মীর আব্দুল আলীম
দেশে-বিদেশে পরিবেশবাদীরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি ও উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। সাড়ে ১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভবিষ্যতে যে ঝুঁঁকি দাঁড়াবে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। আমাদের বিদ্যুৎ দরকার। বিদ্যুতের অনেক বিকল্প উৎসও আছে। কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সরকাররকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আশা দরকার। আমরা চাই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি হোক, কিন্তু রামপালে নয়। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবন ধ্বংস হবে। সুন্দরবন ধ্বংস হলে, পরিবেশ ধ্বংস হলে আমাদের কী হবে?
যে কোন একটা চাইতে হবে। সুন্দরবন নইলে রামপালের বিদ্যুৎ। এমন প্রশ্নই এখন দেশবাসীর সামনে আছে। তারা কোনটা চাইবেন? যাওয়া আসার বিদ্যুৎ; নাকি সুন্দরবন? নিঃসন্দেহে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা অনেক। অন্যদিকে বিকল্পহীন সুন্দরবন! এরতো তুলনাই নেই। যার সাথে আমাদের প্রকৃতি মিলেমিশে আছে। এটা বাংলাদেশ আর বাঙালির গৌরব। তামাম বিশ্বে সুন্দরবন একটাই। এর বিকল্প কিসে? তাই কোনটা এখন চাই? বিদ্যুৎ না সুন্দরবন? বিদ্যুতের বিকল্প যদি নাও থাকে; অন্ধকারে যদি পিদিম জ্বালিয়েও সময় কাটাতে হয়; না হয় কাটাবো কিন্তু কিছুতেই সুন্দরবন হারাতে চাই না আমরা। দেশের প্রকৃতিকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। সুন্দরবন আমাদের অহংকার। সুন্দরবনকে কিছুতেই ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দরবনকে আমাদের সুরক্ষিতই রেখে যেতে হবে। সুন্দরবন ধ্বংস হলে দেশের সৌন্দর্যের আর অবশিষ্ট কি থাকে? জীববৈচিত্রের সম্ভার, পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বৃহত্তর খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই বন জানমাল রক্ষায় সুরক্ষা হিসেবে কাজ করেছে। অথচ এই বন থেকে মাত্র ১৪ কি.মি, এরমধ্যে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন হতে চলেছে। যা সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অংশীদারত্বে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় প্রস্তাবিত খুলনা এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে জানিয়েছে। সরকারের পরিকল্পনাবিদরাও অন্যান্য জ্বালানি উৎসের সীমাবদ্ধতার কারণে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ৭৮%, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৩%, চীনে ৭৯%, জার্মানিতে ৪১%, ভারতে ৬৮% এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৪৯% বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বলে উদাহরণ টেনে বলেছেন, এত সুন্দরবনের কোনই ক্ষতি হবে না। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। তবে রামপাল পাওয়ার কেন্দ্র নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। দেশে এ জাতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়া খুবই দরকার। নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশে অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে নয়। সুন্দরবনকে সুরক্ষিত রেখে অন্য কোথাও বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তাতে কারোরই আপত্তি থাকবার কথা নয়। পাঠক নিশ্চয় মনে আছে, একসময় রাজধানী ঢাকার ধোলাইখাল ভরাটের সময় বলা হয়েছিল এতে পুরান ঢাকায় যানজট থাকবে না, জলাবদ্ধতা নিরসন হবে, বুড়িগঙ্গা দূষণের কবল থেকে বাঁচবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকে ঢাকাবাসীরা এই ধোলাইখাল ভরাটের প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আজ কোথায় সেই পরিকল্পনাবিদ? যেদিন বাঘ-হরিণ মরবে সেদিন আপনাদের (যারা আজ বড়বড় কথা বলছেন) খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন পাওয়া যাচ্ছে না হাজারিবাগে ট্যানারি নির্মাণের সুপারিশ যারা করেছিলেন তাদের। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি তৈরি হলে বছরে কমপক্ষে ৫২ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করবে।
এ কথা সত্য যে দেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাসের সীমাবদ্ধতা ও জলবিদ্যুতের অনিশ্চয়তার কারণে সরকারকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানি উৎসের দিকে নজর দিতে হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্যানে (পিএসএমপি) ৫০% বিদ্যুৎ কয়লা থেকে, ২২% প্রাকৃতিক গ্যাস/এলএনজি থেকে এবং ২৮% বিদ্যুৎ অন্যান্য উৎস থেকে সরবরাহের কথা বলা হযয়েছে। ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র নষ্ট হবে, ঝুঁকিতে পরবে তা কিছুতে হতে পারে না। যদিও সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে তারা সুন্দরবনের কোন প্রকার ক্ষতি না করেই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করছে। কিন্তু সরকারের সে পরিকল্পনা সঠিক নয় বলেই দেশের বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন।
বিদুৎ এ প্রকল্পের ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড (ঝঙ২) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (ঘঙ২) নির্গত হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস সুন্দরবনের বাতাসে ঝঙ২ ও ঘঙ২ এর ঘনত্ব বর্তমান ঘনত্বের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে গোটা সুন্দরবন ধ্বংস করবে। কিন্তু রিপোর্টে এর মাত্রা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ নির্ধারিত সীমার মধ্যে দেখানোর জন্য ইআইএ রিপোর্টে একটা জালিয়াতি আশ্রয় নেয়া হয়েছে- পরিবেশগত ‘স্পর্শকাতর’ এলাকার মানদ-ের বদলে সুন্দরবনের জন্য ‘আবাসিক ও গ্রাম’ এলাকার মানদ- বেছে নেয়া হয়েছে! বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মারাত্মকভাবে পানি দূষণ করবে। যতই পরিশোধনের কথা বলা হউক, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন হলে তাতে বিভিন্ন মাত্রায় দূষণকারী উপাদান থাকবেই যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেলায় ‘শূন্য নির্গমণ’ বা ‘জিরো ডিসচার্জ’ নীতি অবলম্বন করা হয়। যে এনটিপিস রামপাল কয়লা বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে, সেই এনটিপিসি যখন ভারতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে তখন ‘জিরো ডিসচার্জ’ নীতি অনুসরণ করে। এদিকে প্ল্যান্ট পরিচালনা, ঘরোয়া ব্যবহার, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজে পশুর নদী থেকে ঘণ্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে এবং পরিশোধন করার পর পানি পশুর নদীতে ঘণ্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার হারে নির্গমন করা হবে। ঘণ্টায় ১০০ ঘনমিটার বা ৫১৫০ ঘনমিটার যাই হোক, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন করা হলে নির্গত পানির তাপমাত্রা, পানি নির্গমনের গতি, পানিতে দ্রবীভূতি নানান উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় পানি দূষণ ঘটাবে যা গোটা সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করবে।
ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিমালা মেনে চিমনি তৈরি করার কারণে এই উচ্চতাপ স্থানীয় এলাকার তাপমাত্র বৃদ্ধি করবে না বলে ইআইএ রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হলেও তা মোটেও সঠিক নয়। এদিকে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূত ছাই ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে কারণ এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। উৎপাদিত ছাই যেন পরিবেশ দূষণ না করে সেজন্য ফ্লাই অ্যাশ চিমনি দিয়ে নির্গত হওয়ার আগেই ইএসপি সিস্টেমের মাধ্যমে ধরে রাখা হবে যদিও এরপরও ‘কিছু উড়ন্ত ছাই’ বাতাসে মিশবে যা মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করবে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, একদিকে বলা হয়েছে এই বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে ব্যাপক দূষণ হবে অন্যদিকে এই ছাই দিয়েই প্রকল্পের মোট ১৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! এই বর্জ্য ছাইয়ের বিষাক্ত ভারী ধাতু নিশ্চিত ভাবেই বৃষ্টির পানি সাথে মিশে, চুইয়ে প্রকল্প এলাকার মাটি ও মাটির নিচের পানির স্তর দূষিত করবে যার প্রভাব শুধু প্রকল্প এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না তা সুন্দরবনকেও প্রভাবিত করবে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদির বিভিন্ন যৌগ কিংবা পারদ, সীসা, ক্যাডমিয়াম, ব্যারিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতুর দূষণ ছাড়াও কুলিং টাওয়ারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামণের কারণেও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক আকারে নিউমোনিয়া জাতীয় রোগ ছড়িয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞগণ আরও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, রামপাল প্রকল্পের দূষণে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে থাকা নিবিড় সুন্দরবন পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই হারিয়ে যাবে, রামপালের ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়া ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড, ৮৫ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ২ হাজার ৬০০ টন ছাই সুন্দরবনের নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ প্রকল্প কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৭ লাখ টন কয়লা সুন্দরবনের গভীরতম অংশের মধ্য দিয়েই পরিবহন করা হবে। লাখ টনি বাল্ক ক্যারিয়ার আর হাজার টনি লাইটারেজ জাহাজের সারা বছরব্যাপী আনাগোনা, তীব্র শব্দ, জাহাজ হতে চুইয়ে পড়া তেল, কয়লার ভাঙ্গা টুকরা, জাহাজ চলাচলের প্রচ- ঢেউ যে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে। কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণিকা, মার্কারি বা পারদ, আর্সেনিক, শেলেনিয়ামসহ পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান নির্গত হয়। কয়লা পুড়ে ছাই তৈরি হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় আরেকটি বর্জ্য কোল সøাজ বা তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই এবং সøাজ উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। এতে মানব দেহের যেমন ক্ষতি তেমনি বন ও বন্য প্রাণীরও ক্ষতি। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জীববৈচিত্রের সম্ভার, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে কোন মূল্যে আমাদের সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য দেশবাসীকে সচেষ্ট হতে হবে; আন্তরিক হতে হবে সরকারকে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
newsstore13@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন