বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে জীববৈচিত্র্য হল উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ পৃথিবীর গোটা জীবসম্ভার- তাদের অন্তর্গত জীন ও সেগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্র। একটি প্রজাতিকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে অন্য প্রজাতির উপর নির্ভরশীল হতে হয়। এই নির্ভরশীলতাই হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের মূল বিষয়। প্রাণীজগতের কোনো প্রাণীই চিরকালের জন্য পৃথিবীতে বিরাজ করতে আসেনি। প্রাকৃতিক ভাবেই বিবর্তনের একটি অন্যতম ধাপ হল প্রজাতির বিলুপ্তি। পৃথিবীর আদি থেকেই অসংখ্য প্রজাতি আলোর মুখ দেখেছে আবার কালের গহ্বরে হারিয়েও গিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একেকটি প্রজাতি পৃথিবীতে অন্তত ৫ থেকে ১০ লক্ষ বছর টিকে থাকতে পারে। এই সময়েই এরা বিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজন্মের উন্মেষ ঘটায়।
আমেরিকান জীববিজ্ঞানী ই.এ.নরসে এবং তার সহযোগীদের সূত্র অনুযায়ী, জীববৈচিত্র্য হলো জল, স্থলসহ সকল জায়গায় সকল পরিবেশে থাকা সকল ধরনের জীব এবং উদ্ভিদের বৈচিত্র। পৃথিবীর ১০ বিলিয়ন ভাগের একভাগ অংশতেই ৫০ মিলিয়ন প্রজাতির বিভিন্ন জীব-জন্তু এবং উদ্ভিদের বসবাস। বাংলাদেশেও বৃক্ষ প্রজাতি এবং প্রাণীকূলের সবিশেষ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে অনেক গাছপালা, লতাগুল্ম এবং প্রাণী বৈচিত্র্য আজ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। কিছু প্রজাতি ইতোমধ্যে আবার বিলুপ্ত হয়েও গেছে। কোনো কারণে হঠাৎ করে কোন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানে এক বিশাল ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়। এই শূন্যস্থান পূরণ হতে লেগে যায় কয়েক লক্ষ বছর। পৃথিবী ইতোমধ্যে পাঁচবার বড় ধরনের জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ডাইনোসরের বিলুপ্তি। আগের তুলনায় বর্তমানের জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তির হারের প্রকৃতি অনেকাংশেই ভিন্ন। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং মানবসৃষ্ট কারণে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার হার এতটাই বেশি যে, নতুন প্রজাতির উন্মেষে যে সময়টুকু প্রয়োজন, সেটাই তারা পাচ্ছে না। ফলে, প্রকৃতিতে যে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে, তা আর পূরণ করা হয়ে উঠছে না।
১৯৬০ এর দশকের গোড়া থেকে, আইইউসিএন (ওটঈঘ) হাজার হাজার প্রজাতির বিলুপ্তির ঝুঁকি গণনা করে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের স্থিতি অনুমান করে চলেছে। আইইউসিএন নিয়মিতভাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল এবং নির্বাচিত দেশগুলোর হুমকি প্রজাতির লাল তালিকা তৈরি করে। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের সর্বশেষ ৩৯০ প্রজাতির প্রাণী হুমকিস্বরূপ হিসেবে রেড লিস্ট (আইইউসিএন, বাংলাদেশ ২০১৫) তালিকাবদ্ধ করেছে, মূল্যায়ন করা হয়েছে ১,৬১৯ প্রজাতির প্রায় ২৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগের আইইউসিএন রেড তালিকা থেকে, আমরা গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়েছি। এর পনেরো বছর পর, বাংলাদেশের সর্বশেষ লাল তালিকাটি আমাদের মধ্যে আশঙ্কা সৃষ্টি করে এ কারণে যে, আরও ১৮ টি প্রজাতি আঞ্চলিক বিলুপ্তির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ১৬০ বাংলাদেশী জীববিজ্ঞানীর সমন্বিত এই বিস্তৃত অনুশীলনটি পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে আরও ২৭৮ টি প্রাণী প্রজাতির মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়নি। আইইউসিএন অনুসারে, দেশে প্রায় ১০% উদ্ভিদ ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায়। এর কিছু এখনও বিশ্বের অন্যান্য অংশে রয়েছে, তবে দেশীয় প্রজাতিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ১৭ টি প্রজাতির মেরুদন্ডী প্রাণী হারিয়ে গিয়েছে এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ৭৯৯ টি প্রজাতি বিলুপ্ত। চরম জলবায়ু সংক্রান্ত ঘটনা, আবাসস্থল হ্রাস, বন উজারকরণ ইত্যাদির ফলে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। আইইউসিএন আরো বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০% জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
জীববৈচিত্র্য হ্রাসের জন্য অনেকগুলো হুমকি রয়েছে, যার মধ্যে কিছু প্রত্যক্ষ এবং গতিশীল এবং অন্যগুলো পরোক্ষ। হুমকিগুলোর মধ্যে রয়েছে, দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, বন ও জলাভূমিকে কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তর বা ভূমি ব্যবহারের অন্যান্য রূপ, দুর্লভ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর জনসংখ্যার চাপ, বায়ু এবং পানি দূষণের বিভাজন, জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থার পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত সংগ্রহ। সেই সাথে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার করে খাদ্য শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল বা প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ হস্তক্ষেপ, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন (যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল, কক্সবাজার এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ), জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জীববৈচিত্র্য কৃষি, ফিশারি, গবাদি পশু, বনজ এবং প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটনের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দেশের জিডিপিতে এই পাঁচটি সেক্টরের সম্মিলিত অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন অর্ধ মিলিয়ন পরিবারের জন্য জীবিকা এবং কর্মসংস্থান সরবরাহ করে। প্রতিদিন ৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ জলজ সম্পদের উপর নির্ভর করে এবং দেশের ৬০ শতাংশ প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা মাছের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। জলাভূমি ইকোসিস্টেম (হাওর, বাওর, বিল এবং প্লাবন সমভূমি) মাছ এবং ধান উৎপাদনসহ স্থানীয় মানুষকে বিস্তৃত অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে। যেমন গরু, মহিষ এবং হাঁস পালন, ঘাস এবং অন্যান্য গাছপালা সংগ্রহ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হাকালুকি হাওর এর অর্থনৈতিক মূল্যায়ন সম্পর্কিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশেরও বেশি স্থানীয় পরিবার জলাভূমির জীববৈচিত্র্য সংস্থার উপর নির্ভর করে এবং এসব অঞ্চলে প্রচুর উপার্জন ও জীবিকার সুযোগ জলাভূমির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটন বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং দেশের প্রকৃতি ভিত্তিক পর্যটন গন্তব্যে দিন দিন দর্শনার্থী এবং পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাকস, সুন্দরবন এবং দেশের অন্যান্য সুরক্ষিত অঞ্চলে অনেক মানুষের জীবিকা প্রকৃতি-নির্ভর পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটন থেকে কত আয় হয়, তা এখনও দেশে সঠিকভাবে হিসাব হয় না। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো, জাতীয় অর্থনীতিতে জীববৈচিত্র্যের মূল্য সম্পর্কে নীতি নির্ধারকদের সীমিত সচেতনতা, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পরিবেশগত সুরক্ষার অবাধ্যতা বা ন্যূনতম সম্মতি, রাজস্ব দ্বারা পরিচালিত ভূমি ব্যবহার অনুশীলন, সুষ্ঠু পরিবেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে সীমিত সাফল্য, সীমিত আন্তঃসেক্টরাল পলিসিগুলোতে খাত সমন্বয় ও সমন্বয়করণ, বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস ও অবক্ষয়ের জন্য বাজার ভিত্তিক সরঞ্জামের অনুপস্থিতি (যেমন পলিউটার বেতন নীতি, সবুজ কর ইত্যাদি), স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা হ্রাসকরণ, বেসরকারী খাতের সীমাবদ্ধতা, মালিকানার ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং উপকার ভাগাভাগি জৈবিক সংস্থানসমূহের ব্যবহার, নিম্ন স্তরের জ্ঞান, সক্ষমতা এবং সচেতনতা, অপর্যাপ্ত অর্থায়ন ইত্যাদি। প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রমবর্ধমান চাহিদাসহ বিশাল জনসংখ্যার চাপ উপরের বর্ণিত হুমকির বেশিরভাগ মূল চালিকা শক্তি।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কনভেনশন (সিবিডি) সহ সকল বৃহৎ জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত বহুবিধ চুক্তি স্বাক্ষর বা অনুমোদন করেছে। সিবিডি’র বাধ্যবাধকতা পূরণে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রচেষ্টা পরিচালনার জন্য ২০০৬ সালে প্রথম জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (এনবিএসএপি) এবং ২০১৫ সালে ২য় এনবিএসএপি (২০১৬-২০২১) প্রণয়ন করেছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের এনবিএসএপি বৈশ্বিক আইনী জীববৈচিত্র্য লক্ষ্যমাত্রার সাথে মিল রেখে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ২০ টি লক্ষ্যমাত্রার অধীনে ৫০ টি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত নীতি ও আইনী কাঠামোও প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (২০১৬-২০৩১), বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন- ২০১৭, বন্যজীবন (সংরক্ষণ ও সুরক্ষা) আইন- ২০১২, জাতীয় বন নীতি-২০১৬ (খসড়া) ইত্যাদি। এর ফলে, বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর শঙ্কটাপন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদকূলকে রক্ষা করতে দেশের বিভিন্ন স্থান বাস্তু-সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কক্সবাজার, টেকনাফ, সোনাদিয়া, সেন্ট মার্টিন, হাকালুকি ও টাংগুয়ার হাওর। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তারপরও নিয়মিত হারে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে এবং প্রাণীকূল বাসস্থান হারাচ্ছে। এর ফলে মাঝে মাঝে শিকারী প্রাণী লোকালয়ে চলে আসছে এবং প্রায় সময় মানুষ এদের হত্যা করে। সেই সাথে খাদ্য সংকটে পড়ছে প্রাণীকূল। এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃতিক বাস্তুসংস্থানিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে এবং এর কুফল ভোগ করতে হবে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শুধুমাত্র কয়েকটি আলোচিত প্রজাতি রক্ষা করলেই জীববৈচিত্র্য রক্ষা হয় না। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সকল প্রকার জীব প্রজাতিকে সমান গুরুত্ব দেয়া। পরিবেশবিজ্ঞানের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীববৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবসমাজের উপকারে আসে। একটি স্থিতিশীল পরিবেশের সাথে মানুষের ভালো থাকার সম্পর্ক রয়েছে। আর এ সমস্ত লাভ ক্ষতির ঊর্ধ্বে উঠে নীতিগত ভাবেই জীবজগতের অন্য প্রাণীদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা একান্ত অপরিহার্য। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের স্বার্থে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা আবশ্যক।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজন। তাই এর ভারসাম্য বজায় রাখতে সঠিক সংখ্যায় সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ মানুষকে বুঝাতে হবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় না থাকলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জটিল সমস্যাগুলো পরিচালনা করার জন্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। আর তা করতে হবে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন