাচনী অংশে ৪০-এর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ নম্বর পাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি ও নৈরাজ্যকর দিক বলে বিবেচিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে গত ২২ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘এমসিকিউ পদ্ধতির ২৫ বছর বহাল রাখা নিয়ে বিতর্ক’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “শিক্ষকরা জানিয়েছেন, এমসিকিউ পদ্ধতির কারণে ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে গেছে। বাস্তবে দেখা গেছে ক্লাসে একজন শিক্ষার্থীর ভালো পারফরম্যান্স না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক পরীক্ষায় সে ভালো রেজাল্ট করছে। সহজে পাস করতে পারা, পাসের হার বৃদ্ধি এবং অধিক নম্বর পেলেও শিক্ষার্থীদের মানের উন্নতি হয়নি এ পদ্ধতিতে। মানের বরং অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।” আগেই উল্লেখ করা হয়েছে মুখস্ত বিদ্যা নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি কোচিং ও গাইড বইনির্ভরতা কমানোর জন্য সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া তো দূরের কথা বরং বিপরীতটিই ঘটতে দেখা যাচ্ছে বেশি করে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কারণে কোচিং ও গাইডনির্ভরতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো বেড়ে গেছে। যে কারণে গাইড বই এবং কোচিং ব্যবসার এখন রমরমা অবস্থা। এমনকি শিক্ষকদের কেউ কেউ নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে ক্লাসে পাঠদান এবং প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গাইড বই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এ প্রবণতা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত। অন্যদিকে গণিত এবং ইংরেজি বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি বহালের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কোনো কোনো শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ। শিক্ষার্থীদের বড় অংশের কাছে দীর্ঘদিন ধরে এই দু’টি বিষয় আতঙ্কের কারণ হয়ে রয়েছে। তার ওপর সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন আরো হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
দেশের শিক্ষার বাস্তব পরিস্থিতির কথা বিবেচনা না করে খামখেয়ালি পন্থায় সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু এবং কৃত্রিমভাবে পাসের হার বেশি দেখানোর হীনউদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টারগুলোকে দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে। সত্যি বলতে কী, সৃজনশীল পদ্ধতির নামে বর্তমানে যা চলছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাসের হার আগের চেয়ে বাড়লেও প্রকৃত শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে উঠছে না। বাড়ছে না শিক্ষার মান। এটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সৃজনশীল শিক্ষার নামে কার্যত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তথাকথিত সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে একজন শিক্ষক স্বাভাবিক পন্থায় পাঠদান করতে পারছেন না শ্রেণিকক্ষে। স্বীকার করা হচ্ছে যে, যুগের পরিবর্তনের সাথে শিক্ষা ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে থাকে। তবে সে পরিবর্তন হতে হবে দেশের শিক্ষা জগতের বাস্তবতার বিষয়গুলো মাথায় রেখে।
য় লেখক : কলামিস্ট
লধসরষ২০১৩১২@ষরাব.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
মুক্তার ১০ মার্চ, ২০১৭, ১০:২৬ এএম says : 0
শিক্ষা পারে উন্নত গ্রাম গরতে
Total Reply(0)
সনজদ ১৪ মার্চ, ২০১৭, ৯:৩৫ পিএম says : 1
সত্ত তবে সত্য
Total Reply(0)
রবিউল ইসলাম ২ মে, ২০১৭, ১১:৪৫ পিএম says : 0
এক দম সঠিক কথা লিখা হয়েছে...আগে যতোটা পড়ার আগ্রহ পেতাম এখন তার এক-অংশ পাইনা..শুধু আমি একানা সবার একই হাল...শুধু কিছু ছাত্র গাইড মুখস্ত করে পরিক্ষায় পারছে আর বাকিরা মাথাই হাত দয়ে শিক্ষকের বকুনি খাচ্ছে
Total Reply(0)
Sk. Emran Hossen Badsha ২৫ জুলাই, ২০১৮, ২:৪০ পিএম says : 0
এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন আমার মতে সৃজনশীল পদ্ধতিটাই সব থেকে উন্নত মাধ্যম
Total Reply(0)
Rafius sadek ২৭ জানুয়ারি, ২০১৯, ৩:১৫ পিএম says : 0
Right
Total Reply(0)
Mariya Sultana ২৩ জানুয়ারি, ২০২০, ৩:৫৬ পিএম says : 0
গন্ডিমাত্র মানসিকতার নামন্তর?? এই প্রশ্নের উত্তর টা যদি দিতেন
Total Reply(0)
Selim ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:২৯ পিএম says : 0
RIGHT
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন