করোনা মহামারীতে কারো ঘরে খাবার নেই। কেউ একলা ঘরে অচেতন! কেউ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে। ব্রিটেনের উপকূলবর্তী কাউন্টি সোয়ানসিতে এভাবে দিন কাটাতে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীদের ‘নাইটিঙ্গেল’ হয়ে দেখা দিয়েছেন সাজনীন আবেদিন নামের এক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি। ট্রিনিটি মিরর গ্রুপের সংবাদমাধ্যম ওয়েলস অনলাইনে সাজনীনের ‘এই অজানা গল্প’ তুলে ধরা হয়েছে।
জানা যায়, করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই সাজনীন সতর্ক হন। শুধু নিজের পরিবারের কথা না ভেবে গোটা কমিউনিটির জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নেন। নিজেকে সাজ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করা এই নারী পুরোদস্তুর ব্রিটিশ বনে গেলেও বিয়ে করেছেন বাংলাদেশে। করোনার শুরুতে সাজের মনে হয় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বাংলাদেশিরা বেশি ভুগছেন। এরপর এ সংক্রান্ত একাধিক গবেষণায় তার ধারণার প্রতিফলন দেখতে পান। আমরা তখন থেকেই নিজেদের রক্ষায় সত্যি সত্যি গুরুত্ব দেই। এরপর আইসোলেশনে নজর দেই। বন্ধ করা হয় মসজিদ। এভাবে পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে দিতে সাজ বলেন, একদিন বন্ধুকে ফোন করে শুনতে পাই তার মা কাঁদছে। ওই প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে কুরআনের তেলাওয়াত।
এরপর আসে ‘অদ্ভুত’ এক রমজান, ‘রোজার দিনগুলোতে মসজিদে নামাজ হয়নি। ইফতার হয়নি। ঈদে হয়নি কোনো উদযাপন। তারপর আরও বেদনার দিন, বাংলাদেশি কমিউনিটির এক ব্যবসায়ী মারা যান। তার ছোট ভাইকেও যেতে হয় হাসপাতালে। ওই ব্যক্তির মৃত্যু বাংলাদেশিদের ভেতর শোকের স্রোত বইয়ে দেয়। গোটা কমিউনিটি মুষড়ে পড়ে। কিন্তু জেগে থাকেন সাজ। তখন স্থির করি অন্যদের সাহায্য করতে হবে। নিজের বাড়ি থেকেই কাজ শুরু করি।সাজ অন্য মুসলিম নারীদের নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে খাবার বিতরণ শুরু করেন। অন্যদের সঙ্গে মার্চ, এপ্রিল এবং মে পর্যন্ত প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার বিলি করেছেন সাজ। এরপর তার ননদ গর্ভবতী হওয়ায় বাড়ি থেকে খাবার আয়োজনের কাজে মন দেন। এর জন্য টাকা এসেছে স্থানীয় কাউন্সিল এবং সোয়ানসি মসজিদ থেকে।
আয়েশা নামে সাজের এক সহকর্মী একদিন বয়স্ক এক মানুষের জীবন বাঁচান। খাবার দিতে গিয়ে দরজায় ‘নক’ করলে সাড়া পাননি। সন্দেহ হওয়ায় পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশ এসে দেখতে পান ওই ব্যক্তি শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। দরজা খোলার সাধ্য নেই। পরে অন্যদের সহায়তায় দরজা ভেঙে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।সাজ এসব করতে করতে কাউন্সিল প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে নিজের চাকরিও সামলেছেন। অধিকাংশ সময় কাজ করেছেন বাড়িতে বসে। তবে ইদানীং টাউনহিলে মাঝেমাঝে অফিস করতে হচ্ছে।
৪০ বছর বয়সী এই নারী সোয়ানসির কিছু বঞ্চিত এলাকায়ও সাহায্য করতে এগিয়ে যান। এসব দেখে একদিন তার বস প্রশ্ন করেন, ‘আপনার কি মরার সাধ হয়েছে? বাংলাদেশের জন্যও গভীর টান অনুভব করেন সাজ। সেই টান থেকেই দেশের খোঁজ-খবর রাখছেন নিয়মিত, ‘বাংলাদেশে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে করোনা। সেখানে এত ছুটি পাওয়া যায় না। অনেক কর্মীকে কাজ ফেলে গ্রামে ফিরতে হয়েছে। সাজের মতো আরেকজন সাহায্যকারী আব্দুল মোতালেব। তিনি যুক্তরাজ্যে যান ১০ বছর বয়সে। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে একটা রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন। এই সময়ে ব্যবসার জন্য যেমন চিন্তিত, তেমনি চিন্তিত স্বদেশীদের নিয়ে।
কেন বাংলাদেশিদের মৃত্যুহার বেশি, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। চামড়ার রংয়ের কোনো প্রভাব থাকতে পারে। যখন কয়েক জনের মৃত্যু খবর পাই, তখনই আমি সাবধান হই। অন্যদের সচেতন করি। কিন্তু আমার এক বন্ধু মারা যাওয়ায় আমরা সবাই ভেঙে পড়ি।৪৮ বছর বয়সী মোতালেব বন্ধুর কথা স্মরণ করে বলতে থাকেন, ও খুব হাসিখুশি ছিল। রমজানের সময় জানতে পারি খুব অসুস্থ। বয়স কম থাকায় ভেবেছিলাম ভালো হয়ে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন