মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

জিডি নম্বর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়

প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

আইনি সহায়তা পেতে প্রাপ্তবয়স্কের যে কোনো ব্যক্তি তার সমস্যার কথা উল্লেখ করে যে বিবরণ লেখা হয় তাই ‘জেনারেল ডায়েরি’। সংক্ষেপে আমরা ‘জিডি’ বলি। দেশের প্রতিটি থানা এবং ফঁাঁড়িতে একটি ডায়েরিতে ২৪ ঘণ্টার খবর রেকর্ড করা হয়। এই ডায়েরিতে থানার বিভিন্ন কার্যক্রম লিপিবদ্ধ করা হয়। আসামি কোর্টে চালান দেয়া, এলাকার বিভিন্ন তথ্য, থানার ঊর্ধŸতন কর্মকর্তাদের আগমন ও প্রস্থানের তথ্য লিখতে হয়। কার্যত এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু জিডি করার পরেও জনগণ আইনি সেবা পায় না। এর নিকটতম দৃষ্টান্ত হলোÑ গত ২১ জুলাই আনুমানিক রাত ৯ ঘটিকার সময় মঠবাড়িয়া উপজেলার ইট, বালু ও পাথর ব্যবসায়ী রেজাউল করিম মামুনকে কতিপয় ব্যক্তি উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ির কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেলে পরিবারের পক্ষ থেকে তার স্ত্রী ২২ জুলাই সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর থানায় নিয়মিত যোগাযোগ করলেও পুলিশ তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। বরং তাদেরকে এমনও বলতে শোনা গেছে, “এই মুহূর্তে তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। অপরাধীরা যদি সরকারি দলের নেতাকর্মী হয়ে থাকেন তাহলে তাদেরকে সহসা আইনের আওতায় আনা যাবে না। তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার আগে কিছু বলা যাবে না”। থানা পুলিশের এমন বক্তব্যে পরিবারটি যথারীতি হতাশায় দিন পার করতে থাকে। এর দু’দিন পর গত ২৪ জুলাই সকালে স্থানীয় জেলেরা চেচাং চড়ের হোগলা বন থেকে চোখ, হাত ও পা বাঁধা গুরুতর আহত এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে স্থানীয় মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন। মুহূর্তেই সেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়। “মঠবাড়িয়ার নিখোঁজ ব্যবসায়ীকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার” (প্রথম আলো : ২৫ জুলাই)। এর পরপরই মঠবাড়িয়া থানা পুলিশ তদন্তের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে চিকিৎসাধীন ব্যবসায়ীর জবানবন্দি নেয়ার জন্য বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। অথচ এর তিনদিন আগে ব্যবসায়ীর স্ত্রী থানায় জিডি করলেও পুলিশ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কতিপয় কর্মকর্তা জনঅধিকার ও সেবার চেয়ে সংবাদকর্মীদের রিপোর্টকেই অধিক মূল্যায়ন করেন। আর যে বিষয়গুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয় না, সেসব বিষয়ের শুরু ও শেষ বলতে থানায় জিডি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পর ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে কার্যত কোনো ধরনের তৎপরতা নিতে দেখা যায় না। ডায়েরি করার পর কত সময় পর তার কার্যকারিতা বা পুলিশের তৎপরতা শুরু হবে তা কারো জানা নেই। জিডি করার পর সেই ঘটনার তদন্ত না করা বা গড়িমসি করা যেন তাদের চিরায়ত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যে কারণে প্রায়শই সংবাদকর্মীরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেন। গত ২৪ জুলাই দৈনিক কালের কণ্ঠের এক সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘তদন্ত হয় না জিডির’। ‘জিডি হলেও তদন্ত হয় না’ (বিবার্তা)। ভোরের পাতা, ৭ নভেম্বর ২০১৫-এর এক শিরোনাম ছিল ‘থানায় জিডি হলেও তদন্ত হয় না’। এছাড়া মানবজমিন, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ এক রিপোর্ট করেছিল ‘জিডি : তদন্ত কতদূর যায়’। ‘ডিএমপিতে গড়ে দৈনিক ২ হাজার জিডি-নামেই আইনি পদক্ষেপ’ (দৈনিক জনকণ্ঠ : ১১ জুন, ২০১৬)। ‘থানায় জিডি কি শুধুই সান্ত¦না’ (ভোরের কাগজ ডট নেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। ‘টাকা না দেয়ায় রিকশাচালকের জিডি নেয়নি ডিউটি অফিসার’ (যায়যায় দিন : ২০ মার্চ ২০১৪)। জিডি করতে টাকা নেয়া, জিডির পর তদন্ত না হওয়া, মামলায় গড়িমসি করা, তদন্তের নামে হয়রানি, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়াÑবিষয়গুলো আসলেই উদ্বেগজনক।
এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীন ৪৯টি থানায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০টি করে সাধারণ ডায়েরি লেখা হয়। শুধু রাজধানীর থানাগুলোতে যদি বছরে ৫ লক্ষাধিক জিডি লেখা হয় তাহলে সারাদেশের যে কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। তবে এর অধিকাংশই থেকে যায় ফাইলবন্দি।
সাধারণ ডায়েরি হওয়ার পরেও সে বিষয়টি পুলিশ আমলে নেয় নাÑএ অভিযোগটি নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জিডি হওয়ার পর সেই বিষয়টির তদন্ত শুরু হয়েছে এমন ঘটনা খুবই কম। বহু বিষয় আছে যেসব বিষয় কোনো গুরুত্বই দেয়া হয় না। সাধারণ মানুষ জিডি করে আইনি সহায়তা পেয়েছে এমন নজিরও খুবই কম। ভিআইপি, সিআইপি কেউ হলে হয়তো দ্রুত তদন্ত হয়। এছাড়া অন্যদেরকে শুধু জিডি নম্বর নিয়েই আতঙ্কের সাথে সন্তুষ্টির অভিনয় করতে হয়। থানায় তদবির করতে পারলে অনেকক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক হলে হতেও পারে। কিন্তু সরকারদলীয় যে কেউ কোনো ধরনের জিডি করার ইচ্ছা পোষণ করলেও তা যেন মামলায় পরিণত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ নিজ উদ্যোগে আইনকে ব্যবহার করে ন্যায়কে অন্যায়ভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। আবার কখনো নিচের সারির কর্মকর্তারা ঊর্ধŸতন কর্মকর্তা বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হন। এককথায় রাজনৈতিক বিষয়গুলো অনিয়ম হলেও সেটিকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়। জিডির মতো অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতার উন্নতি ঘটবে কিনা সে আশঙ্কা থেকেই যায়। জিডির তদন্তগুলো সঠিকভাবে না হওয়ায় অভিযোগকারী খুব সহজেই সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হয়ে থাকেন। তাই জিডিগুলোকে আমলে নিয়ে এসব সমস্যার সমাধান অতি দ্রুত করা উচিত। জিডিগুলোকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করে গুরুত্ব দেয়া না হলে জিডির গুরুত্ব ক্রমশ কমে যাবে।
জিডি করার মাধ্যমে কেউ হয়তো আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার আদায় করতে পারলেও অধিকাংশ মানুষই সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। কোথাও কোথাও জিডি করতে গিয়ে নানভাবে হয়রানিও হতে হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ট্র্যাজিডিতে যারা শাহাদাতবরণ করেছেন তাদের অনেকের পরিবার মামলা করতে গিয়ে অভিভাবকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। বহুস্থানে জিডি করতে গিয়ে অভিভাবকরা গ্রেফতার হয়েছেন। এটি আসলেই দুঃখজনক। আমরা জানি, জিডি করতে কোনো টাকা লাগে না। থানা পুলিশও এটি স্বীকার করে। তাহলে সার্ভিস চার্জ (!), চা-পানের খরচ, মোবাইল বিল ইত্যাদি নামে যেসব টাকা নেয়া হয় সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত। ২০০২ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশর একটি গৃহ-জরিপের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে নাগরিকদের গড়ে প্রতিটি জিডি এন্টির জন্য ৪৫০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। (যুগান্তর : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)। যেসব কর্মকর্তা এসব দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত।
পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হলেও সাধারণ মানুষ সেই পুলিশকেই আবার বেশি ভয় করে। তদুপরি অনাকাঙ্খিত কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে পুলিশের কাছে না গিয়ে উপায় নেই। সচেতন নাগরিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই পুলিশের সাহায্য নিতে থানার দ্বারস্থ হয়। আর আইনি সাহায্য পাওয়ার সেই প্রাথমিক ধাপটিই হলো সাধারণ ডায়েরি। পুলিশ আইনের ৪৪ ধারার বিধান মতে প্রত্যেকটি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি রেজিস্টার রাখা হয়। এছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ও ১৫৫ ধারার উদ্দেশ্য পূরণে থানায় জিডি বই সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। জিডি রেজিস্টার সংরক্ষণের দায়িত্ব থানার অফিসার ইন-চার্জের (ওসির)। পুলিশ প্রবিধানের ৩৭৭ ধারায় জিডি বই লিখন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
কোনো মানুষ সমস্যায় পড়লে থানায় জিডি করার মাধ্যমে তার অধিকার আদায় করতে চায়। বিশেষ করে, কাউকে ভয়ভীতি দেখানো হলে, নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে, কোনো ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা করলে, কেউ কারো সম্পদের ক্ষতি করলে, প্রাণনাশের হুমকি দিলে, বাসার কেউ নিখোঁজ হলে, জিডি করা হয়। এসবের বাইরেও কোনো কাগজপত্র হারিয়ে গেলে যেমন সার্টিফিকেট, দলিল, লাইসেন্স, পাসপোর্ট, মূল্যবান রসিদ, চেকবই, এটিএম বা ক্রেডিট কার্ড, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ ইত্যাদি হারালে থানায় জিডি করা হয়। এমনকি হারানো জিনিস খুঁজে পেতেও জিডি সহায়ক হয়ে ওঠে। জিডি বইতে যে কোনো এন্ট্রি সাক্ষ্য আইনের ৩৫ ধারা মতে ভবিষ্যতে আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। এসব কারণে জিডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ২৫ জুলাই জিডি বুক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে জিডি করার নতুন প্রক্রিয়া চালু হলো তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হোক এবং প্রত্যেকটি জিডির সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত হোক, সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের সাথে সাথে সর্বত্র ন্যায়বিচার কায়েম হোকÑএটাই সবার প্রত্যাশা।
য় লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন