রু মা ন হা ফি জ
চারিদিকে ঘন অন্ধকার। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। দিনের লাল টুকটুকে সূর্যটা বিদায় নেওয়ার সাথে সাথে পুরো এলাকার লোকজন যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বিশাল নদী পার হওয়ার একমাত্র ভরসা রহিম মাঝি। দিনেরবেলা সাধারণ মানুষেরা পারাপার করলেও রাতেরবেলা তেমন কেউ পার হয় না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পার করে দিতেই সারা রাত নৌকা নিয়ে বসে বসে অপেক্ষা করেন রহিম মাঝি। সেই সন্ধেবেলা ছেলে জসিমকে নিয়ে আসেন। এখন রাত প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। ফরিদ আর জামাল ওদের তো আজ পার হওয়ার কথা। এখনো আসছে না যে। কোন সমস্যা হলো না তো! এসব ভাবতে ভাবতে রহিম মাঝি ছেলের দিকে তাকায়-
-জসিম
-জ্বি বাবা
-তোর কি ক্ষিধে লাগছে?
-হ, বাবা ক্ষিধে লাগছে খুব
-এই নে, চিড়া আর গুড়
বাড়ি থেকে আসার সময় একটা পুঁটলিতে তা নিয়ে আসেন রহিম মাঝি। জসিম একমুঠো চিড়া আর এক টুকরো গুড় মুখে দেয়। বাবার কাছে এসে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে-
-আর কত সময় বাবা?
-কেন তো কি কষ্ট অইতাছে?
-না বাবা
-তাইলে?
-এতোক্ষণ হলো ওরা যে আসতেছে না
-হ্যাঁ আসবে বাবা
জসিম উপরের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পর জসিম বলে উঠলো,
‘ঐ যে দেখো বাবা, মনে হয় ওরা আইসা গেছে।’
রহিম মাঝি নৌকা ঘাটে ভিড়ায়। সাথে সাথে তারা নৌকায় উঠে পড়ে।
-রহিম চাচা, কেমন আছেন? ফরিদ প্রশ্ন করে
-না বাজান তেমন ভালো নেই
-কেন কি অইছে চাচা?
-পাক বাহিনী যেভাবে দিনদিন গ্রাম চষে বেড়াইতাছে, তাতে আর ভালো থাকি কি করে?
-চিন্তা কইরেন না চাচা আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-চাচা আমার খুব ভয় অইতাছে, জসিম বললো-
-কেন কি অইছে?
-আমার গ্রামের ইদ্রিস আলী বলছে, রহিম মাঝি শালার মুক্তিযোদ্ধাদের পার কইরা দেয়, হেরে শেষ কইরা দিতে অইবো।
-ভয় পাবেন না চাচা, একটু সাবধানে থাকবেন
ততক্ষণে নৌকা ওপারে গিয়ে ভিড়ালে, সবাই নেমে পড়ে। যাওয়ার সময় ফরিদ কিছু টাকা রহিম মাঝির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-
-চাচা আপনার এ ঋণ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না।
-না বাজান এ আর এমন কি। তোমাদের পার করে দিতে পেরে নিজের মনে একটু শান্তি পাই। আর যাই হোক, যতদিন বাঁচি ততদিন তোমাদের নৌকায় পার করে দেবো।
সবাই নেমে গেলে রহিম মাঝি নৌকা ঘুরায়। উদ্দেশ্য নৌকাটা ঘাটে বেঁধে বাড়িতে যাবে। নৌকাটা পাড়ের কাছে ভিড়াতেই হঠাৎ উপর হতে কার যেন শব্দ শুনতে পায় রহিম মাঝি। তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। এতো ইদ্রিস আলী! পাক বাহিনীর সহযোগী। ওদের নানাভাবে সহযোগিতা করে ইদ্রিস আলী। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায় মিলিটারি ক্যাম্পে। তার কারণেই আজ গ্রামের লোকজন ঘরছাড়া।
কিছু বলার আগেই গর্জে ওঠে ইদ্রিস আলী।
‘এই রহিম মাঝি, তুমি নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের পার কইরা দিতাছো।’ এ কথা শুনে রহিম মাঝি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়।
-হ পার কইরা দিতাছি, তাতে কি অইছে?
তুই তো পাক বাহিনীর দালাল। জসিম উত্তর দেয়- কোন কথা না বলেই হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে মুহূর্তেই গুলি ছুড়ে ইদ্রিস আলী। জসিম পানিতে ডুব দিয়ে বেঁচে গেলেও একটা গুলি এসে লাগে রহিম মাঝির উপর। নৌকায় দাঁড়িয়ে থাকা রহিম মাঝির রক্তাক্ত দেহ পানিতে পড়ে রয়।
বাবার নিথর দেহ কাঁধে করে বাড়িতে ফিরে জসিম। নিষ্পাপ বাবার লাশ নিয়ে শপথ নেই জসিম। ‘স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বাবা হত্যার বদলা নেবে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন