রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

যুব শক্তি মূল্যবোধ ও যৌথ পরিবার

প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
একটি রাষ্ট্রের মূল শক্তি বলতে যুবশক্তি। এই যুব শক্তিই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে, বড় করছে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার। গার্মেন্ট শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে যুবশক্তি। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি যুবক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এসব খাত থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়েই মূলত বাংলাদেশ চলছে; বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে এবং বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যুব শক্তির ওপর লোলপ দৃষ্টি পড়েছে। এই যুবশক্তিকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। মগজ ধোলাই করে এই যুব শক্তিকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী বানানো হচ্ছে। অন্যদিকে ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ মাদক সরবরাহ করে যুবসমাজকে ঢেলে দেয়া হচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এটা অবশ্যই একটা ষড়যন্ত্র। এটা গভীরে যেতে হবে, কারা তাদের মগজ ধোলাই করছে, তা বের করতে হবে।
মগজ ধোলাইয়ের হোতাদের ধরে শাস্তি না দিয়ে, যারা ব্যবহৃত হচ্ছে তাদেরকে হত্যা করে কি সংকটের সমাধান হবে? না সংকট আরও বাড়বে? হোতারা আবার অন্য যুবকদের মগজ ধোলাই করবে, এভাবে গোটা যুবসমাজের মগজ ধোলাই করলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে? একদিকে গুলশান ও কল্যাণপুরের মতো তাদের গুলি করে হত্যা করতে হবে, অন্যদিকে যুবসমাজ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে চি‎িহ্নত হলে, এর প্রভাব পড়বে বিশ্ব শ্রমবাজারে; এক পর্যায়ে দেখা যাবে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী বলে বাংলাদেশের যুবকদের বিদেশে আর চাকরি হচ্ছে না।
মগজ ধোলাই করে বাংলাদেশের যুব শক্তিকে শুধু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী বানানো হচ্ছে না, মরণঘাতী নেশা ও অপসংস্কৃতির মরণব্যাধি বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের কুরে কুরে খাচ্ছে। খাচ্ছে তাদের ইচ্ছাশক্তি, কল্পনাশক্তি, মেধাশক্তি, দৈহিক শক্তি ও মানষিক শক্তিকেও। অন্যদিকে ধ্বংস করছে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে ওঠা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে। কথায় আছে, ‘একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে চাইলে, আগে তার সংস্কৃতিকে ধ্বংস কর।’ বাংলাদেশের অবস্থা সেরকমই হয়েছে। ফেনসিডিল আর ইয়াবার ছোবলে গোটা যুব সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে পরিকল্পিতভাবে মাদক তৈরির কারখানা স্থাপন করছে পার্শ্ববর্তী দেশ, যাতে আমরা ইসলামী ভাবধারায় একটি উন্নত জাতি গঠন করতে না পারি; যার জন্য স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও আমরা উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠন করতে সমর্থ্য হয়নি। উপরন্তু কোন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিতে আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তা আমরা নিজেই জানি না। তবে এটুকু জানি, একটা হ-য-ব-র-ল জাতি হিসেবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি অন্ধকার গহব্বরের দিকে। অথচ স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে, আগে প্রয়োজন উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠন। এর জন্য দরকার সৎ, দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শক্তিশালী সামাজিক নেতৃত্ব। কেননা, সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক গভীর, রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা আশা করা যায় না।
বিদেশি অপসংস্কৃতি, হেরোইন, ফেনসিডিল ও ইয়াবা জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে। তৈরি করছে মূল্যবোধহীন হাজারো সন্তান। তারা না চিনে নিজের দেশকে, না চিনে ধর্মকে, না চিনে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে; সর্বোপরি না চিনে নিজের বাবা-মাকে। এই সন্তানদের হাতে নৃশংসভাবে জীবন দিতে হচ্ছে বাবা-মাকে। আবার বাব-মায়ের হাতেও জীবন দিতে হচ্ছে সন্তানকে। আপন মমতাময়ী মাও নয়ন জুড়ানো প্রাণ ভরানোর মত আদরের সন্তানকে হত্যা করছেন নির্দয়, নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে। অপরূপা রূপসিরাও তাদের ভালোবাসার স্বামীদের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন। এমনকি শিক্ষকের কাছেও নিরাপদ নয় শিক্ষার্থী। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা লালসা চরিতার্থ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন শিশু ছাত্রীর ওপর। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধাক্কায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সোনার সংসার মুহূর্তেই ভেঙে যাচ্ছে।
নেশা ও অপসংস্কৃতির জালে জড়িয়ে এমনই মূল্যবোধহীন একটি জাতি নিয়ে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে; বাংলাদেশকে ডিজিটাল ও মধ্যআয়ের দেশ করার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রাজনীতিকরা। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে-যদি না মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠন করা না যায়। যদি না অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে জাতি বেড় করে আনা না যায়।
পারিবারিক মূলবোধের অবাব ও ধর্মীয় শিক্ষায় উদাসীনতাও সামাজিক অপারধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশে আজ অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে ইন্টারনেট সংযোগসহ মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোন। এই ফোনগুলোতে অনায়াসে অশীল ও পর্ণোছবি ডাউনলোড করা যায়। সাথের বন্ধুদের নিয়ে নির্জন জায়গায় বসে এসব পর্ণো ছবি দেখে থাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা। এ থেকেই তাদের মাঝে লোভ-লালসা-মোহ ও অপারাধ প্রবণতা জাগ্রত হচ্ছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সঙ্গে। তাতে সমাজে বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নারী নির্যাতন। এ ব্যাপারে পরিবারের দায়িত্ব অপরিসীম। দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রেরও। কেননা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও হতাশাগ্রস্তরাই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।
ভালো মানুষ বা অন্য ভালো যা অর্জন, তা সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই সূচিত হয়। সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা অনেকটা পরিবারের ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষের প্রথম নিরাপত্তা তার পরিবারে। পরিবার বলতে টুকরো টুকরো পরিবার নয়, যৌথ পরিবার; মানুষ গড়তে যৌথ পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। যৌথ পরিবারে মানুষের মন-মনন, মেধা ও নৈতিকতা-মূল্যবোধের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। আয়-উন্নতিও যৌথ পরিবারে বেশি হয়। সুতরাং যৌথ পরিবার গড়তে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রকে দিতে হবে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা; রাষ্ট্রের সার্বিক শাসন কাঠামোও হতে হবে যৌথ পরিবার গড়ার মুখী।
বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংখ্যা ত্রুমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে সমাজে দিনদিন ভয়ঙ্কর সব পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ট্র্যাজেডি, বাড়ছে মাদকাসক্তির সংখ্যাও। পরিবারে সংঘটিত নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাব কোনো না কোনো ভাবে রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়, বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে; রাষ্ট্রকে ‘ত্রুসফায়ারের’ নামে প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করেই টিকে থাকতে হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির জন্য একটি জাতির যেসব সামাজিক ও মানবীয় গুণাবলী প্রয়োজন তা নির্দ্বিধায় বলা যায় জাপানি ও চায়না পরিবারগুলোর মধ্যে আছে। জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধ, আধুনিক প্রযুক্তি ও কর্মনিষ্ঠা, স্বভাব-চরিত্র, অতিথিপরায়ণতা, পরপোকার, আত্মত্যাগ, আত্মসন্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ বিশ্বে যেকোনো জাতির জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য। যৌথ পরিবার গড়েই জাপানিরা এমন উন্নত নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অধিকারী হয়েছে।
যৌথ পরিবার চীনের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা বৈশিষ্ট্য। চীনা সভ্যতার লক্ষ্য হচ্ছে আদর্শ স্বনির্ভর গ্রাম গড়া। চীনের মানুষ বাস করেছে যৌথ পরিবার গড়ে। যৌথ পরিবার ব্যক্তিজীবনকে দিয়েছে নিরাপত্তা। চীনের মানুষ চেয়েছে আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তার মাধ্যমে আদর্শ মানুষের জীবন গড়ে তুলতে। চীনের সভ্যতা অন্য সভ্যতার মতোই ছিল কৃষিভিত্তিক। চীনের যৌথ পরিবারগুলো গড়ে তুলেছে আদর্শ স্বনির্ভর গ্রাম, যেখানে বাড়িঘরগুলো নিরাপদ; জীবন উপভোগ্য ও আনন্দপূর্ণ। এক গ্রাম থেকে দেখা যাবে অন্য গ্রাম।
আমাদের সভ্যতাও কৃষিভিত্তিক। আমাদের মানুষরা সব সময় চেয়েছে স্বনির্ভর গ্রাম গড়তে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। এখন গ্রামের মানুষ শহরমুখী। শ্রম বিক্রি করতে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। তাতে গ্রাম ও শহরের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। গ্রামীণ সংঘবদ্ধ জীবনযাপনে অব্যস্ত মানুষ হঠাৎ শহরে এসে জড়িয়ে পড়ছে নেশাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে। এ প্রবণতা রোধ করতে হবে। গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে।
সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে, পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য। ইসলাম ধমে সৎ চরিত্র গঠনের নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্তানদের ছোট থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দেয়াও বাধ্যতামূলক। ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে উঠা সন্তানদের অন্তর্নিহিত শক্তি হয় পরিশুদ্ধ। অন্যায়, পাপাচার, কাম-ক্রোধ মোহ ও যাবতীয় লোভ-লালসা এবং অযাচিত চাওয়া-পাওয়া তাদের মনোবৃত্তিকে দুর্বল করতে পারে না।
ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছেলেমেয়েদের মূল্যবোধ তৈরি হয় পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার আলোকে, তাদের কাছে নর সুরক্ষিত, নারীও সুরক্ষিত; সুরক্ষিত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। তারা জানে অন্যের মা-বোনের ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট হলে, অনুরূপ ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট হবে তাদের মা-বোনদেরও। সুতরাং সমাজের ক্ষীয়মান মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হলে, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি সবার মনোনিবেশ করা অত্যাবশ্যক।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও হতাশাগ্রস্তরাই সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। তারা মানুষ হত্যার সাথে নিজেদেরও হত্যা করছে। গুলশান ও কল্যাণপুরে যারা মারা গেছে, তারা সবাই শিক্ষিত ও বয়সে তরুণ। তারা জঙ্গি ছিল না। তাদেরকে জঙ্গি বানানো হয়েছে। হয়তো আরও তরুণ ও যুবক তাদের মত বিপথগামী হয়েছে। রাষ্ট্রের কর্তব্য যুবকরা জঙ্গিবাদে কেন জড়িয়ে পড়ছে এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা। এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করা।
দেশের কোটি কোটি যুবক শরীরে বেঁচে থাকলেও তারা ভেতরে ভেতরে মরে গেছে। মরণঘাতী নেশা ও অপসংস্কৃতির ছোবল তাদের জীবনী শক্তি কেড়ে নিয়েছে। নেশা ও অপসংস্কৃতির মরণব্যাধি তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। খাচ্ছে তাদের ইচ্ছাশক্তি, কল্পনাশক্তি, মেধাশক্তি, দৈহিক শক্তি ও মানুষিক শক্তিকেও। যে দেশের যুব সমাজের বিরাট একটি অংশের এ পরিণতি, সে দেশের ভবিষ্যৎ কি? সে দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় কি? হ্যাঁ, উপায় আত্মজাগরণে ও মনুষ্যত্ব জাগরণে।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধণবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
liton gazi ৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:১৮ এএম says : 0
excllent write up
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন