রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

সিদ্দিকী যুগে লেখা কোরআন উদ্ধার

প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কে এস সিদ্দিকী
(২৯ জানুয়ারি প্রকাশিতের পর)
 পূর্বে প্রকাশিত খবরটিতে আরও সুসংবাদ রয়েছে যে, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সন্ধান পাওয়া প্রাচীন কোরআনের পাতা দুটি খুব সম্ভবত প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ রূপে সংকলিত কোরআনের অংশ। এটি প্রথম খলিফা আবু বকরের ছিল বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। গত জুলাইয়ে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের সবচেয়ে প্রাচীন সংস্করণের কিছু অংশ খুঁজে পাওয়ার দাবি করে। এ দাবির যৌক্তিতা ও সত্যতা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এরূপ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, প্রতœতত্ত্ববিদদের এ যাবৎকালের বহু আবিষ্কার সত্য প্রমাণিত হয়েছে এবং বহু গবেষণালব্ধ তথ্য নির্ভুল ও সঠিক প্রমাণিত হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের দ্বারা স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছে। সুতরাং একজন মুসলিম গবেষকের এ প্রাচীন কোরআনের সংস্করণ আবিষ্কার সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগ কোথায়?
প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, হাতে লেখা ওই পা-ুলিপিটির রেডিওকার্বন পরীক্ষার পর সেটি কমপক্ষে এক হাজার ৩৭০ বছর আগে লেখা হয়েছিল বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ দাবি বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। অনেকে দাবির সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু এখন মধ্যপ্রাচ্য সূত্রও বিশ্ববিদ্যালয়টির দাবিকে সমর্থন করছে। ওই সূত্রের দাবি, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গী খলিফা আবু বকর (রা.) কোরআনের প্রথম যে সংস্করণটি সংকলন করেছিলেন, ওই পাতা দুটি তার অংশ। মুসলিম বিশ্বের জন্য এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অপূর্ব আনন্দ বয়ে এনেছে এবং এসব আবিষ্কারের ফলে ইসলামী ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইসলামবিদ্বেষী লেখক-গবেষকরা আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরবর্তীকালে কোরআন লেখা হয়েছে বা সংকলন করা হয়েছে। এ দাবি প্রতিষ্ঠিত করা গেলে বলা সহজ হয়ে যায়, কোরআন অক্ষত নেই, তাতে রদবদল করা হয়েছে। কেননা, খ্রিস্টান ইহুদিদের আসমানি গ্রন্থগুলো রদবদল ও বিকৃত হয়ে আসল রূপ হারিয়ে ফেলেছে এবং সেগুলো নকল ভেজালের সমষ্টি। আর এ কথা স্বীকৃত সত্য। সুতরাং মুসলমানদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি আল্লাহর নাজিলকৃত কোরআনও আসল অবস্থায় বিদ্যমান নেই, এটিও সংশয়যুক্তÑ এ অসত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অসৎ লক্ষ্যে ওদের প্রচারণা অব্যাহত আছে।
পবিত্র কোরআন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় লেখা হয়েছিল। এ সম্পর্কে কিছুটা বিবরণ আমরা উপরে তুলে ধরেছি। আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে আধুনিক যুগের বিখ্যাত বিজ্ঞান গবেষক ফ্রান্সের অধিবাসী ডা. মরিস বুকাইলির অভিমত উল্লেখযোগ্য। তার ফরাসি ভাষায় রচিত লা বাইবেল লা কোরআন য়েট লা সাইন্স গ্রন্থটি ইংরেজি, আরবি, উর্দু এবং বাংলাসহ দুনিয়ার বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান শিরোনামে বাংলা ও উর্দু সংস্করণও হয়েছে। ‘কোরআনের আমলত্ব কীভাবে তা লেখা হয়’ শিরোনামে বিষয়টির পূর্ণ বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। ২৩৮ পৃষ্ঠার বইটি অনুবাদ করেছেন ওসমান গনি, ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম প্রকাশ, পরিচালক : আলকোরআন একাডেমি,  ঢাকা এবং পরিবেশক প্রীতি প্রকাশনা। আলোচ্য অধ্যায়ে কোরআন ও বাইবেলের মধ্যে সংক্ষেপে তুলনামূলক আলোচনায় বলা হয়েছে, বাইবেলের বিষয়বস্তু কীভাবে রদবদল তথা বিকৃত করা হয়েছে এবং কোরআন কীভাবে লেখা হয় তা ব্যক্ত করা হয়।
ফরাসি বিজ্ঞানী সার্জন ডা. মরিস বুকাইলি তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান-এর ভূমিকায় মুসলমানদের সম্পর্কে এবং বিশ্ব নবী মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা ও ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয় এভাবে তুলে ধরেছেন :
‘তাদের অজ্ঞতার পেছনে এমন কি বর্তমানকালেও ‘মোহামেডান’, ‘মোহামেডান জাতি’ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহারের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এসব শব্দ ও বাগ্্ধারা ব্যবহার করে তারা এমন একটি মিথ্যা ধারণা প্রচার করেছে যে, এ ধর্ম বিশ্বাস (মুহাম্মদ নামক) একজন মানুষের দ্বারা প্রচলিত হয়েছে এবং আল্লাহর (খ্রিস্টান ধর্মীয় অর্থে) যেখানে কোনো ভূমিকা নেই। পাশ্চাত্যের অনেক সুধী বিজ্ঞজন এখন ইসলামের দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, কিন্তু তারা ইসলামের খোদ আসমানি কালাম সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর নেন না। অথচ ওই কালাম সম্পর্কে তাদের প্রথমেই খোঁজ নেয়া উচিত।’
মরিস বুকাইলি পাশ্চাত্যের একটি মিথ্যা ধারণা প্রচার করার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আরও বলেন :
‘কোনো কোনো খ্রিস্টান মহলে মুসলমানদের যে কী ঘৃণার চোখে দেখা হয় অনেকে তা আন্দাজও করতে পারেন না। এ ব্যাপারে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। একবার আমি একই বিষয়ে বাইবেল ও কোরআনে বর্ণিত কাহিনীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার শ্রোতারা এমন কি সাময়িক আলোচনার জন্যও কোরআনের কোনো বর্ণনাকে ভিত্তি হিসেবে মেনে নিতে চায়নি। তাদের ধারণা, কোরআন থেকে কিছু উদ্ধৃত করার অর্থই হচ্ছে খোদ শয়তানের প্রসঙ্গের অবতারণা চর্চা।
ইসলাম ও কোরআন সম্পর্কে ডা. মরিস বুকাইলি পাশ্চাত্য জগতের মিথ্যাচার ও ভ্রান্ত ধারণার যে চিত্র অংকন করেছেন তা তার নিরপেক্ষ ইতিহাস চিন্তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তার যুক্তি-প্রমাণ মুসলমান বিজ্ঞানী মনীষী ও লেখক গবেষকদের চিন্তাধারাকেও শক্তিশালী করবে। তাছাড়া খ্রিস্টান-ইহুদি নাস্তিকরা কোরআন লেখা ও সংকলন সম্পর্কে যেসব আপত্তি উত্থাপন করে থাকে এবং বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়, ডা. মরিস বুকাইলি নিরপেক্ষতা ও মততার সঙ্গে সেসব মিথ্যাচারের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন, পুস্তকের তৃতীয় অধ্যায়ের নানা স্থানে তা স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। বিশেষভাবে কোরআনের আমলত্ব কীভাবে তা লেখা হয় শিরোনামে তার অনেকটা বিবরণ রয়েছে। এ মনীষীর সে লেখা থেকে আমাদের আলোচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু অংশ বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ থেকে নি¤েœ উদ্ধৃত করতে চাই। বুকাইলি বলেন : ‘কোন অহি নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবী ও তার সঙ্গীগণ তা মুখস্থ করে ফেলতেন এবং তার অনুসারীও নিযুক্ত লেখকগণ তা লিখে ফেলতেন। সুতরাং কোরআনের শুরুই দুটি বৈশিষ্ট্য দিয়েÑ মুখস্থ করা ও লিখে ফেলা এবং এ দুটিই হচ্ছে আমল হওয়ার প্রমাণ। বাইবেলের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বৈশিষ্ট্যও নেই, আমল হওয়ার প্রমাণও নেই। কারআন মুখস্থ করা ও লিখে ফেলার ওই প্রক্রিয়া মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সেই আমলে যখন অনেকেই লেখাপড়া জানত না অর্থাৎ লিখতে পারত না, কিন্তু সবাই মুখস্থ করতে ও আবৃত্তি করতে পারত তখন একটি বিরল সুবিধা ছিল এই যে, অহি লিখিত আকারে সংকলনের সময় একাধিক মানুষের আবৃত্তির সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা সম্ভব ছিল।’
কোরআনের অহি জিবরাইল ফেরেশতার মারফত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়েছিল। এ নাজিল হওয়া বিশ বছরেরও অধিককাল ধরে চালু ছিল। প্রথম নাজিল হয়েছিল ৯৬ নম্বর সূরার (আল-আলাক) কয়েকটি আয়াত, তারপরে তিন বছর ধরে আর কোনো অহি নাজিল হয়নি। তিন বছর পর আবার অহি নাজিল হতে থাকে এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে নবীর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চালু থাকে। এ ২০ বছরের প্রথম ১০ বছর ছিল হিজরতের (৬২২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা হতে মদিনা গমন) আগের এবং পরের ১০ বছর ছিল তারপরে।’ (পৃ. ১৩১)
ডা. বুকাইলি তার গ্রন্থের নানা স্থানে নানা যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় কোরআন লিখিত ও সংকলিত হয়ে ছিল। তার বক্তব্যের সমর্থনে তিনি বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ প্রফেসর হামিলুল্লাহকে উদ্ধৃত করে বলেন :
প্রফেসর  হামিদুল্লাহ তার কোরআনের ফরাসি তরজমার ‘১৯৭১’ ভূমিকায় নবীর ইন্তেকাল পর্যন্ত সময়ে কোরআনের এবারত লিখিত হওয়ার সময় যে অবস্থা বিদ্যমান ছিল, তার একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সব বিশেষজ্ঞই এক মত হয়ে বলেছেন যে, যখনই কোনো অহি নাজিল হতো, তখনই নবী মুহাম্মদ (সা.) তার লেখাপড়া জানা সঙ্গীদের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে নিয়ে তা লিখিয়ে নিতেন এবং এ নতুন অহি আগে নাজিল হওয়া অহির পরম্পরায় কোন জায়গায় বসাতে হবে তা বলে দিতেন। লেখা হয়ে যাওয়ার পর লেখককে তিনি তা পড়ে শুনাতে বলতেন এবং লেখায় কোনো ভুল হয়ে থাকলে তা সংশোধন করে দিতেন। অপর একটি বিবরণে জানা যায় যে, প্রতিবছর রমজান মাসে নবী ওই সময় পর্যন্ত নাজিল হওয়া সমুদয় অহি তেলাওয়াত করে জিবরাইল ফেরেশতাকে শুনাতেন তার ইন্তেকালের আগের রমজানে জিবরাইল তাকে দিয়ে সমগ্র কোরআন দুবার পড়িয়ে নিয়েছিলেন এ কথা সর্বজনবিদিত যে, প্রতিদিন পাঁচবারের নামাজে কোরআন পাঠ করা ছাড়াও সেই মুহাম্মদ (সা.)-এর আমল থেকেই মুসলমানরা রমজান মাসে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে সমগ্র কোরআন পাঠ করতে অভ্যস্ত। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন যে, অহির এবারতের চূড়ান্ত সংকলনের সময় মুহাম্মদ (সা.)-এর ফাতেমা যায়েদ ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে কোরআন লেখা ও সংকলনের সঠিক ইতিহাসটি আমরা কিছুটা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। পরবর্তীকালে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত উমর (রা.)-এর পরামর্শ অনুযায়ী সেই কোরআনই সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা ঐতিহাসিক ঘটনা সবারই জানা। (আগামীবারে সমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন