শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

এখন সময় দেশ নিয়ে ভাবার

প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
দেশের রাজনীতি এক জায়গায় স্থির থাকছে না। রাজনীতি ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছে। গুলশান ট্র্যাজেডির পর খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক দেশের রাজনীতি একটি সুস্থ ধারা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু অর্থপাচার মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা ঘোষণার পর, রাজনীতির গতি প্রকৃতি হয়ে উঠছে ভিন্ন রকম। একে কেন্দ্র করে সামনে হয়তো রাজনীতিতে নতুন ডাইমেশনও দেখা যেতে পারে। আসলে দেশে কোনো সুস্থ রাজনীতি নেই, চলছে অসুস্থ রাজনীতির প্রতিযোগিতা। বাস্তবে এর কুফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজ ও রাষ্ট্রে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষিত ও মেধাবীরা! অসুস্থ রাজনীতির কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে না এলে তা রোধ করা সম্ভব নয় বলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দৃশ্যত শিক্ষিত ও মেধাবীরা যদি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ে, তারা যদি আত্মঘাতী হয়ে উঠে, জীবন দিতে প্রস্তুত হয়Ñতাহলে কোথায় যাবে রাজনীতি, কোথায় যাবে দেশ; কোথায় যাবে দেশের নিরাপত্তা। এসব ভাববার সময় এখন এসেছে, এখন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, গলা ফাটিয়ে উল্টাপাল্টা বক্তৃতা দেয়ার সময় নয়। এখন সময় দেশ নিয়ে ভাববার।
আমরা চাই না দেশের সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে যাক। আমরা এও চাই না দেশের সবাই বিএনপির হয়ে যাক। আমরা চাই ভারসাম্যের রাজনীতি। কেননা দেশটা একেবারে আওয়ামী লীগের হয়ে গেলেও বিপদ, বিএনপির হয়ে গেলেও বিপদ। গত ইউপি নির্বাচনে এই বিপদের কিছুটা আলামত আমরা দেখতে পেয়েছি। ১৯৭৪-৭৫ সালেও আমরা দেখেছিÑরাজনীতিতে ভারসাম্য না থাকলে কী হয়। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তবে ইতিহাসের শিক্ষা হলো এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
জঙ্গিবাদ চলমান পৃথিবীতে একটি মহা আতঙ্কের নাম। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো জঙ্গিবাদের উত্থান রোধে সর্বশক্তি নিয়ে নেমে আছে মাঠে, খরচ করছে হাজার হাজার কোটি ডলার; ব্যবহার করছে গোলা-বারুদ ও অত্যাধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র। এক কথায় জঙ্গি শব্দটি শুনলেই তাদের বিশ্ব রাজনীতির কৌশল বদলে যায়, থমকে যায় তাদের চিরাচরিত কূটনীতি; মুহূর্তেই শক্র হয়ে যায় তাদের মিত্র, মিত্র হয়ে যায় শক্র।
যুদ্ধাপরাধ ও জঙ্গিবাদÑএ দুটি ইস্যুই বাংলাদেশের রাজনীতিকে করে রেখেছে আউলা-ঝাউলা ও ঘোলাটে। এ দুটি ইস্যুর ওপরই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি। এটি ব্যবহার করেই তারা ক্ষমতার মসনদকে করে রেখেছেন করায়াত্ব। যখনই সুযোগ বা প্রয়োজন হয়, এ দুটি ট্রাম্পকার্ড তারা ব্যবহার করেন প্রতিপক্ষের রাজনীতিকে ঘায়েল করতে এবং এতে তারা সফলও হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পক্ষান্তরে বিএনপির রাজনীতি স্থির দাঁড়িয়ে আছে একই বৃত্তে ও একই জায়গায়। পরিবর্তন অবিশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলেও, এই বৃত্ত থেকে তারা বা তাদের রাজনীতি বেরিয়ে আসতে পারছে না। এ কারণে বারবার তাদের রাজনীতি খাচ্ছে হোঁচট, সাফল্যের দোরগোড়ায় গিয়েও তাদেরকে ফিরে আসতে হচ্ছে প্যাভিলিয়নে। কাজেই বদলাতে হবে রাজনীতি, বদলাতে হবে রাজনৈতিক কৌশল; তৈরি করতে হবে রাজনীতিতে নতুন ডাইমেশন বা নতুন মেরুকরণ, নইলে এই হুজুগের রাজনীতি নিয়ে তলিয়ে যেতে হবে অতল গহ্বরে। হারিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের জনসমর্থন প্রশ্নবিদ্ধ। জনসমর্থনহীন ও নৈতিকভিত্তিহীন একটি দুর্বল সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বড় ধরনের দুর্বলতা। এই দুর্বলতা বিদেশিদের জন্য সৃষ্টি করে দিচ্ছে অবারিত সুযোগ। এই সুযোগটিই তারা নিচ্ছে এবং কাজেও লাগাচ্ছে পরিপূর্ণভাবে। বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে দরকার একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকারের আর সেটি হতে পারে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। গোটা দেশবাসী তা চাইলেও, বিদেশি বেনিয়ারা এটি চাইবে বলে মনে হয় না। কাজেই সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না, আঙ্গুল বাঁকা করেই ঘি তুলতে হবে।
আসলে সংকট উত্তরণের প্রধান উপায় হলো সংকটের অস্তিত্ব স্বীকার করা, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে একটা ভয়াবহ সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে; এ সংকট উপলব্ধি করে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যার যার দায়িত্ববোধ থেকে দেশে একটি জাতীয় ঐক্য গড়া এবং সংকট সমাধানে সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার এই হাত বাড়িয়ে দেয়াকে কোনো আমলে নিচ্ছে না। সরকারকে মনে রাখতে হবে, সুশাসন উপহার দিতে এবং জন-জীবনের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে তারা শুধু ব্যর্থই হয়নি, চরমভাবেই ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতার পাল্লা আরও ভারি করা অনুচিত।
জাতীয় ঐক্য বা সংলাপ-সমঝোতার জন্য বিরোধী জোট অনির্দিষ্টকালের অপেক্ষায় থাকবেÑএমনটি মনে করার কোনো অবকাশ নেই। এটি খালেদা জিয়া বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে ব্যক্তও করেছেন। কাজেই চলমান সময়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের আহ্বানকে দেখতে হবে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে। জাতীয় ঐক্য বা সংলাপ-সমঝোতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে, কেননা তারাই ড্রাইভিং সিটে; তারা রাজনীতিকে যেদিকে নিয়ে যাবেন রাজনীতি কার্যত সেদিকেই যাবে। সরকার জাতীয় ঐক্য ও সংলাপ-সমঝোতা চাইলে হবে, না হয় হবে না; যেমন অদ্য পর্যন্ত হয়নি।
উল্টো ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে রাজনীতি নিয়ে বিপজ্জনক খেলা শুরু হয়েছে। এই খেলার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না, কোথাও কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। অনিবার্য ধ্বংস ছাড়া এই বিপজ্জনক খেলার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে যে সংকট চলছে কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে ছিল না। সমস্যাগুলো সুকৌশলে সৃষ্টি করা হয়েছে; আর এর জন্য দায়ী মূলত সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের মধ্যদিয়ে মূলত সংকটের আবির্ভাব। সরকার একতরফা আদালতের ওপর দায় চাপিয়ে তত্ত্ববধায়ক সরকার বাতিল করেছে। উচ্চ আদালত বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা তাতে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু সরকার আদালতের মতকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি; আর তাতেই সংকটের সূত্রপাত।
মনে রাখতে হবে, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব শক্তিশালী মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনিই হয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর দুর্বলতম মানুষ। আরও মনে রাখতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কখনও থেমে থাকে না; অন্যায়ের জয় হয় না, মানুষের ভেতরে ভেতরে ঠিকই আন্দোলন চলতে থাকে। এক সময় সেই আন্দোলন দৃশ্যমান হয়ে গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। সেই সময় অবধারিত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
এসব কথা ক্ষমতাসীনদের আমলে নিতে হবে। বিপজ্জনক রাজনৈতিক পথ থেকে ফিরে আসতে হবে। খালেদা জিয়ার শান্তি ও জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, অযাচিত শক্তি প্রয়োগ দুর্বলতার প্রকাশ। এভাবে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা যায় না। কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে হলে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে সর্বগ্রাসী সংকটের মধ্যে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই নির্মোহ সত্যটি শাসকদলকে অনুধাবন করতে হবে।
গুলশান ট্র্যাজেডি মানুষের মনকে প্রচ-ভাবে নাড়া দিয়েছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই উপলব্ধি করছে, দেশ একটি সংকট অতিক্রম করছে। এই সংকট এখন প্রান্তসীমায় এসে উপনীত হয়েছে। এখন সবার উচিত দেশ নিয়ে ভাবা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। কেননা দেশটা আমাদের সকলের। আমাদের রাজনৈতিক বিভাজনের সুযোগ নেয়ার জন্য ওঁৎ পেতে আছে দেশি-বিদেশি সুযোগ সন্ধানী চক্র। এটি আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের প্রথম কাজ দেশ নিয়ে ভাবা। এই ভাবনাটা থাকলে, দেশের বিভেদ-বিভাজন দূর হতে বাধ্য। বিভেদ-বিভাজন দূর হলেই, রাজনীতিতে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশ থেকে দূর হবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। দেশ থাকবে নিরাপদ, দেশের মানুষ থাকবে নিরাপদ; বাংলাদেশ পরিণত হবে শান্তির দেশে। রেখে যেতে পারব আমাদের সন্তানদের জন্য একটি সমৃদ্ধ দেশ।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধুবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
liton ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:২৬ এএম says : 0
excellent write up
Total Reply(0)
belayet hossain ২৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:৩৮ এএম says : 0
সময়োপযোগী লেখাটি ছাপানোর জন্য ইনকিলাবকে ধন্যবাদ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন