চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, ঘি, লাচ্ছা সেমাই, চিপস, নুডলস, চানাচুর, বিস্কুট, বোতলজাত পানি, ডিম, শাক-সবজি, মাছ-গোশত, দুধ, মধু, হলুদ-মরিচ, শিশু খাদ্যসহ এমন কোনো ভোগ্যপণ্য নেই যা নির্ভেজাল। বলা যায়, ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব হয়ে আছে। বিএসটিআইসহ র্যাবের অভিযানও ভেজাল পণ্যের অবাধ প্রবাহ রোধ করতে পারছে না। ফলে ভেজাল পণ্য ভোগ করেই সকলকে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এর ফলে তারা আক্রান্ত হচ্ছে, অনিরাময়যোগ্য ক্যান্সার, কিডনী, হৃদরোগ, ডায়বেটিসহ নানা রোগে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর ভেজাল খাদ্যের কারণে ৩ লাখ মানুষ ক্যান্সারে, ২ লাখ কিডনি ও দেড় লাখ ডায়বেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিচ্ছে ১৫ লাখ শিশু। দেশে ভেজাল খাদ্য কতটা বিস্তার লাভ করেছে তা ভেজালবিরোধী অভিযানে ভ্রাম্যমান আদালতের ৩ বছরে ২৫ হাজার মামলায় শত কোটি টাকা জরিমানা করা থেকেই বোঝা যায়। তারপরও ভেজাল খাদ্যপণ্যের দৌরাত্মে লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, বড় বড় নামী-দামী রেস্টুরেন্ট ও ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোর খাদ্যেও ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। এসব রেস্টুরেন্ট ও দোকানের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা খাবারের জন্য লাখ লাখ টাকা জরিমানাও করা হচ্ছে। দেশের অনেক বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত খাদ্যপণ্যেও ভেজাল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপনে সাধারণ মানুষ আস্থাশীল হয়ে নির্দ্বিধায় পণ্য কিনে ভোগ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে মানুষ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাদ্যপণ্যের জন্য কোথায় যাবে? এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য নকল করার জন্য গড়ে উঠা কারখানাও গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে।
‘বিশুদ্ধ খাবার, সুস্থ্য জীবন’ এই স্লােগান এখন খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কোনো খাদ্যের বেলায়ই এটি এখন খাটে না। ‘মাছে-ভাতে বাঙ্গালী’ বলে যে প্রবাদ রয়েছে, তা এখন অচল। মাছ ও ভাতের চাল-দুটোতেই এখন ভেজাল। মাছে ফরমালিন, ভাতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ক্যাডমিয়াম মিশানো হচ্ছে। শাক-সবজি, গোশত, দুধ, ফলে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। দুধের ছানার পানির সঙ্গে খাবারের সোডা, বিষাক্ত পারঅক্সাইড, ও কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম দুধ। সয়াবিন তেলে মেশানো হচ্ছে পাম অয়েল। সরিষার তেলে মেশানো হয় মরিচের গুঁড়া, সাবান তৈরির ক্যাস্টর অয়েল ও কৃত্রিম কেমিক্যালের ঝাঁজ। নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো মিষ্টি কুমড়া, গাজর পিষে তাতে কৃত্রিম রং, ফ্লেভার ও প্রিজারভেটিভ মিশিয়ে বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি হিসেবে প্রলুব্ধকর বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজারজাত করছে। মরিচের গুঁড়ার সাথে মেশানো হচ্ছে ইটের গুঁড়া। ধানের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে কাঠের গুঁড়া আর ভূষি। হলুদের রং উজ্জ্বল করতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ওলিংগং বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এক গবেষণা জরিপ করে দেখেছে, রাজধানীর ৯৬ শতাংশ মিষ্টি, ২৪ শতাংশ বিস্কুট, ৫৪ শতাংশ পাউরুটি, ৫৯ শতাংশ আইসক্রিমে ভেজাল রয়েছে। শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, দেশী-বিদেশী প্রসাধনী সামগ্রীতেও রয়েছে ভেজাল এবং ক্ষতিকর বিষাক্ত কেমিক্যাল যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যপণ্য ও প্রসাধন সামগ্রী যেমন গুঁড়া দুধ, চকলেট, ফলমূল এবং কসমেটিকস সামগ্রীতে নিজেরাই এক-দুই বছরের মেয়াদের তারিখ বাড়িয়ে বিক্রি করছে। করোনাকালের লকডাউনে স্টকে থাকা মেয়াদোত্তীর্ণ অনেক পণ্যের তারিখ বাড়িয়ে তারা বাজারজাত করছে। নিম্নমাণের পণ্যও দেদারছে বিক্রি করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিরাপদ খাদ্যের অধিকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। অসাধু ব্যবসায়ী এবং ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারণে এ অধিকার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, করোনায় আর্থিক সঙ্গতি হারানো জনগণকে উচ্চমূল্যে এসব ভেজাল পণ্যই ভোগ করতে হচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ভেজাল খাদ্য পরীক্ষা করতে দেশের আট বিভাগে আটটি আধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরির কাজ চলছে। বিএসটিআই-এর মহাপরিচালক বলেছেন, ভেজালবিরোধী অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। এসব অভিযান এবং জেল-জরিমানাও যে ভেজালকারীদের দৌরাত্ম কমানোর জন্য যথেষ্ট নয়, তা ভেজাল পণ্য উৎসাধন না হওয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এটা আইনের দুর্বলতা প্রকাশ করছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য কঠোর আইন রয়েছে। সেখানে যে প্রতিষ্ঠানের পণ্যে ভেজাল পাওয়া যায় কিংবা যারা ভেজাল পণ্য বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়াসহ কঠোর শাস্তিমূলক আইন রয়েছে। কোনো কোনো দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে আইন করা হয়েছে। ফলে সেসব দেশে খাদ্যে ভেজাল দেয়ার সাহস কেউ করে না।
যে খাদ্য মানুষের জীবন বাঁচায়, সেই খাদ্যের ভেজাল এখন আমাদের দেশের মানুষের জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন যে, কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না, কোন খাদ্য বিশুদ্ধ আর কোনা খাদ্য ভেজাল। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। অথচ জীবন বাঁচানোর খাদ্যের বিশুদ্ধতার বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে ভেজাল পণ্য সনাক্ত করা সম্ভব নয় এবং তা তার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। এ দায়িত্ব সরকারের এবং তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। তাদের দায়িত্ব নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। আমরা মনে করি, ভেজাল পণ্য উচ্ছেদে শুধু বাজারে অভিযান চালালে হবে না, এসব পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়াসহ প্রতিষ্ঠানের মালিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এজন্য প্রচলিত আইনকে আরও কঠোর করতে হবে। ভেজাল খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণন করে বছরের পর বছর ধরে কিছু অসাধু ব্যক্তি মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক প্রচারণামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন