শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বাংলাদেশে ‘জঙ্গি’ তৎপরতা সমস্যার গভীরে এক নজর

প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় যে জঙ্গি এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সেটা নিয়ে কারো সংশয়-সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। জঙ্গি অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচনায় ছিল। তবে ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজান হত্যাকা-ের পর সবকিছুকে ছাপিয়ে তা শীর্ষ অবস্থান নিয়েছে। এখন অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, বাস-টেম্পো, চায়ের দোকান, এমন কি বাসা-বাড়ির ডাইনিং টেবিলেও আলোচনার বিষয়বস্ত জঙ্গিবাদ এবং তা থেকে মুক্তির উপায়। আর টিভি টক শো’তে এ বিষয়ে তুমুল আলোচনা চলছে বিজ্ঞ আলোচকদের মধ্যে। এসব আলোচনায় যে যার মতো করে অভিমত ব্যক্ত করে চলেছেন। সরকার এবং বিরোধীদলকে ‘জঙ্গিবাদ’ নিরসনের উপায় সম্পর্কে মূল্যবান জ্ঞান দান করছেন। কেউ কেউ জঙ্গিবাদের উত্থান বিষয়ে বিজ্ঞানী নিউটন কিংবা আর্কিমিডিসের মতো সূত্রও আবিষ্কার করে ফেলছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ জঙ্গি উত্থানের জন্য ইসলামী মৌলবাদকেও দায়ী করছেন। কারো কারো মন্তব্য এতোটাই উদ্ভট যে, তা শুনলে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।
গত ২৩ জুলাই রাতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শো’তে আলোচক ছিলেন দু’জন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও লেখক (যার ছেলে কয়েকমাস আগে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছে), অপরজন বর্তমান শাসক দলের সমর্থক একজন সুপরিচিত আইনজীবী। অধ্যাপক সাহেব কণ্ঠে উদ্বেগ মিশিয়ে বলছিলেনÑপঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে মসজিদে এত মুসল্লি ছিল না। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকে। আবার পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে তাবলিগ জামাতে এতো লোক হতো না। ক্রমান্বয়ে এটি বেড়ে বেড়ে আজকের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি পরিষ্কার করে না বললেও বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে, মসজিদে ক্রমাগত মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি মৌলবাদী শক্তির উত্থানের নিদর্শন। এটা জঙ্গি উত্থানের অন্যতম কারণ। এ ধরনের আরেকটি টক শো শুনেছিলাম অন্য আরেকটি টিভি চ্যানেলে গুলশান ট্র্যাজেডির পরপরই। এক আলোচক ভীষণ উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলছিলেন, ‘আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক ছাত্রী হিজাব পরে।’ ভাবখানা এরকম যে, ছাত্রীরা হিজাব পরে ‘মহাপাপ’ করে ফেলেছে। কথা শুনে মনে হয়- হিজাব নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বিকিনি পরে গেলেই ওই আলোচক বোধ হয় খুশি হতেন।
আজ সারা বিশ্বে জঙ্গি নির্মূলের নামে ইসলাম বিরোধী এক ধরনের কৌশলী ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। সে কৌশল আমাদের দেশেও প্রয়োগ করা হচ্ছে নানা কায়দা, নানা ফিকিরে। এখানে রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা করতে গিয়ে কেউ কেউ ইসলামকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে। প্রগতিশীলতার তকমা আঁটা একদল লোক তাবৎ সন্ত্রাসের জন্য ‘ইসলামী মৌলবাদ’কে দায়ী করে চলেছে। একটা সময় ছিল যখন এরা জঙ্গিবাদের উৎস হিসেবে দেশের মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট বানিয়ে কথা বলতো। কিন্তু গুলশান ট্র্যাজেডির পর তাদের কণ্ঠস্বর একটু ম্রিয়মান হয়ে গেছে। ভ্রুকুঞ্চিত করে তারা এখন আমতা আমতা করে বলছেন যে, উচ্চবিত্ত ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেরা এ পথে গেল কী করে!
এ বিষয়ে কারো বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই যে, ইসলামের নামে যে জঙ্গি তৎপরতা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চালানো হচ্ছে ইসলাম তা কখনোই সমর্থন বা অনুমোদন করে না। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদরা এও বলেছেন যে, যারা মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজ করছে তারা ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। তারপরও এটাই সত্য যে, বিশ্বজুড়ে যেসব জঙ্গি তৎপরতা চলছে সেগুলোর হোতা কিছু সংখ্যক বিভ্রান্ত এবং নামধারী মুসলিম। সচেতন ব্যক্তিরা প্রশ্ন তুলেছেন, যারা এসব করছে তারা কি ইসলামকে শক্তিশালী করতে চায়, নাকি বিশ্বব্যাপী ইসলামধর্মকে একটি সন্ত্রাসীধর্ম হিসেবে পরিগণিত করার ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়নে তৎপর? আইএস নামের যে সংগঠনটি আজ বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তার প্রতিষ্ঠাতা বা উদ্যোক্তা এবং অস্ত্র-রসদ সন্ত্রাসবাদ সরবরাহকারী কারা সেটা কিন্তু এখনো রহস্যাবৃত। কোথা থেকে তারা পাচ্ছে এত অস্ত্র? কারা দিচ্ছে তাদের ব্যয় করার মতো বিপুল অর্থ?
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। আইএস ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু নিধনের কথা প্রচার করলেও তারা হত্যা করে চলেছে মুসলমানদেরকেই। রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের প্রকাশ্য শত্রু এটা সবার জানা। কিন্তু সেই ইসরাইলে কি আইএস আক্রমণ চালিয়েছে? কেন ইসরাইল আইএস এর নিশানা থেকে এখন পর্যন্ত বাইরে আছে? এ বিষয়ে কারো কারো কারো মত হচ্ছে, আইএস তার প্রতিষ্ঠাতাকে তো আক্রমণ করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ২১ জুলাই প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক’ পত্রিকায় গোলাম মোর্তুজা তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ, আমেরিকার তা সমর্থন, ইউরোপের নীরব থাকা বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিক্ষুব্ধ করে। চরমপন্থা বা জঙ্গিবাদে উৎসাহিত হয়ে পড়ে একটা অংশ। স্বীকার-অস্বীকার যাই করি না কেন, এটা একটা বাস্তবতা। ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়ায় আমেরিকার ধ্বংসাত্মক যুদ্ধনীতি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের চরমপন্থায় উৎসাহিত করেছে। আন্তর্জাতিক এই চরমপন্থায় জঙ্গি তৎপরতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারছে না বাংলাদেশের মানুষের একটা অংশ। আমেরিকা এসব জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীচক্র জন্ম দেয়, টিকিয়ে রাখে, ব্যবস্থা নেয়ার নাটক, সবই করে।’ উপর্যুক্ত মন্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কম। ‘বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধ্বংসের চেষ্টা চলছে’-এ ধরনের প্রচারণা মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে উত্তেজিত করে তুলতেই পারে। তাদের সে উত্তেজনাকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর নিজ নিজ ফায়দা লুটার মওকা সৃষ্টি করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিক ‘ওরা কেন জঙ্গি হচ্ছে?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল গত ৪ জুলাই। তাতে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ তাদের সুচিন্তিত অভিমত তুলে ধরেছেন। প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘একটা বয়স থাকে যখন তরুণরা অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থেকে অনেকে এ ধরনের ঝুঁকি নিতে ভালোবাসে। তিনি আরো বলেছেন, উচ্চবিত্তের পরিবারের সন্তানরা আন্দোলন, সংগ্রাম বা প্রথাগত-রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তেমন একটা ধারণা রাখে না। তাদের কেউ কেউ বিপথগামীদের পাল্লায় পড়ে ধর্মীয় কারণে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য এ পথে পা বাড়ায়।’ ওই প্রতিবেদনে অন্যান্যদের অভিমত প্রায় একই ধরনের। তারা একটি বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে, বিপথগামী হওয়া বা জঙ্গিতে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবার কোনো ব্যাপার নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেছেন, ‘আগে আমাদের ধারণা ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বা দরিদ্র শ্রেণীর তরুণরা সহজেই জঙ্গি কর্মকা-ে প্রলুব্ধ হয়। কারণ অর্থের বিনিময়ে তাদের ব্যবহার করা সহজ। কিন্তু এখন সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেরাও জঙ্গি আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পড়ছে।’
এসব অভিমত থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আমাদের দেশে উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ যাই বলি না কেন, এর শিকড় অনেক গভীরে এবং তা দেশের বাইরে বিস্তৃত। কারণ, গুলশানের হত্যাকারীদের মধ্যে তিনজনই বিদেশে ছিল এবং জঙ্গি হয়ে দেশে ফিরে এসেছে।
প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিষবৃক্ষ বাংলাদেশের জমিনে তার শিকড় ছড়ালো কীভাবে? নির্মোহ দৃষ্টিতে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোতুর্জার মন্তব্যকেই মেনে নিতে হয়। এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বাংলাদেশকে নিয়ে যারা খেলাধুলা করতে পছন্দ করে, তারা যে কোনো উপায়ে এখানে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখতে চায়। সেটা পার্বত্য জেলাগুলোতে উপজাতিদের সশস্ত্র সংগঠনের দ্বারাই হোক, কিংবা ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীর নামেই হোক। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলে যেসব শক্তির সুবিধা হয় তারা এক্ষেত্রে আগুনে ঘি ঢালবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ফলে তরুণ এই জঙ্গিরা আইএস, নাকি অন্য কোনো বিশেষ শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে তা নিয়ে চিন্তাভাবনার দরকার আছে। বাংলাদেশে অস্থির পরিবেশ থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশ পরিত্যাগ করে যেসব দেশে চলে যেতে পারে তাদের ইন্ধন এ ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে কীনা সে দিকটাও ভেবে দেখতে হবে।
গুলশান হত্যাকা-ের পর পর্যবেক্ষক মহল থেকে বলা হয়েছিল যে, এ ঘটনার সঙ্গে দেশের বাইরের শক্তি জড়িত। তাছাড়া ঘটনার দায় আইএস স্বীকারও করেছে। এমনকি রাত ১২টার পরপরই আইএসএর নিজস্ব ওয়েব পেজ এবং সাইট ইন্টেলিজেন্স নামক একটি অনলাইনে নিহতদের ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। সুতরাং, গুলশান হত্যাকা-ের হোতাদের সঙ্গে যদি আইএস বা বহির্বিশ্বের কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সম্পর্কই না থাকতো তাহলে ওই সংগঠনের ওয়েব পেজে নিহতদের ছবি কীভাবে প্রকাশ পেল?
কিন্তু সবাই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে, ঘটনার পর কিছুটা ‘দম’ নিয়ে শাসকদল পুরনো স্টাইলে ‘ব্লেইম গেম’ চর্চায় নেমে পড়লো। তারা সমস্বরে বলতে শুরু করলো যে, হত্যাকারীদের সঙ্গে আইএস এর সম্পর্ক নেই, ওদের মদতদাতারা দেশের ভেতরেই আছে। পরবর্তীতে তারা আরো স্পষ্ট করে বললো যে, এ হামলার পেছনে বিএনপি-জামায়তচক্র জড়িত। কিসের ভিত্তিতে তারা এসব অভিযোগ আনছে তা কিন্তু পরিষ্কার করছে না। সরকার অবশ্য অনেক আগে থেকেই বলে আসছে যে, বাংলাদেশে অইএস নেই। যদিও দেশে সংঘটিত বেশ কয়েকটি হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে প্রায় সাথে সাথেই আইএস বিবৃতি প্রচার করেছে। অবাক করার বিষয় হলো, সরকার বাংলাদেশে আইএস নেইÑএ গ্যারান্টি দিলেও আইএস-এর নামে ওইসব বিবৃতি কারা কোথা থেকে প্রচার করছে এখন পর্যন্ত তা উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
গুলশান হত্যাকা-ের সন্ত্রাসীদের মদতদাতারা দেশের ভেতরেই আছেÑসরকার ও সরকারি দলের নেতাদের এ বক্তব্য শুনে অনেকেই তখন বলেছিলেন যে, ঘটনার দায় বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর চাপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। সরকারের সে মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১১ জুলাই ১৪ দলের সমাবেশে। ওই সমাবেশে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘সাবেক ছাত্র শিবির কর্মীরাই এখন আইএসে যোগ দিয়েছে। তারাই বিভিন্ন নামে বিএনপি-জামায়াতের নির্দেশে জঙ্গি হামলা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে।’ সরকারের একজন মন্ত্রী যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না তারা আসলে কী চান। তাদের কথাবার্তা কাজকর্ম পর্যবেক্ষণে অনেকেই সন্দিহান হয়ে উঠেছেন যে, সরকার আসলে জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল চায় কী না।
জঙ্গি প্রতিরোধে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা অসঙ্গত নয়। কেননা, যেখানে সবাই বলছেন যে, এটি যেহেতু একটি জাতীয় সংকট, তাই এর প্রতিরোধে দেশে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু সরকার সে পথে যায়নি। তারা বরং জঙ্গি প্রতিরোধে দলীয় কমিটি গঠন করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তৎপর হয়েছেন। আর সরকারের এ অবিমৃশ্যকারী চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজকর্মেও।
গুলশান হত্যাকা-ের পর একটি তথ্য বেরিয়ে আসে যে, জঙ্গি তরুণরা দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিল, পরিবারের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে অনেকেই ধারণা করেন যে, গত কয়েক বছরে সারাদেশে যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের অনেকেই হয়তো জঙ্গি তৎপরতায় সংশ্লিষ্ট হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ জুলাই র‌্যাবের পক্ষ থেকে সারাদেশে ২৬২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকায় নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও মানারাত কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১২ জন শিক্ষার্থীর নাম ঠিকানা দেয়া হয়। তালিকা প্রকাশের পর র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, থানা-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
র‌্যাবের এ তালিকা প্রকাশের পর বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে। যাতে দেখা যায়, র‌্যাবের তালিকার ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিরা সবাই নিখোঁজ নয়। অধিকাংশই বহাল তবিয়তে যার যার পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছে অথবা কর্মস্থলে কর্ম করে খাচ্ছে। এ বিষয়ে গত ২৩ জুলাই দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র‌্যাবের তালিকায় মৃত ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী এবং কারাবন্দির নামও রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র‌্যাবের তথ্য মতে রংপুরের নিখোঁজ ৯ জনের মধ্যে ৬ জন এবং ঝিনাইদহে ২৯ জনের মধ্যে ২৪ জনই বাড়িতে অবস্থান করছে। একই দিনের দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, র‌্যাবের নিখোঁজ তালিকা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এ তালিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করেছে, তেমনি যারা উগ্রবাদী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত নয় তাদের নাম তালিকায় আসায় সমাজে তাদের ভাবমর্যাদা সংকটে পড়েছে। ২৪ জুলাই এর প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অনুসন্ধান চালিয়ে র‌্যাবের নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ১২৫ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। খবরে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে বিভিন্ন থানায় স্বজনদের করা সাধারণ ডায়েরির ভিত্তিতেই নাকি র‌্যাব এ তালিকা প্রণয়ন করেছিল। প্রশ্ন উঠেছে ‘এলিট ফোর্স’ হিসেবে পরিচিত বাহিনীটি কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া এমন একটি তালিকা প্রকাশ করল কেন?
এ কেন’র উত্তর খুব কঠিন নয়। সরকার যখন কোনো বিশেষ ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে মনোযোগী হয়, ঘটনার স্রোত ফেরাতে চায় ভিন্ন খাতে, তখন সরকারের বিভিন্ন অর্গানের কাজে সমন্বয় থাকে না। যে যার মতো কাজ করতে থাকে। বোধকরি জবাবদিহিতারও কোনো বালাই থাকে না। র‌্যাবের নিখোঁজের তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে সে রকমটিই ঘটেছে। এখানে তালিকা প্রকাশই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য। সেটা নির্ভুল, সঠিক কিংবা গ্রহণযোগ্য কী না এসব নিয়ে মাথা ঘামাননি বাহিনীটির মাথার দিকের ‘চৌকস’ কর্মকর্তারা। অবশ্য সমালোচনার তীরে ঝাঁঝড়া হয়ে র‌্যাব অবশেষে তাদের প্রকাশিত ‘নিখোঁজ তালিকা’ সংশোধন করেছে। গত ২৫ জুলাই বাহিনীটির পক্ষ থেকে ‘থুক্কু’ দিয়ে বলা হয়েছে- ২৬২ নয়, প্রকৃত নিখোঁজের সংখ্যা ৬৮ জন। সচেতন মহল অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, এদের মধ্যে কতজন গুম হয়েছে, কিংবা কথিত ‘বন্দুক যুদ্ধ’র শিকার হয়ে বেওয়ারিশ লাশে পরিণত হয়েছে সে হিসাব কে দেবে?
আমাদের জাতীয় জীবনে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদ যে একটি বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তা নিয়ে কারো দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। এ অভিশাপ থেকে মুক্তিও চান সবাই। কিন্তু সে মুক্তি কোন পথে তার সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। দুঃখজনক হলো, রাষ্ট্রের চাবি যাদের হাতে তাদের কথাবার্তায় জঙ্গি প্রতিরোধের চেয়ে এটাকে নিয়ে ভিন্ন ধরনের রাজনীতি খেলার বিষয়টিই অধিকতর প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। এ খেলা যদি চলতেই থাকে তাহলে বলাটা বাহুল্য হবে না যে, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
mohon91@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Kamal ২৯ জুলাই, ২০১৬, ১২:৪৫ পিএম says : 0
এ অভিশাপ থেকে মুক্তিও চাই।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন