হোসেন মাহমুদ
পাশ্চাত্যসহ বিশ্বের এক বিরাট অংশ যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমনে একাট্টা, তখন তার নিচে চাপা পড়ে গেছে অথবা পড়তে চলেছে ন্যূনতম পক্ষে বিশ্বের পাঁচটি স্বাধীনতা বা স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম : ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, চেচনিয়া, রোহিঙ্গা ও উইঘুর। এ স্বাধিকারকামীদের সকলেই হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠিভুক্ত। এসব সংগ্রামে এক সময় বহু প্রাণহানি ঘটেছে। বহু দশকের রক্তপাতের পর অবস্থা বিপাকে সাম্প্রতিককালে এসব আন্দোলন-সংগ্রাম স্তিমিত বা অবলুপ্তপ্রায়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছে ও ঝরছে কাশ্মীরে।
কাশ্মীরে সর্বশেষ সহিংসতার অধ্যায় শুরু হয়েছে গত মাসে ভারতীয় সৈন্যরা কাশ্মীরের অত্যন্ত জনপ্রিয় তরুণ স্বাধীনতাকামী নেতাকে হত্যা করার পর। এ হত্যার বিরুদ্ধে প্রচ- অসন্তোষ, ঘৃণা, প্রতিবাদ বিক্ষোভে এখন কাশ্মীর টালমাটাল। ইতিহাস বলে, ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের এ অসন্তোষ নতুন ঘটনা নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মধ্যে এর মূল নিহিত রয়েছে। সে সময় কাশ্মীরকে দুটি স্বাধীন দেশ ভারত বা পাকিস্তানের যে কোনো একটিতে যোগ দিতে বলা হয়। কিন্তু মুসলিম প্রধান কাশ্মীরের অ-জনপ্রিয় হিন্দু শাসক মহারাজা হরি সিং প্রথমে স্বাধীন থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু পরে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। উল্লেখ্য, রাজা ছিলেন হিন্দু, কিন্তু কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই ছিল মুসলমান। রাজা হরি সিং শাসক হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন না। মুসলমানদের এক বিরাট অংশ তার বিরোধী ছিল।
এদিকে কাশ্মীরের পুঞ্চ এলাকায় এ সময় মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। রাজা তা কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় মুসলমানদের সাহায্যার্থে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র উপজাতীয়রা কাশ্মীরে প্রবেশ করে। এ অবস্থায় হরি সিং ভারতের সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। কাশ্মীর ভারতে যোগ দেবে শর্তে ভারত সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। হরি সিং তাতেই রাজি হন, তবে তিনি বলেন, যে ভারত ইউনিয়নের মধ্যে কাশ্মীরকে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ভারতের হাতে কাশ্মীরের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও টেলিযোগাযোগ তুলে দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এ চুক্তির পর ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে। তারা পাকিস্তানি উপজাতীয়দের বিতাড়িত করতে লড়াই শুরু করে। এ সময় কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক নেতা ও পাকিস্তান বিরোধী শেখ আবদুল্লাহর অনুসারীরা ও জম্মুর হিন্দুরা ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপক সহায়তা করে। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল স্যার ডগলাস গ্রেসিকে নির্দেশ দিলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ডমার্শাল ক্লড অকিনলেকের ইঙ্গিতে তিনি তা অমান্য করেন বলে জানা যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্য ও উপজাতীয়দের হটিয়ে রাজধানী শ্রীনগরসহ কাশ্মীরের প্রধান অংশ নিয়ন্ত্রণে নেয়। অবশেষে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতি হয়। কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের দখলীকৃত অংশের ভিত্তিতে দু’দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। দু’অংশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় নিয়ন্ত্রণ রেখা। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ভারত অঙ্গীকার করে যে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছানুযায়ী কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু পরে ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে সে গণভোটের আয়োজন আর করেনি। এদিকে দেখা যায় যে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে হিন্দু রাজা কাশ্মীরের শাসনভার হিন্দু ভারতের হাতে তুলে দেন। কিন্তু পরে ভারত সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের চুক্তি লঙ্ঘন করায় ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরীদের অসন্তোষ শুরু হয়। ক্রমে ভারতের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কাশ্মীরীদের প্রতিবাদ কঠোর রূপ গ্রহণ করে। পাকিস্তান জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে কাশ্মীর সমস্যা উত্থাপন অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে ভারত কাশ্মীরকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। নয়াদিল্লী বলে, কাশ্মীরের আইনপ্রণেতারা নয়াদিল্লীর সাথে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি অনুমোদন করেছেন।
এ অচলাবস্থা অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তান ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাতে ভূখ-গত পরিবর্তন ঘটেনি। তারপর দু’দেশের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়, কিন্তু অচলাবস্থা কাটেনি।
মধ্য ’৮০-তে কাশ্মীরের ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক গ্রুপগুলো ঐক্যবদ্ধ হয় এবং বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নেয়। মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট দ্রুত কাশ্মীরের ভারতপন্থি রাজনৈতিক মহলের বিরুদ্ধে বিরাট শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে ফ্রন্ট হেরে যায়। ব্যাপক কারচুপি করে তাদের হারিয়ে দেয়া হয় বলে বিশ্বাস। এর পরিণতি হয় নেতিবাচক। ফ্রন্টের কিছু তরুণ সীমানা পেরিয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পৌঁছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহের পূর্ণ বিস্ফোরণ ঘটে। ভারত ইতোমধ্যেই বিপুল সামরিকীকৃত কাশ্মীরে আরো সৈন্য প্রেরণ করে। শত শত কাশ্মীরী তরুণ-যুবক অস্ত্র ও গ্রেনেড সজ্জিত হয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিস দীর্ঘ গবেষণার পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, তখন থেকে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে কাশ্মীরে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯৪ হাজার ২৯০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। এদের মধ্যে সাত হাজার ৩৮ জন মারা গেছে ভারতীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায়। রিপোর্টে বলা হয়, কাশ্মীরে ওই হত্যাকা-ের কারণে ২২ হাজার ৮০৬ জন নারী বিধবা এবং ১০ লাখ সাত হাজার ৫৪৫ জন শিশু এতিম হয়ে গেছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়, ভারতীয় বাহিনী ১০ হাজার ১৬৭ জন কাশ্মীরী নারীকে ধর্ষণ করেছে। এ রিপোর্টে অবশ্য বলা হয়নি যে কাশ্মীরে ৬ লাখেরও বেশি সৈন্য ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। ফলে গোটা কাশ্মীরই আজ পরিণত হয়েছে এক সামরিক অঞ্চলে।
সাম্প্রতিককালে কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের সশস্ত্র তৎপরতা ব্যাপক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তার পরিবর্তে নিরস্ত্র প্রতিবাদের পথ অবলম্বন করেছে কাশ্মীরীরা। অস্ত্র দিয়ে লড়াই নয়, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি পাথর ছুঁড়ে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ভারতীয় সৈন্যরা ৮ জুলাই কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী হিজবুল মুজাহিদিন গ্রুপের ক্যারিশমাটিক নেতা ২২ বছরের তরুণ বুরহান ওয়ানিকে হত্যা করে। তরুণ প্রজন্মের একটা অংশের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর জনগণের প্রতিক্রিয়া হয় স্বতঃস্ফূর্ত ও নজিরবিহীন। হাজার হাজার ক্রুদ্ধ তরুণ প্রায় সারা কাশ্মীরব্যাপী তাদের স্ব স্ব শহর ও গ্রামগুলোর রাস্তায় নেমে আসে। তারা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর ইট-পাথর নিক্ষেপ করে এবং সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারপর থেকে এ সংঘর্ষ চলছেই। এতে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৬০ জন লোক নিহত ও ৫ হাজারেরও বেশি লোক আহত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সর্বশেষ ৫ আগস্ট ৩ জন নিহত ও ১৫০ জনেরও বেশি আহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ আগস্টও প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। খবরে জানা যায়, রাজধানী শ্রীনগরের ৬টি জেলাসহ কাশ্মীর বেশ কিছু এলাকায় ৮ আগস্ট পর্যন্ত একটানা ৩১ দিন কারফিউ জারি রয়েছে। কারফিউ এবং পুলিশের ব্যাপক বাধার মাঝেও টানা ৩০ দিনের মতো অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরীরা। বন্ধ রয়েছে রাজধানী শ্রীনগরের সকল দোকানপাট, যান চলাচল। সেই সাথে বন্ধ রয়েছে পাড়া-মহল্লার সকল মুদি দোকানও। পাশাপাশি সকল গলিপথের দেয়াল এবং দোকানের বন্ধ শাটারগুলোতে স্বাধীনতার দাবি সংবলিত বিভিন্ন সেøাগান লেখা চোখে পড়ে। চলমান আন্দোলনকে স্বাধীনতার দাবির একদফার আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে গেছে তারা। এমনকি অনেক স্থানে ইংরেজিতে ‘গো ব্যাক ইন্ডিয়া’ লেখাও দেখা গেছে। বস্তুত একটানা কারফিউ জারি রেখে মোবাইল, ইন্টারনেট ও টিভি চ্যানেলসহ সব যোগাযোগ বন্ধ করেও কর্তৃপক্ষ কাশ্মীরের ক্রুদ্ধ তরুণদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান। এদিকে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের হিংস্র ও অমানবিকতার পরিচয় হিসেবে বিক্ষোভ দমন করতে কিশোর-তরুণ বিক্ষোভকারীদের উপর ছররা গুলি নিক্ষেপ করছে। এর ফলে বহু কাশ্মীরী তরুণ চোখে ছররা গুলিবিদ্ধ হয়ে তাদের চোখের দৃষ্টি হারাতে বসেছে।
এদিকে কাশ্মীরে অব্যাহত সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনায় মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কিসহ একাধিক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ভারত সরকারের কাছে এ ধরনের নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। গত ২৮ জুলাই এক বিবৃতিতে তারা বলেন, কাশ্মীরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর হামলা চালাচ্ছে। ছররা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে আহত করেছে বেসামরিক নাগরিকদের। ১৯৯০ সালের পর সর্বশেষ এই মানবিক সংকটে পড়েছে কাশ্মীর।
বিবৃতিতে তারা বলেন, জাতিসংঘের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ১৯৪৮ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে কাশ্মীরকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়ার গ্যারান্টিও দেওয়া হয়েছিল। তারা বলেন, কাশ্মীরের বেসামরিক নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে হবে। ভারতের সরকারকে পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসার দাবি জানান তারা।
বিবৃতিতে কাশ্মীরে সহিংসতা বন্ধে নিন্দা ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতি আহ্বান জানান তারা। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে কাশ্মীরে যে যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তা বন্ধে এ ধরনের সংগঠগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি ছাড়াও নিউইয়র্ক বসবাসকারী কাশ্মীরের লেখক ও সাংবাদিক বাসারাত পির, বিবিসির সাংবাদিক ও লেখক মির্জা ওয়াহিদ, ব্রিটেনের ইউনির্ভাসিটি অব ওয়েস্ট মিনস্টারের ভারতীয় ঔপন্যাসিক নিতাশা কাউল, পাকিস্তানের ইংরেজি লেখিকা ও ঔপন্যাসিক কামিলা শামসি, গিলিয়ান সেøাভো, মিনা কান্দাস্বামী, মাদুশ্রী মুখার্জীসহ ৮৫০ জন স্বাক্ষর করেন।
খবরে জানা যায়, তুরস্ক কাশ্মীরের জনগণের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্তসহ কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু ৩ আগস্ট পাকিস্তানে বলেন, কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতার খবরের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে একটি ঘটনা অনুসন্ধানী মিশন প্রেরণের জন্য তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানাবেন। তবে তুরস্ক এ আহ্বান জানিয়েছে কিনা বা জাতিসংঘ মহাসচিব প্রাসঙ্গিক কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা তা জানা যায়নি। কাশ্মীর বিষয়ে পাকিস্তান ছাড়া শুধু তুরস্কের কাছ থেকেই শুধু কথা শোনা গেল। অন্যসব মুসলিম দেশ সাম্প্রতিককালে কাশ্মীর বিষয়ে কঠোর নীরবতা পালন করছে।
এদিকে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে টানা অস্থিরতা ও সহিংসতার মধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ কামনা করে কাশ্মীর প্রশ্নে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছেন প্রবীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি। গত ১৮ জুলাই দি ইকনোমিক টাইমসের খবরে বলা হয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে খোলা চিঠি লিখে তিনি কাশ্মীরে তাদের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। হুররিয়াত কনফারেন্সের এই নেতা একই ধরনের চিঠি লিখেছেন ও আইসিইইউ সার্ক ও আসিয়ানকে। তিনি এ চিঠি দিয়েছেন তুরস্ক, সউদি আরব ও পাকিস্তানকে। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তিনি এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন বেইজিং ও তেহরানকেও।
তবে ভারতীয় বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, কাশ্মীর ইস্যুর আন্তর্জাতিকরণের এই চেষ্টা এখন সফল হওয়া কঠিন। ভারত কাশ্মীরে গণভোটের দাবিও কোনো মতেই মানবে না। বিগত প্রায় সত্তর বছর ধরে ভারতের বক্তব্য, কাশ্মীর বিতর্কের সমাধান করতে হবে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ের আলোচনায়, তৃতীয় কোনো পক্ষ, এমন কী কাশ্মীরের মানুষের কোনো ভূমিকাও দিল্লি সেখানে মানতে প্রস্তুত নয়। সেই বক্তব্য থেকে এক চুলও নড়তে রাজি নয় দিল্লি।
কাশ্মীর বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক নয়াদিল্লীর জওয়াহের লাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. অশ্বিনী কুমার রায় মনে করেন, কাশ্মীর যাতে স্বাধীনতা পায়, সে জন্যই গিলানি এখন সরাসরি সাহায্য চেয়েছেন জাতিসংঘ ও বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী শক্তির কাছে। তিনি কাশ্মীর থেকে ভারতীয় সৈন্য সরাতে আর কাশ্মীরিদের নিজেদের ভবিষ্যৎ স্থির করার অধিকার দিতে জাতিসংঘ আর এই সব শক্তিকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
ড. রায় বলেন, ‘কিন্তু এই আবেদনে এখন সাড়া মেলা মুশকিল। আন্তর্জাতিক বিশ্ব এখন ইসলামিক স্টেটের বিপদ নিয়ে এতটাই ভাবিত যে তাদের কাশ্মীর নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখা যাবে বলে মনে হয় না। কাশ্মীরের জঙ্গিবাদ যত বেশি ইসলামী চেহারা নেবে ততই কিন্তু পাকিস্তানের পশ্চিমী মিত্ররা কাশ্মীর প্রশ্নে বেশি সাবধান হয়ে পড়বে।’
উল্লেখ্য, কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলে সৈয়দ আলি শাহ গিলানি নতুন করে গণভোটের কথা তুলে ধরেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দিল্লি কিছুতেই কাশ্মীরে গণভোট মানবে না বলেই ড. রায়ের ধারণা। তিনি বলেন, ‘১৯৯১ অবধি যখন শীতল যুদ্ধ চলেছে, তখন সোভিয়েতের সমর্থন নিয়ে ভারত সেই গণভোটের দাবিকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে। তারপরেও বিশ্ব পরিস্থিতি ভারতের অনুকূলে ছিল, ফলে সেই দাবি না মেনেও ভারত পার পেয়ে গেছে। এখন কাশ্মীরে গণভোট যদি সত্যিই হয়, তার ফলাফল কী হবে এটা মোটামুটি সবারই জানা। তাই আমি নিশ্চিত, ভারত কিছুতেই কাশ্মীরে গণভোটে রাজি হবে না। আর শুধু একা চীনের সমর্থন নিয়ে পাকিস্তানও এ ব্যাপারে খুব বেশি চাপ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, ভারত সরকার বিশ্বাস করে আন্তর্জাতিক রাডার থেকে কাশ্মীর এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে।’
কাশ্মীরে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাত্রা স্তিমিত হয়ে এলেও যা অনস্বীকার্য তা হলো আজাদি বা স্বাধীনতার মন্ত্র কাশ্মীরীদের হৃদয়ে খোদিত হয়ে গেছে। কাশ্মীরীরা আজ সশস্ত্র বিদ্রোহের বদলে নিরস্ত্র প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছে। তাই হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামছে। আর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গুলি চালিয়ে হত্যা করে তাদের দমনের চেষ্টা করছে। কাশ্মীরীরা প্রাণ দিচ্ছে, হয়তো আরো দেবে। কিন্তু তাদের স্বাধীনতা লাভ তথা মুক্তির আকাক্সক্ষা আদৌ পূরণ হবে কিনা, তা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
h_mahmudbd@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন