মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্যের জন্য এক আইনজীবীর করা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন আদালত। সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পর ২৫ জানুয়ারি ২০১৬ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ১২৩(ক)/১২৪(ক)/৫০৫ দ-বিধিতে মামলাটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন আহমদ। তিনি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদেরও সদস্য।
উল্লেখ্য যে, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। আজকে বলা হয়, এত লাখ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে’। বাদীপক্ষের আইনজীবীদের ভাষ্য, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে’ খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের পর মমতাজ উদ্দিনের একটি আবেদন পর্যালোচনা করে বিএনপির চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহ মামলা করার অনুমতি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মামলার আরজিতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা আমলে নেয়ার পাশাপাশি গ্রেপ্তারি পরোয়ানারও আবেদন করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মমতাজ উদ্দিন ওই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কাছে সহায়তা চান। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন। মন্ত্রণালয় ২১ জানুয়ারি ২০১৬ তাকে মামলা করার অনুমতি দেয় (সূত্র : প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬)।
বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। দাবি উঠে এই মামলা প্রত্যাহারের। কারণ তাদের ভাষায় শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বেগম জিয়ার বক্তব্যে রাষ্ট্রদ্রোহের কোনো উপাদান নেই এবং এই মামলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে রাষ্ট্রদ্রোহের কিছু নেই। তিনি বলেন, দ-বিধির ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের যে সংজ্ঞা দেয়া আছে, খালেদা জিয়ার বক্তব্য এ সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। রাষ্ট্রদ্রোহ হয় যদি কেউ সরকার উৎখাতের চেষ্টা করে। যদি কেউ সরকারের প্রতি জনগণকে উস্কে দেয়ার জন্য বক্তৃতা দেয়, তাহলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ। এখানে খালেদা জিয়া কোনো রাষ্ট্রদ্রোহ করেননি। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম-এর ভাষ্য, ‘এ রাষ্ট্র হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, শহীদদের রক্তে। এজন্য রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের আত্মত্যাগ একসঙ্গে দেখতে হবে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে কটাক্ষ করা মানে এই রাষ্ট্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে কটাক্ষ করা। এর চেয়ে বড় রাষ্ট্রদ্রোহ আর কী হতে পারে? দ-বিধিতে কী বলা হলো না হলো তা দেখার দরকার নেই’ (সূত্র : প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬)।
প্রবীণ আইনবিদ ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য রাজনৈতিক বক্তব্য। এই বক্তব্যে কোনোভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ হয় না। এটা পলিটিক্যাল ভিকটিমাইজেশন। এই সরকারকে ডোবানোর জন্য এসব করা হচ্ছে। সরকারকে ডোবাতে এটাই সর্বশেষ। ডুবতে চাইলে এভাবেইতো ডোবে। আইনবিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহের পেনাল কোডে যে সংজ্ঞা আছে একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক বক্তব্যে বা এ ধরনের মতামত কোনোভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে না। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও মিথ্যা অভিযোগ। শহীদদের সংখ্যা বিষয় নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার জন্য যেসব উপাদান দরকার, এখানে তা নেই। রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে কোনো উপাদান না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার অনুমোদন দিলো তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহ এত সোজা জিনিস নয়। বেগম জিয়া তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার অনুমোদন দিতে পারে না। ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছে সরকার’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। বেগম জিয়ার বক্তব্যে কোনোভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহ হয়নি। সরকার রাজনৈতিক হয়রানি ও প্রতিহিংসাবশতই এই মামলা করেছে। এটা খারিজ যোগ্য।
এছাড়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বিএনপির চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাকে অমার্জনীয় অপরাধ বলে মন্তব্য করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কথা বলে বেগম জিয়া কী এমন অপরাধ করেছেন যে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হবে? ২৪ জানুয়ারি ’১৬ রাতে চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “...বেগম খালেদা জিয়া যা বলেছেন, তা বলা উচিত ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। উনি (প্রধানমন্ত্রী) অনেক ভালো ভালো কাজ করছেন, উন্নয়নের ধারা বইছেন। ইতিহাসকে সঠিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও তো তার। এটাতো শেখ হাসিনার বলার কথা এবং অনেক আগেই বলা উচিত ছিল। আর বেগম খালেদা জিয়া যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন তখনও তিনি বলতে পারতেন। কিন্তু পরে হলেও এ কথার মাধ্যমে সত্য বলার সাহস দেখিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। আমি শেখ হাসিনাকে বলবÑ তিনি শত বছরের শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার উচিত ইতিহাসে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। যেটা তার পিতা শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন।”
এটি স্বীকার করতে দ্বিধানেই যে, এখনও অনেকেই শহীদের তালিকাভুক্ত হতে পারেনি বা করা হয়নি বলে অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে যা কাম্য নহে। অতি সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাকে (২৫ জানুয়ারি ২০১৬) একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। উক্ত সংবাদে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পরও শহীদের মর্যাদা পাননি পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার উপজেলার চকদৌলত বাজিতপুর গ্রামের ১১ জন গ্রামবাসী। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনী বাজিতপুর ও চকদৌলত গ্রামে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করার দায়ে তাদের হত্যা করে। এরা হলেন, আব্দুল আজিজ মন্ডল, তায়েজ উদ্দীন মন্ডল, হোসেন উদ্দিন মন্ডল, জাহান আলী সরদার, জফি উদ্দীন সরদার, সফি উদ্দিন সরদার, গায়েন উদ্দিন মঞ্জু, কপিল উদ্দীন, আজিম উদ্দীন, মোফাজ্জল হোসেন ও সোহেল হোসেন। এদের মধ্যে আব্দুল আজিজ মন্ডল, তায়েজ উদ্দীন মন্ডল, হোসেন উদ্দিন মন্ডল, জাহান আলী সরদার, জফি উদ্দীন সরদার ও সফি উদ্দিন সরদারকে লাটাকুড়ি নামক পুকুর পাড়ে গুলি করে হত্যা করে পাক-বাহিনী। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর গত ২০১৫ সালের মার্চে চকদৌলতপুর গ্রামে জেলা পরিষদের উদ্যোগে এ গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ জনের নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও হত্যার শিকার এসব গ্রামবাসীর নাম সরকারি গেজেটে স্থান পায়নি। তাদেরকে এখন পর্যন্ত শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়নি। পাক হানাদার বাহিনী শুধু ওই দিন ১১ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, অগ্নিসংযোগ করে গ্রামের প্রায় ৫০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
’৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক দেশটিকে সংযোজিত করতে পেরেছি। এই যুদ্ধে শহীদ ও আহত প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধার (শহীদ কিংবা জীবিত কিংবা মৃত) প্রতি ফোটা রক্তই আমাদের কাছে বড়ই পবিত্র এবং স্বাধীনতার চরম মূল্য। এই ঋণ শোধ করা জাতির পক্ষে সম্ভব নয়। একই কথা প্রযোজ্য দুই লক্ষ মা বোনের ত্যাগের বিষয়েও। কিন্তু জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে, শহীদের সংখ্যা, আহতদের সংখ্যা, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা, নির্যাতিত মা বোনদের সংখ্যা নিয়ে কোনো প্রকার অস্বচ্ছতা বা প্রশ্ন কিংবা বিভ্রান্তি থাকাও উচিত নয়। কোনো ধরনের বিভ্রান্তি, প্রশ্ন থাকলে কিংবা অসংগতি মনে হলে তা জরুরি ভিত্তিতেই দূর উচিত কিংবা দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দীর্ঘ ৪৫ বছরে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদের সঠিক তালিকা, আহত মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের সংখ্যা ও তালিকা করতে না পারাটা চরম দুঃখজনক। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার থেকে শুরু করে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সব সরকারেরই এটা ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায়ভার কোনো সরকারই কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাষায় শহীদদের তালিকা আজও না করা অত্যন্ত অশিষ্টাচার। এদিক থেকে বিলম্বে হলেও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে শহীদদের প্রকৃত তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশের তাগিদ রয়েছে যা স্বাধীনতাপ্রিয় দেশবাসী ও শহীদ পরিবারগুলোর প্রাণের দাবি। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সঠিক ইতিহাস জানার প্রয়োজনেই এটি এখন সময়ের দাবি। এছাড়া জাতির মর্যাদার জন্য শহীদ ও নির্যাতিত নারীদের প্রত্যেককে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো আমাদের কর্তব্য এবং এটি অপরিহার্যও বটে।
তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে অবিলম্বে সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে সরকার ও সংসদে বিরোধীদল, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম রাজনৈতিক দলসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতিত নারী এবং ভারতে শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুবরণকারীদের তালিকা প্রস্তুত করবে। এটি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের মহৎ আত্মদান যা জাতির জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। এটি করতে পারলে তা হবে বর্তমান সরকারের বড় অর্জন। সমুজ্জ্বল হবে সরকারের ভাবমূর্তি। দূর হবে অযাচিত বিতর্ক। লিপিবদ্ধ হবে সঠিক ইতিহাস।
চরম দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় বেগম জিয়া একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও শহীদদের সঠিক/প্রকৃত তালিকা প্রস্তুত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এটি নিঃসন্দেহে তার সরকারের ব্যর্থতা। কিন্তু এতদিন পরে আজ বেগম খালেদা জিয়া অনুধাবন করতে পেরেছেন যে শহীদের সঠিক তালিকা প্রস্তুত করে তাদেরকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা দরকার। যাতে কোনো অবস্থাতেই সত্যিকারের কোন শহীদ তালিকা থেকে বাদ না যায় এবং একই সঙ্গে মিথ্যা কোনো ব্যক্তি শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয়। একই কথা প্রযোজ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের ক্ষেত্রেও। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও দায়িত্ব শহীদদের প্রকৃত তালিকা প্রস্তুতের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট-এর প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্যের সঙ্গে একমত যে, ‘হত্যাকারীরা তালিকা করে হত্যাকা- ঘটায় না এবং হত্যা করার পর তারা সেই তালিকা প্রকাশও করে না। কাজেই সবাই একটা আনুমানিক সংখ্যা বলে থাকেন। আমাদের বাংলাদেশের বেলাতেও তাই হয়েছে। একটা আনুমানিক সংখ্যা বলা হয়েছে। একাত্তর সালে প্রায় এক কোটি শরণার্থী দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। তাদের একটা বড় অংশ রোগে-শোকে মারা গেছে। তাদের সংখ্যাটা ধরা হলে শহীদের সংখ্যা খুব সহজেই ত্রিশ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে’। কিন্তু প্রফেসর জাফর ইকবালের একথার সঙ্গে আমি কোনোমতেই একমত না যে, ‘‘এই বক্তব্যের মাধ্যমে বেগম জিয়া এই দেশের শহীদের অসম্মান করেছেন’’। এছাড়া তার ভাষায় জরিপ করে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা বের করা সম্ভব না। জরিপ করে মানুষের পছন্দ-অপছন্দের কথা জানা যায় কিন্তু একটি তথ্য বের করে ফেলা যায় সেটি আমি জন্মেও শুনেনি’ (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬)। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফের বক্তব্য, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে গণহত্যার সংখ্যা অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। হানিফ এবং প্রফেসর ইকবালের এই বিষয়ে বক্তব্য অনেকটাই সত্য হলেও একাত্তরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে/স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যাকা-ের শিকার শহীদদের সঠিক তালিকা করতে না পারার কোনো কারণ ও যুক্তি আছে বলেও আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের জনসংখ্যা (আদম শুমারী) ও ভোটার সংখ্যা নিরুপণ যদি করা সম্ভব হয় তবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের সঠিক তালিকা করা যাবে না কেন?
পরিশেষে একথাটি বলতে দ্বিধা নেই যে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ক্ষমতা লিপ্সার পাশাপাশি বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার যে অপচেষ্টা চলছে সেটির কারণে সরকার/সরকারি দল এবং জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির মধ্যেকার তিক্ততার বর্হিপ্রকাশ এসব বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্য এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারের হামলা-মামলা। এটি অবিলম্বে দূর করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলে তবেই দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদভাব সৃষ্টি হবে এবং দূর হবে নানা বিষয়ে বিতর্ক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিধায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশবাসীর প্রত্যাশাও এটি।
লেখক : প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস ও সাবেক প্রো-ভিসি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mondal52@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন