শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দল বেঁধে গাছ লাগান

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

উপকারী বন্ধু গাছ। গাছ প্রতি হেক্টরে ২৭% বৃষ্টির পানি ধরে রেখে, নয়শ’ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং সাতশ’ কেজি অক্সিজেন সরবরাহ করে আমাদের করে তোলে ঋণী। কাঠ আসবাবপত্র তৈরিতে এবং গৃহ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। শিশু, নিম, হরিতকি, তেঁতুল ইত্যাদি গাছ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। কুইনাইন আসে সিনকোনা গাছের ছাল থেকে। এছাড়া বিভিন্ন ফলমূল, ধান, গম, রাবার, চা, দারুচিনি, ডাল, মরিচ, পেঁয়াজ ইত্যাদি গাছের কথা নাইবা বললাম।

ভারতের দেরাদুন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে দেখা যায়, একটি গাছ যদি ৫০ বছর বাঁচে থাকে তবে: ১. অক্সিজেন দেয় ৫,০০,০০০ টাকার। ২. জীব জন্তুর খাদ্য দেয় ৩০,০০০ টাকার। ৩. মাটি ক্ষয়রোধ ও উর্বরতা বাড়ায় ৩,৫০,০০০ টাকার। ৪. আর্দ্রতা বাড়িয়ে বৃষ্টি ঝরায় ৩,০০,০০০ টাকার। ৫. রোদে ছায়া প্রদান করে ২,০০,০০০ টাকার। ৬. জ্বালানি কাঠ দেয় ১,০০০০০ টাকার। ৭. সবশেষে গাছ কেটে কাঠ ১,০০০০০ টাকার।

ইদানীং আমাদের দেশের বনভূমির সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বেশ ক’বছর আগের তথ্যই এখনও দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া শহরাঞ্চলে, বাড়ির আশেপাশের বনের হিসাব নেয়া হয়নি। অনেকের মতে, বাংলাদেশের বনের পরিমাণ ১৫% বা ১৬% কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা ৯% এর বেশি নয়।
অবহেলাই বৃক্ষ নিধনের প্রধান কারণ। লোভতো আছেই। পাকিস্তান আমলে ‘ওহপৎবধংবফ ঊীঢ়নরঃধঃরড়হ’ প্রজেক্ট নামে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট জুড়ে বৃক্ষ নিধন শুরু হয়। সহজগম্য এলাকা থেকে যদিও বন কাটা শুরু হয়েছিল বন উন্নয়ন পরিকল্পনা শেষ হওয়ার আগেই। প্রাকৃতিক বন কাটা আজ শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। কাঠ আহরণের পাশাপাশি বনায়ন এবং পুনঃবনায়ন কাজও তখন হাতে নেয়া হয়। কিন্তু যে হারে ও গতিতে কাঠ কাটা হয়েছে সেরূপ দ্রুত সম্পদ সৃষ্টি হওয়ার নয়। গাছ বড় হতে সময় লাগে। এদিকে জনসংখ্যার চাপে চাহিদাও বেড়ে গেছে বহুগুণ। তাই একই এলাকায় একাধিকবার বনায়ন করেও তা রাখা যাচ্ছে না। বন সংরক্ষণ বর্তমানে একটি লুকোচুরি, আবার কোথাও পুরোমাত্রায় ধস্তাধস্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এদিকে আবার রাজস্ব বিভাগ ও বন বিভাগের মধ্যে মালিকানার টানা-হেচড়া এবং জমিদারী আমলে বুর্জোয়া শাসনের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত শিথিল সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসার কারণে ভাওয়াল-মধুপুর, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের এবং সিলেটের বনাঞ্চলের অবক্ষয় শুরু হয়। ঢাকা মহানগরী ও সংলগ্ন শিল্প নগরীর ক্রমবর্ধমান কাঠ ও জ্বালানির চাহিদা পূরণের জন্য বেপরোয়াভাবে গাছ কাটা হয়। এদিকে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার ভাংগনে বাস্তুহারা এবং মায়ানমার থেকে বিতাড়িত মুসলমানরা বসতি স্থাপন ও চাষাবাদের জন্য বন ধ্বংস করে জবরদখল শুরু করে। অপর দিকে বনাঞ্চলে বসবাসকারী গারোসহ উপজাতীয় অধিবাসীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অ-উপজাতীয়দের সাহচর্যে থেকে স্থায়ী বসবাসের ধারা তাদের মধ্যে সূচিত হওয়ায় জীবন ধারণের প্রকৃতি ও মান পরিবর্তনের মানসে তারা আনারস, লেবু ও আম-কাঁঠালের বাগান এবং স্থায়ী কৃষি জমি তৈরির প্রক্রিয়ায় বহু বন বিনষ্ট করে চাষাবাদ করছে। বর্তমানে ভাওয়াল ও মধুপুর জাতীয় উদ্যান বলে ঘোষিত চৌহদ্দিতে কিছু হালকা বনাবৃত এলাকা ছাড়া সমগ্র গড় এলাকা এককালীন ঘন গজারী বনের পরিবর্তে ঝোপ ঝাড়ে পরিণত হয়েছে।

দেশে কাঠ উৎপাদনের জন্য অনুকূল আবহাওয়া উপযুক্ত প্রযুক্তি বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও অতীতে জনবিমুখ ও অদূরদর্শী বন ব্যবস্থাপনা রীতি অনুসরণের কারণে সরকারি বনাঞ্চল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকের কাঠ রপ্তানিকারক দেশ আজ আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতির কারণে কাঠের দাম চড়া হয়ে গেছে। বেকারত্ব ও অভাবের কারণে গাছ চুরি হচ্ছে হামেশা। গুটিকয় লোভী মানুষ গ্রামীণ বেকারদের কাজে লাগাচ্ছে। এদিকে পল্লী এলাকায় চাষাবাদ ও আবাসভূমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় বনভূমি জবরদখলের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। ধ্বংস হয়েছে বন।

বিগত দুদশক ধরে সারা বিশ্বে বনাঞ্চল ও বৃক্ষ সম্পদ সম্পর্কে সনাতন চিন্তাধারার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জ্বালানির প্রধান উৎস হিসাবে হাইড্রোজেন ও কার্বনের ক্রমহ্রাসমান পরিস্থিতি, গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির জন্যেই এই মনোভাবের পরিবর্তন, বিভিন্ন দেশে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। এগ্রো ফরেস্ট্রি সোসাল ফরেস্ট্রি কমিউনিটি ফরেস্ট্রি, পারমাকালচার ইত্যাদি বিভিন্ন শিরোনামে এসব নতুন উদ্যোগ আখ্যায়িত হলেও মূল লক্ষ্য হলো বন বা বনায়ন।

বাংলাদেশেও সাম্প্রতিককালে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার এনজিও এবং জনগণ একসাথে কাজ করছে। বনবিভাগ কর্তৃক গৃহীত চট্টগ্রামে বেতাগী ও পোমরা কমিউনিটি ফরেস্ট্রি প্রকল্প, দিনাজপুর, রংপুর ও রাজশাহীতে কমিউনিটি ফরেষ্ট্রি কার্যক্রম এবং ডিআরএস প্রশিকা প্রভৃতি এনজিও কর্তৃক বিভিন্ন সড়কে স্ট্রিপ বাগান সৃজন, গজারী কপিচ বন সংরক্ষণ ইত্যাদি কর্মসূচী বনায়নের নতুন উদ্যোগ ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ করে। কৃষিখাতে চলছে, এগ্রো ফরেস্ট্রি প্রকল্প। সামাজিক বনায়নও হাতে নেয়া হয়েছে। সরকারের একটি ব্যয়বহুল ও বৃহৎ প্রকল্প উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশের বনজ সম্পদ বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে। প্রতিবছর সরকার বিটিসিসহ বিভিন্ন এনজিও লক্ষ লক্ষ চারা বিতরণ করছে। কখনও বিনামূল্যে কখনও স্বল্পমূল্যে, এতেও কিছু কাজ হচ্ছে। বর্তমান সরকার কয়েক বছরের জন্য বনাঞ্চলে গাছ কর্তন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। এটাও নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গাছতো কাটা হচ্ছেই, সহযোগিতা পাচ্ছে অসৎ বনকর্মকর্তাদের কাছ থেকে। তাদের দেশপ্রেম নেই।

সমগ্র দেশে বৃক্ষের পরমিাণ বৃদ্ধির জন্যে সরকার সামাজিক বনায়নের প্রতি বিশেষ জোর দিচ্ছে। আশা করা যায়, এর দ্বারা সমগ্র বন পরিস্থিতিতে এক বিপ্লব আনা যাবে। সামাজিক বনায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত: ১. ভোক্তা পর্যায়ে বনজ সম্পদ সৃষ্টি ও চাহিদাপূরণ। ২. দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং দেশের দুষ্প্রাপ্য ভূমি/সম্পদের উপযুক্ত ও পূর্ণ ব্যবহার। ৩. দেশের সার্বিক পরিস্থিতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। ৪. বনাঞ্চল ধ্বংসকারী জনগোষ্ঠিকে বনজ সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সহায়তা দান। ৫. গ্রামীণ জীবনের গুণগত মান উন্নয়ন। শহরমুখী অভিযান রোধ করা।

আমরা নগরীকে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে আমরা আরও সুন্দর করে তুলতে পারি। এ ক্ষেত্রে বন-বিভাগ ও বিভিন্ন শিক্ষা ও সামাজিক সংস্থা, এনজিওদের এগিয়ে আসা উচিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাহাড়, মাঠ এবং পতিত জমিতে আরও বৃক্ষ রোপণের সুযোগ রয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন