মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী
এক
বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষকদের অরাজনৈতিক একক ঐতিহ্যবাহী সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা এবং দ্বীনের ওপর যে কোনো প্রকারের আঘাত এলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ-প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং এহেন দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্তমান জমিয়াত সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক তাঁর এ পত্রিকাকে দ্বীন-ইসলামের মর্যাদা রক্ষায় প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত রাখেন। জমিয়াত ও ইনকিলাবের এ সুদূরপ্রসারী ভূমিকা সর্বদাই ইসলামপ্রিয় জনতার প্রশংসা লাভ করে আসছে।
অতি সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উত্থান এবং একশ্রেণীর বিপথগামী বিভ্রান্ত লোকের নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার অর্থাৎ নৃশংস হত্যাকা- ও আত্মহননের ঘটনাবলিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। সংগঠনটি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে এক সুদূরপ্রসারী ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ কর্মসূচি অনুযায়ী দেশের মাদরাসা শিক্ষক, ছাত্র, মাশায়েখ ও ওলামাসহ মুসলিম জনতার এক বিশাল ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
গত ২৭ জুলাই (বুধবার) ইনকিলাবে প্রকাশিত এবং বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কর্তৃক প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিটির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে। গত ২৪ জুলাই (২০১৫) বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের জাতীয় কমিটির বিশেষ সভায় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ কল্পে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, (আগামী) আগস্ট হতে নভেম্বর পর্যন্ত মোট চার প্রকারের কর্মসূচি রয়েছে। ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ৪ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে সকল উপজেলা সদরে মানববন্ধন। ২২ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে সকল জেলা সদরে মানববন্ধন। ১ অক্টোবর ২০১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তি দূরকরণে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল বিভাগীয় পর্যায়ে মাদরাসা শিক্ষক আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখগণের সমাবেশ। নভেম্বর ২০১৬ এর প্রথম সপ্তাহে দেশের সকল মাদরাসা শিক্ষক, আলেম-ওলামা পীর-মাশায়েখদের উপস্থিতিতে ঢাকায় মহাসমাবেশ।
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডভুক্ত আলিয়া পদ্ধতির সকল স্তরের মাদরাসা দেশের সর্বত্র বিদ্যমান। মাদরাসা শিক্ষকদের প্রাচীনতম সংগঠন জমিয়াতের সাবেক সভাপতি মরহুম মাওলানা এম এ মান্নানের জীবদ্দশা পর্যন্ত তাঁরই নেতৃত্বে সারাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অসংখ্য শাখা জমিয়াত। তাঁর ওফাতের পর তাঁরই সুযোগ্য সন্তান আশেকে ইসলাম জনাব এ এম এম বাহাউদ্দীন তাঁর মহান পিতার এ মিশনকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়েছেন জমিয়াতের সভাপতি হিসেবে। দেখা গেছে, তিনি প্রায়ই ঝটিকা সফরের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সকল জমিয়াতের শাখা গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কেবল দেশের মধ্যে নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে মাদরাসা শিক্ষকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন রূপে পরিগণিত এবং একটি কর্মতৎপর সক্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে। শিক্ষক আলেম-ওলামা এবং পীর-মাশায়েখ প্রভৃতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এটি বৃহত্তর ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম।
অতীতের কথা বাদ দিলেও স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে বিভিন্ন সময়ে ইসলামের ওপর নানামুখী হামলা হয়েছে। মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষাবিরোধী তৎপরতাসহ কোরআন-হাদিসের অবমাননা, ইসলামের বিকৃতি, আল্লাহদ্রোহিতা এবং সামাজিক অনাচার-পাপাচারের বিরুদ্ধে জমিয়াত সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষত সকল স্তরের মাদ্রাসা শিক্ষার সমস্যাবলীর সমাধান ও উন্নয়ন মাদ্রাসা শিক্ষকদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং সর্বশেষ ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও চালু করার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের নেপথ্যে জমিয়াত সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদকের দূরদর্শিতাপূর্ণ সক্রিয় ভূমিকা ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ঘোষিত কর্মসূচির বাস্তবায়ন ৪ আগস্ট থেকে মানববন্ধনের মাধ্যমে শুরু হবে এবং ঢাকায় আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের মহাসমাবেশের মাধ্যমে নভেম্বর মাসে শেষ হবে। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধে এটি একটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচি। জমিয়াতভুক্ত হাজার হাজার মাদরাসা শিক্ষক, ছাত্র, আলেম-ওলামা এবং পীর-মাশায়েখের লাখ লাখ প্রতিনিধির বিশাল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কাছে সন্ত্রাসী জঙ্গিরা পরাভূত হতে বাধ্য হবে। কেননা তার শেকড় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্র্রথিত। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের লুকিয়ে এবং আত্মগোপন করে থাকার কোনো সুযোগ নেই। নিরাপদে, নির্বিঘেœ তার এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারিভাবে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
জমিয়াতের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১ অক্টোবর ২০১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাস প্রতিরোধের এবং মাদকাসক্তি দূরীকরণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল বিভাগীয় পর্যায়ে মাদরাসা শিক্ষক, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখগণের সমাবেশ কর্মসূচির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুদূরপ্রসারী দিক। নানাভাবে, নানা অভিনব পদ্ধতি ও কলাকৌশলে মাদকাসক্তি এবং নেশাখোরী সারাদেশে মহামারী আকার ধারণ করেছে, নেশাদ্রব্য সেবন ও মদ্যপানের এ বিষাক্ত ও প্রাণঘাতী প্রবণতা ও তৎপরতা রোধ করা সম্ভব না হলে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সমূলে উৎপাটন করার কথা ভাবা যায় না। জাতীয় ঐক্য হোক কিংবা যাবতীয় ঐক্য হোক কোনো উদ্যোগ-প্রয়াসই সফল হওয়ার আশা খুবই ক্ষীণ। কাজেই সকল উদ্যোগ-প্রচেষ্টার পাশাপাশি মাদকবিরোধী তৎপরতাও জোরদার করতে হবে। এ ব্যাপারে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের কর্মসূচিকে সময়োপযোগী বলতে হবে। বিপথগামীদের মধ্যে অনেকে নেশাগ্রস্ত থাকে। কেবল তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়, বয়স্ক লোকেরাও তাদের অন্তর্ভুক্ত। জানা যায়, বিভ্রান্ত বিপথগামী হয়ে যারা সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের খপ্পরে পড়ে যায়, তাদের মগজ ধোলাইয়ের অংশ হিসেবে নানা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মাদক ইনজেকশনও পুশ করা হয়। কাজেই জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের আস্তানা আবিষ্কার করে তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মূলে আঘাত করতে হবে। শহরে-বন্দরে, অলিতে-গলিতে ছোট ছোট ছেলেরা পর্যন্ত হেরোইন সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাড়ায়-বস্তিতে নানা বয়সের হেরোইনসেবীর প্রকাশ্য বিচরণ লক্ষ্য করা যায়।
শহরে-বন্দরে বিত্তশালী অভিজাত বংশের সন্তানেরা নানা প্রকারের মাদক সেবনে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চরিত্র হননকারী আত্মঘাতী মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হওয়ার প্রয়োজন বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বাধিক। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হলে মাদক সেবন ও মাদকের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অভিজাত শ্রেণী ও বিত্তশালীদের দুলাল-দুলালীরা কীভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে তা গভীর ও ব্যাপকভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য প্রচার-প্রচারণা হতে এর বহুমুখী কুফলগুলো সর্বস্তরে তুলে ধরতে হবে। কেবল ধর্মীয় দিক নয়, বৈষয়িক ক্ষতিগুলোও ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন