শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

রাষ্ট্র যখন অসুস্থ হয়

প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হারুন-আর-রশিদ
একটি রাষ্ট্র যখন নানা রোগে ভোগে, তখন সেই রাষ্ট্রের বসবাসরত মানুষগুলো ভালো থাকতে পারে না। এ প্রবাদ বাক্যটি মহামনীষীদের, যা চিরন্তন সত্যরূপে বিবেচিত হাজার বছর ধরে। বাংলাদেশ বহুদিন ধরে নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। এ নিয়ে সম্প্রতি একটি টিবি চ্যানেল ধারাবাহিক অনুষ্ঠানও প্রচার করেছে। তারা সত্য উন্মোচন করার দায়বদ্ধতা অনুধাবন করতে পেরেছে বলেই এ ধরনের একটি বাস্তবধর্মী অনুষ্ঠান জ্ঞানীগুণীদের নিয়ে করার জন্য তাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়। রাষ্ট্রের রোগ যদি নির্ণয় বা নির্ধারণ করা না যায়, তাহলে প্রেসক্রিপশন করলেও তা প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে না। বিগত ৪৫ বছরে দেশের চিকিৎসা অনেকটা অপচিকিৎসা হয়েছে বলেই রাষ্ট্র তার মেরুদ- শক্ত করতে পারেনি। আমি যে কথাটি প্রসঙ্গের আলোকে বলতে চাই, রাষ্ট্রের মৌলিক জাতিগত সত্তা ও ভিত্তি যদি অটুট না থাকে তাহলে রাষ্ট্র বার বার অসুখে আক্রান্ত হবে। শেষ চিকিৎসা কোরামিন দিয়ে কোনো রোগীকে বাঁচানো যায়নি।
আমার এক পরিচিত কিডনির ডায়ালাইসিস রোগীকে ধানমন্ডি বড় একটি হাসপাতালে ভর্তি করার দিন দুয়েক পরই মারা যান, কারণ অপচিকিৎসা। তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোরামিন ইনজেকশনটি তার শরীরে পুশ করা হয়েছিল। তার ঘণ্টাখানেক পরই না ফেরার দেশে মাত্র ষাট বছর বয়সে চলে গেছেন তিনি। এর নাম হলো অপচিকিৎসা। পরে ডাক্তাররা স্বীকার করেছেন তাদের অজ্ঞতার কথা। আমাদের রাষ্ট্রের যারা রক্ষকÑতারা যদি ভুল করেন, তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কোনোভাবেই সুস্থ থাকতে পারে না। ফলে জাতিও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভুগবে। দেশের বয়স ৪৫ একেবারে কম নয়। এই বয়সে এশিয়ার বহু দেশ মাথা পিছু গড় আয় ২০ থেকে ৩০ হাজার মার্কিন ডলারে পৌঁছে গেছে। আর আমরা ১৩৫০ মার্কিন ডলার মাথা পিছু আয় নিয়ে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত করছি। এটা নাকি বাংলাদেশের বড় অর্জন। নেতাদের মুখ থেকে এসব কথা শুনলে হাসব না কাঁদবো তা নিজেও তৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি।
বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার বা তার চেয়ে কিছু বেশি মানুষের গড় আয় দিয়ে দেশের সব মানুষের গড় আয় নির্ধারণ করা যৌক্তিক নয় বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। অথচ, বাংলাদেশ সরকার সেরকম একটি মাথাপিছু গড় আয় নির্ধারণ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর দিচ্ছেনÑ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমজনতার সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে। বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান অর্থনীতির একটি মাত্র সূচক নিয়ে (বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে) এরকম উচ্চ-বাচ্য করেছেন বা করেন বলে কখনো শুনিনি। শেয়ারবাজারের অফিসপাড়া মতিঝিলে কোনো ব্রোকার হাউজে গেলে বোঝা যাবে বাংলাদেশ পুঁজি বাজারের বেহাল দশা কত প্রকার ও কী কী হতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে ৮টি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অর্ধশতাধিক বেসরকারি ব্যাংকÑতাদের পায়ের তলার মাটি আছে বলে মনে হয় না। এরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর টাকা লুটপাট করে এখন নিজেদের তহবিলের টাকাও সাবাড় করছে। পুঁজিবাজারে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা এখন বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাতেও সংক্রমিত। সবাই আর্থিক খাতের এসব শেয়ার ক্ষতি স্বীকার করে বাধ্য হয়ে মাত্র ২৫ শতাংশ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার চিন্তাভাবনা করছে। এই দৃশ্য আমার চোখে দেখা। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন দেখবে বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব আর্থিক প্রথিষ্ঠানে হরদম লুটপাট চলছে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়ে আস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন তারা কোন ভরসায় বাংলাদেশে টাকা বিনিয়োগ করবে। যেখানে পুঁজি গচ্ছিত রাখবে সেটা যখন অরক্ষিত। এ অবস্থায় দেশে বিনিয়োগ কীভাবে হবে। বেসিক ব্যাংক, জনতা, রূপালী, সোনালী, অগ্রণী, শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিট্যান্সের টাকা চুরির ঘটনাও ঘটেছে। এ টাকা এদেশের শ্রমজীবী মানুষের শ্রম বিক্রির টাকা, সরকারের টাকা নয়। যে রাষ্ট্র এসব চুরির পথ বন্ধ করতে পারে না তাদের সংসদে বিলাসী স্টাইলে বসে উন্নয়নের ফর্দ বয়ান করা অযৌক্তিক বলেই আমরা মনে হয়। রাষ্ট্রের অর্থের উৎস হলোÑ জনগণের ট্যাক্সের-ভ্যাটের মূসকের টাকা। কিন্তু এর মালিক সরকার নয়, জনগণ। সেই জনগণের টাকা যারা পাহারা দিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয় তাদের বড় গলায় কথা বলা একেবারেই শিশুসুলভ। রাষ্ট্রের অর্থ যারা রক্ষণাবেক্ষণ বা যথাযথভাবে তদারকি তথা নীরিক্ষার মাধ্যমে নিরাপদে রাখতে না পারে, তাদের কি বলা যায়? অর্থমন্ত্রীই সেই জবাব দিয়েছেন, দেশে পুকুরচুরি নয়, একেবারে সাগরচুরি হচ্ছে।
রাষ্ট্রের মূল অসুখ হলো অর্থের অনর্থ ব্যয়। এটাই দেশে সবচেয়ে বড় অমঙ্গল ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রের বড় অসুখের মূল হোতা রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রের এই বড় ব্যাধির দায় তাদের নিতেই হবে। বঙ্গবন্ধু বড় দুঃখ করে বলেছিলেন, আমি ভিক্ষা করে বিদেশ থেকে টাকা আনি আর আমার দলের চাটার দলেরা সব খেয়ে ফেলে। প্রথম আলো, ২৫ জুন ১৬ সোহরাব হাসান তার “কিছুতে নেই বিএনপি, সবকিছুতেই আওয়ামী লীগ” শীর্ষক এক নিবন্ধে এ কথাটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের সবাক চিত্রগুলো জাতি দেখতে চায়। অনেক সত্য কথা তিনি বলেছিলেন। এ কারণে মঞ্চে তিনি অমর হয়ে আছেন জাতির হৃদয়ের চিত্তে। শুধু ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে আবদ্ধ রাখার অর্থই হলোÑতার শাসনামলকে অবজ্ঞা করা। একজন মানুষের পুরো জীবনটা নিয়ে আলোচনাই তার পরিপূর্ণতা লাভ করে। ১৯৫৬-৫৮ সালে এবং স্বাধীনতার পরবর্তী ’৭২-৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শাসন ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ছিলেন। তার এই সময়কালের সত্য ভাষণ বা কথনগুলো বিস্তৃতভাবে জনগণকে জানানো হচ্ছে না। এর অর্থ হলোÑকোথাও গোলমাল আছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা-উত্তর যে বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছিল তা দিয়ে আরেকটি বাংলাদেশ গড়া যেত। আর ইধহমষধফবংয রং ধ নড়ঃঃড়সষবংং নঁংশবঃ. এই উক্তিটি করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এ কথা অস্বীকার করেনি মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (সূত্র দৈনিক বাংলা, হক কথা, গণকণ্ঠ ’৭২-’৭৫)। দেশকে ভালোবাসলে এসব কথা বিবেক থেকে চলে আসে। বঙ্গবন্ধু রাশিয়া থেকে আনা ৮ কোটি কম্বলের মধ্যে নিজের কম্বলটি পাননি।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, সততাই শক্তি। সততা দ্বারা সবকিছুই জয় করা যায়। অতিমূল্যবান কথা। হয়তো প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করতে পেরেছেন নিজের পরিচালিত সরকারের মধ্যে কিছু ভুলভ্রান্তি হচ্ছে। সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তো এমপিদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে খোলাখুলিই বলে ফেলেছেন আসল কথাটি। যদিও তিনি সে কথার উপর আর নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে, সংসদে চাইতে হয়েছে ক্ষমা! যাইহোক, আমরা চাই সরকারের প্রতিটি মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। তাহলেই রাষ্ট্র তার মূল ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পাবে। রাষ্ট্রের দোষ নেই। রাষ্ট্র জড় পদার্থ। রাষ্ট্র নির্বাক। আমরা রাষ্ট্রকে যেভাবে চালাই রাষ্ট্র সেভাবে চলে। রাষ্ট্রের নানা ব্যাধির জন্য মূলত আমরাই দায়ী।
আরেকটি অসুখ বাংলাদেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে সেটা হলোÑজাতিগত বিভাজন। বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে সেটা স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কোনো শাসক আর ধরে রাখতে পারেননি। বিভাজন তৈরি করাই যেন এখন রাজনীতি। এই ধারা এতটাই গতিময় রূপ ধারণ করেছেÑশেষ পর্যন্ত সেই রাজনীতির হিংসাত্মক পরিণতি আমরা দেখতে পাচ্ছি জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কাজনক বৃদ্ধির মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব, এ ব্যাপারে আপনার উদ্যোগটাই দেশটাকে রক্ষা করতে পারে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেশের একমাত্র স্বার্থে সহিংসতা এবং জঙ্গি তৎপরতা বন্ধের জন্য খোলা মন নিয়ে আপনি এগিয়ে আসুন।
উদারতা মহত্ত্বের লক্ষণ। বড় হতে হলে ছোট হতে হয়। রাষ্ট্রের স্বার্থে ছোট হওয়া এটা বিরাট অর্জন। আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই কাজটি করলে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হবে। জনগণ অসুস্থ রাষ্ট্র চায় না। আমি আমার এই নিবন্ধে বাংলাদেশের দুটো অসুখের কথা বলেছি। একটি হলো দুনীর্তি (অর্থ লুটপাট), অন্যটি হলো জাতিগত বিভেদÑ এই দুটো রোগ ৪৫ বছর ধরে দেশটাকে অসুস্থ করে রেখেছে। গোটা প্রশাসনযন্ত্রকে অসুস্থ করে রেখেছে। আর এর পুরো মাসুল দিতে হয়েছে দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে। রাষ্ট্রের এই অসুস্থতার কারণে পুরো ভোগান্তির শিকার হচ্ছে দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ার কারিগরও বটে। এই নিরীহ মানুষগুলোকে কষ্ট দিলে, আর আল্লাহর দরবারে তাদের ফরিয়াদ কার্যকর হলে আরেকটি ভয়াবহ বেদনাদায়ক অবস্থার সৃষ্টি হবে। আল্লাহপাক তার পবিত্র গ্রন্থে বলেছেন, পৃথিবীতে যা ঘটে তা মানুষের কর্মফল। আরো বলেছেন, সীমা লঙ্ঘন করলে শাস্তি থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। ফেরাউন পায়নি, নমরুদ পায়নি, আবু লাহাব, লূত জাতি, আবু জাহেল কেউই পরিত্রাণ পায়নি। কঠিন শাস্তি দুনিয়াতেই তাদের পাকরাও করেছিল।
আরেকটি কথা বলব, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা জীবন জেল খেটেছেন, রাজনীতি করেছেন পাকিস্তান আমলে। তাই বলব, রাষ্ট্রের তৃতীয় অসুখটিও সারাতে হবে। জনগণের ভোটাধিকারকে দলিত-মথিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটে না। ঘটতে পারে না। বরং মুক্তিযুদ্ধকে আজ নির্বাচনের বিপরীতে দাঁড় করানোর কারণেই স্বাধীনতা বিরোধীরা উল্লসিত। এটাও কিন্তু ভেবে দেখতে হবে।
য় লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন