বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

হিজরি সন মুসলিম উম্মাহর জাতীয় দিকদর্শন

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

এখন থেকে অর্ধ শতাব্দীকাল পূর্বে সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ সালে গঠিত হয়েছিল ওআইসি (ইসলামী সম্মেলন সংস্থা)। একই বছর ২১ আগস্ট ইসরাইল কর্তৃক মসজিদে আকসায় অগ্নি সংযোগের ঘটনার পটভূমিকাতে মরক্কোর রাজধানী রাবাতে অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রথম শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তবলীর মধ্যে চান্দ্র হিজরিবর্ষ অনুযায়ী হিসাব গণনা তথা মুসলিম উম্মাহর জাতীয় দিকদর্শন হিসেবে অনুসরণ করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেই হিজরি ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি প্রত্যেক সদস্যকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অনুসরণ করে চলার কথা বলা হয়। প্রাথমিক বছরগুলোতে বহু সদস্য রাষ্ট্রে হিজরিসন নিয়ে বিপুল আগ্রহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে ওআইসিভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মারাত্মক ফাটল, দ্ব›দ্ব, রক্তাক্ত সংঘর্ষজনিত কারণে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। তাদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দিলে হিজরি সনের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে। তবে এইটুকু আনুষ্ঠানিকতা অক্ষুণœ থাকে যে, রাষ্ট্র প্রধানদের মধ্যে ইসলামী নববর্ষ উপলক্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় হতো। কিন্তু এবার করোনাকারণে সেই গতানুগতিতাও বিলীন হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কোথাও কোনো টু শব্দ শুনা যায়নি।

চান্দ্র হিজরি বর্ষপঞ্জির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তথা মহিমা উপলব্ধি করতে হবে। ইসলামের ঐতিহাসিক মর্ম প্রেরণার উৎস হিজরতের পটভ‚মিকা ও হিজরি সনের ইতিহাস-কাহিনী বিস্মৃত হয়ে গেলে ইসলামের সত্যিকারের মর্মবাণী উপলব্ধি করা আত্মভোলা মুসলমানদের পক্ষে অবশ্যই কঠিন হবে। এ বিষয়টি নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা নি¤œরূপ:

মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর জন্মভ‚মি মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের ঘটনার সাথে স্মৃতি বিজড়িত হিজরিসন। চান্দ্রসনের প্রতিটি নয়া বছর বা বর্ষপঞ্জী যেমন স্মরণ করিয়ে দেয় ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিজয়-গৌরব ও এই বিশ^ধর্মের অবদান-কীর্তি, তেমনি হিজরি সনের প্রতিটি যুগ-কাল বা শতক-সহ¯্রাব্দ সৃষ্টি করে যাচ্ছে ইসলাম ইতিহাসের নব নব অধ্যায়। অবশ্য একই সাথে একথাও স্বীকার করতে হয় যে, ইসলামের সেই প্রাচীন শত্রæ শক্তিগুলো ইসলাম ও মুসলিম বিনাশী তৎপরতা নব নব ক্রুসেড সৃষ্টি করে চলেছে এবং তাদের সহযোগী হিসেবে ইসলামবিরোধিতা, বৈরিতার জাল বিস্তার করেছে সমগ্র মুসলিম সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সর্বস্থানে। আর মুসলমানদের ঐক্যের তীব্র অভাব, পরস্পর বিরোধ, হানাহানি এবং অনৈক্যের সুযোগে শত্রæশক্তিবর্গ মুসলমানদের ঘায়েল করার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

মুসলিম ঐক্য-সংহতির বৃহত্তর শক্তিশালী ঐতিহ্য-প্রতীক হিজরি চান্দ্রবর্ষ তথা হিজরি সন তারিখের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রতি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, বিশ^ সভ্যতায় ইসলামের যে অনন্য সাধারণ ভ‚মিকা ও অসামান্য অবদানের সূত্রপাত হয়েছিল হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। হিজরতে সেই অবদান-ভ‚মিকার অব্যাহত গতিধারা যুগে যুগে, শতকে শতকে, নব নব জাগরণ, ইসলামী চিন্তা-চেতানা এবং বিশ^ময় ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসারে এক মহাআলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি শতক মুসলিম জীবনে এক উজ্জ¦ল ভবিষ্যৎ বহন করে এনেছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে হিজরতের অবিস্মরণীয় ঘটনার কারণে। হিজরতের প্রতীক হিজরি সনের মূল্যায়ন করতে হবে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নবুয়ত রেসালত জীবনের মোট ২৩ বছর কালের মক্কী জীবনের ১৩ বছর অতিবাহিত হয় অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার মধ্যে। নবুয়ত লাভ ও নুযুলে কোরআনের সূচনাকাল থেকে প্রথমে তাঁকে গোপনে আল্লাহর বাণী প্রচার করতে হয়। মক্কার পৌত্তলিক কাফের মুশরিকদের তীব্র প্রতিরোধ এবং চাচা আবু তালেবের ঘাঁটিতে প্রায় তিন বছর অবরুদ্ধ জীবন ছিল এক ভীষণ পরীক্ষা। প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারে আদিষ্ট হওয়ার পর থেকে নবদীক্ষিত মুসলমানদের জীবনে কাফের-মোশরেকদের নিষ্ঠুর অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত থাকে। পৌত্তলিক কাফেরদের অকথ্য নির্যাতন হতে খোদ রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনোই রেহাই পাননি। মক্কায় শান্তিপূর্ণভাবে, স্বস্তির সাথে মুসলমানদের পক্ষে জীবন যাপন করা মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ভক্ত অনুসারী সাহাবানগণকে আবিসিনিয়ায় (হাবশায়) হিজরত করার পরামর্শ দেন। কিন্তু সেখানেও মুসলমানদের শান্তিতে বসবাস করতে দিতে মক্কার পাষাণ পৌত্তলিক কাফেররা প্রস্তুত ছিল না। তারা আবিসিনিয়ায় শাসনকর্তা নাজ্জাশীর দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে এবং তারা আবিসিনিয়ায় আশ্রয়গ্রহণকারী মুসলমানদের তাদের কাছে হস্তান্তর করার জন্য নাজ্জাশীকে উদ্বুদ্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তাদের এই চরম ব্যর্থতার গøানি তাদের মুসলিম বিদ্বেষ-বিরোধিতাকে আরো তীব্রতর করে তোলে। এবার তারা মক্কায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের প্রতি অত্যাচার-নির্যাতন আরো জোরদার করে। অপরদিকে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের আন্দোলনও রাসূলুল্লাহ (সা.) বেগবান করে তোলেন।

কাফের পৌত্তলিকরা যখন অনুভব করতে পারলো যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আসমানী দাওয়াত, তাঁর প্রচার, পয়গাম স্তব্ধ করা সম্ভব নয়, তখন তারা আরো নানা প্রকারের ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণনাশেরও চক্রান্তে লিপ্ত হয় এবং তাতেও ব্যর্থ হয়। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.)কে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ও ঠাট্টা-বিদ্রæপ থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই, যা তারা করেনি। রাসূলুল্লাহ (সা.) অসীম ধৈর্য ও সাহসের সাথে আল্লাহর পয়গাম প্রচার করতে থাকেন এবং হাজার বিরোধিতা-শত্রæতা সত্তে¡ও তিনি সত্যধর্ম প্রচার হতে একবিন্দুও সরে যাননি। কখনো কখনো কাফেররা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট নানা অযৈাক্তিক দাবি করে এবং তিনি সত্য নবী হলেও অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শনেরও দাবি জানায়, এরূপ অলৌকিক নিদর্শন দেখাতে পারলে তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি ঈমান আনবে বলেও প্রতিশ্রæতি দেয়। এক সময় তারা চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করে দেখানোরও দাবি জানায়। আল্লাহর নির্দেশে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অঙ্গুলি সংকেতে পূর্ণিমার চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে দুই পর্বতে পতিত হয়ে যায় এবং দাবিদার কাফেররা এই বিস্ময়কর অলৌকিক দৃশ্য সচক্ষে অবলোকন করে প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ঈমান আনা তো দূরের কথা, বরং এই ঘটনাকে তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জাদুমন্ত্র বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। অনুরূপ মেরাজের অপর বিস্ময়কর ঘটনাকেও তারা অবিশ্বাস করতে থাকে।

তেরটি বছর মক্কার মোশরেক, কাফেরদের নিষ্ঠুর অমানুষিক অত্যাচার-উৎপীড়ন এবং নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ফলে মুসলমানদের পক্ষে নিরাপদে জীবনযাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে রাসূলুল্লাহ (সা.) জন্মভ‚মি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। এই হিজরতের সময়েও কাফেরদের হয়রানির কোনো সীমা ছিল না। যাত্রা থেকে সওর গুহায় অবস্থানকাল পর্যন্ত একটি মুহূর্তও নিরাপদ ছিল না, কাফেররা গোয়েন্দা লাগিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে ধরার চক্রান্তে লিপ্ত থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ঐতিহাসিক হিজরত ঠেকাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। এই দারুণ প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর নিত্যসঙ্গী হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রা.) সহ শেষ পর্যায়ে নিরাপদে মদীনায় আগমন করতে সক্ষম হন এবং তাঁর হিজরতের স্থল মদীনা হতে শুরু হয় নবপর্যায়ে ইসলামের অভিযাত্রা। মদীনায় স্থাপিত হয় ইসলামী সাধারণতন্ত্রের প্রথম সদর দফতর এবং সেখানে প্রণীত হয় ঐতিহাসিক মদীনা চুক্তি, যা ‘মীসাকে মদীনা’ নামে খ্যাত। ৫২ দফাসম্বলিত এই মদীনা সনদকে বলা হয় বিশে^র প্রথম লিখিত সংবিধান। উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় আগমনের পর মক্কার পৌত্তলিক কাফেররা নবপর্যায়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে, তাদের এসব ষড়যন্ত্রের তালিকা সুদীর্ঘ, যার বিবরণ সীরাত গ্রন্থ পাঠে জানা যায়। এসব ষড়যন্ত্রের ফসল হলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত কাফেরদের যুদ্ধসমূহ এবং মুসলমানদের আত্মরক্ষামূলক জেহাদ অভিযান। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, মদীনায় মুসলমানদের নতুন শত্রæ হিসাবে দেখা দেয় ইহুদী চক্র এবং তাদের দোসর মোনাফেক, কপট বিশ^াসীরা। মক্কার কাফেরদের সাথে গোপন যোগসাজশে ইহুদী মোনাফেক চক্রগুলো মুসলমানদেরকে ধ্বংস-বিতাড়নের যে চক্রান্তে লিপ্ত ছিল তা ইতিহাসের একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়। ইহুদীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি তারা পদে পদে ভঙ্গ করতে থাকে। আর সুযোগমত আশপাশের খ্রিস্টানশক্তিও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে, কয়েকটি যুদ্ধ বাঁধিয়ে মুসলমানদের ক্ষতিসাধন অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। মহানবী (সা.) এর মদীনায় হিজরত ইসলামকে নবজীবন দান করে। মদীনা থেকেই ইসলামের বিশ্বব্যাপী উত্থান বিজয় সূচিত হয়। এই উত্থান ও বিজয়পর্বের স্মরণে হিজরিসন প্রবর্তিত হয়। হিজরিকে অনুসরণ করার জন্য ওআইসির গুরুত্ব বা তাকিদের এটাই মর্মকথা।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
ABM Abdur Rahman ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৫:০৬ এএম says : 0
Excellent Video
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন