জিম্মি দশায় উত্তরা ৪ নং সেক্টরের বাসিন্দারা * সমন্বয়হীনতায় বছরজুড়ে লেগে আছে খোঁড়াখুঁড়ি * সড়কে মাথা উঁচু করে ম্যানহোলের ঢাকনা
রাজধানীজুড়ে বেহাল সড়কে দুর্ভোগ, যন্ত্রণা আর বিড়ম্বনা। টানা বৃষ্টিতে যেখানে সেখানে জমে থাকছে পানি। সড়কজুড়ে ছোট-বড় গর্ত। বৃষ্টিতে গর্তগুলো পানির নিচে হারিয়ে যাওয়ায় মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে এসব সড়ক। মূল সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই একই হাল। এর বাইরে বছরজুড়ে চলমান খোঁড়াখুঁড়িতো আছেই।
একাধিক ফ্লাইওভার ও ইউটার্ন নির্মাণের পরও সড়কে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি কাটছেই না। বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতায় বছরজুড়ে লেগে আছে খোঁড়াখুঁড়ি। কোনো কোনো ভাঙা সড়কে দুই-তিন বছরেও নজর দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত সড়কে তৈরি হয়েছে এক-দেড় ফুট গর্ত। আবার কোনো কোনো এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার নামে সবগুলো সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে এলাকাবাসীকে অনেকটা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সড়কের কোথাও মাথা উঁচু করে রয়েছে ম্যানহোলের ঢাকনা, কোথাও এসব ঢাকনা সড়ক থেকে ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি নিচু। বছর ঘুরলেও শেষ হচ্ছে না অনেক সড়কের সংস্কার কাজ। এতে একদিকে যেমন ঘটছে দুর্ঘটনা, সেই সঙ্গে যানবাহনের গতি কমে যাওয়ায় তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। সব মিলে বেহাল সড়ক ও ড্রেন নির্মাণের ধীরগতিতে নগরবাসীর ভোগান্তি চরমে।
রাজধানীর উত্তরা ৬ নং সেক্টরের হাউজবিল্ডিং থেকে বিএনএস সেন্টার পর্যন্ত সগকের কাজ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের পিচ ঢালাই করা এখনও বাকি। এ ছাড়া রাজউক স্কুলের পাশে এবং কুয়েতমৈত্রী হাসপাতালের রাস্তা ড্রেনের কাজ শেষ হলেও প্রায় এক বছর যাবত ফেলে রাখা হয়েছে। এখানে পিচ ঢালাইয়ের কাজ কবে হবে কেউ জানে না। অন্যদিকে ৮ ও ৯ নম্বর সড়কের বেহাল দশা বহুদিন ধরে। করোনার মধ্যে ঢিমেতালে শুরু হয়েছে ড্রেনের। ম্যানহোলের পাইপ বসিয়ে পিট ঢালাই দেয়া হলেও অন্য সব কাজ আটকে আছে। কোন গাড়ি বা রিকশা এই দুই সড়ক দিয়ে চলাচলের উপযোগী হয়নি। অথচ মূল ড্রেনের পাশাপাশি সড়কের ফুটপাতের নিচ দিয়েও ড্রেন করা হবে বলে জানিয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে কাজ শুরু হয়নি। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, অভিজাত এই এলাকার বাসিন্দারা বহুদিন ধরেই জিম্মি দশায় জীবন যাপন করছেন। তারা বাড়ি থেকে গাড়ি বের করতে পারছেন না, আবার বাইরে থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়িতেও ফিরতে পারছেন না। কেউ অসুস্থ হলে একটা অ্যাম্বুলেন্স সড়ক দিয়ে ঢুকবে সে অবস্থাও নেই বহুদিন।
এদিকে, উত্তরার আবদুল্লাপুর থেকে হাউজবিল্ডিং সড়ক দুই পাশের রাস্তায় খানাখন্দ আর বড় বড় গর্ত। বাস-ট্রাকের পাশাপাশি অন্যান্য যান চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। খানাখন্দে পড়ে হঠাৎ বন্ধ হয় সিএনজি অটোরিকশাসহ অন্যান্য ছোট যানবাহন। বাস চালকরা জানান, বিমানবন্দর থেকে আবদুল্লাহপুরের রাস্তার বেহাল দশা। গাড়ি চালানো কঠিন। বিশেষ করে আবদুল্লাহপুর থেকে হাউজবিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তায় দুইপাশে বড় বড় গর্ত। সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তার গর্ত দেখা যায় না। তখন বেশি কষ্ট হয় গাড়ি চালাতে।
মিরপুর-১২ নম্বর থেকে আগারগাঁও রাস্তায় ছোট-বড় দুর্ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। বিশেষ করে বৃষ্টি হলে এই রাস্তায় সিএনজি-রিকশা উল্টে যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। মালেক নামের একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক বলেন, বর্ষার শুরু থেকেই এই রাস্তার বেহাল দশা। ঠিক করার কোনো উদ্যোগও নেই। সরেজমিনে দেখা গেছে, আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১২ নম্বর পর্যন্ত রাস্তায় ছোট-বড় খানাখন্দে ভরপুর। গাড়িগুলোর চাকা ডুবে যায় একটু বৃষ্টি হলেই। রাস্তার বেহাল দশার কারণে মাঝে মাঝে শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত রাস্তায় যানযট লেগেই থাকে। এ ছাড়া মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্কর থেকে মিরপুর ১২ নম্বর ও পল্লবী অংশের রাস্তারও বেহাল দশা। এই রাস্তায় বৃষ্টি হলে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। অনেক স্থানেই বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।
এদিকে, ঢাকার হানিফ ফ্লাইওভারের দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর অংশের নিচের রাস্তা বেহাল হয়ে পড়ে আছে অনেক দিন। রাস্তার মাঝে গভীর গর্তও তৈরি হয়েছে। এই বেহাল রাস্তায় ঝুঁঁকি নিয়ে প্রতিদিন ভারী যানবাহন থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের গাড়ি চলে। দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, এক বছরের বেশি সময় হয়েছে মেরামত হয়নি এই রাস্তা। গর্ত হলেই ইটের সুরকি দিয়ে দায়সারা কাজ হয়। হানিফ ফ্লাইওভারের দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী অংশের নিচের এই রাস্তায় কয়েক মাস আগে ইটের সুরকি ফেলে ভরা হয়েছিল গর্ত। এখন আবার ফিরেছে আগের দুর্দশা।
বেহাল দশা শ্যামলী রিং রোডের। শ্যামলী সিনেমা হল থেকে শিয়া মসজিদ পর্যন্ত এই রাস্তার দুই পাশে খানাখন্দে ভরা। প্রায় ছয় মাসেও এই রাস্তা সংস্কারে কাজ হয়নি। মাঝে মাঝে বালু ফেলানো হলেও তা আবার বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়, আবারও গর্ত হয়। এই রাস্তায় চলাচলকারীদের অভিযোগ, লেগুনা বা রিকশায় এই রাস্তায় চলাচল করতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। রাস্তায় গর্তে অনেক সময় রিকশা আটকে দুর্ঘটনা ঘটে। লেগুনায় চলাচল করলে কোমরে ব্যথা হয়। এ ছাড়া মোটরসাইকেলেও চলাচল করা কষ্টকর।
অন্যদিকে, মালিবাগ-রামপুরা-বাড্ডা সড়কের মাঝে মাঝে বেশ কয়েকটি ড্রেনের ঢাকনা মূল সড়ক থেকে ৪-৫ ইঞ্চি নিচু। এগুলো দূর থেকে দেখা না যাওয়ায় মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে। এই গর্তগুলোর কারণে সড়কে যান চলাচলের গতিও অনেক কম। এই সড়কে ডিভাইডার রেলিং না থাকায় যত্রতত্র সড়ক পার হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সিদ্ধেশ্বরী রোড়ের খেলার মাঠের সামনে ছোট-বড় খানাখন্দ রয়েছে। সুয়ারেজ লাইনের সমস্যার কারণে এই অংশে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে থাকে। এ ছাড়া এই রাস্তার কিছু অংশের উন্নয়ন কাজ কয়েক মাস আগে শুরু হলেও তা এখনো শেষ করা হয়নি। মধ্যবাড্ডা পোস্ট অফিস রোডের প্রায় এক কিলোমিটার সড়কের অবস্থা আরও খারাপ। দীর্ঘদিন থেকে এই সড়কে কোনো সংস্কার করা হয়নি। এই রাস্তার মাঝখানে রয়েছে কয়েকটি গর্ত।
রামপুরার বনশ্রী এলাকার রাস্তাগুলোর সংস্কার কাজ বহুদিনেও সম্পন্ন হয়নি। ভুক্তভোগিদের মতে, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রধান সড়কগুলো মোটামুটি চলাচলের উপযোগী থাকলেও শাখা সড়কগুলোর বেহাল দশা। সড়কজুড়ে পড়ে আছে ছোট-বড় ইটের খোয়া। অনেক সড়কের বিটুমিন উঠে তৈরি হয়েছে খানাখন্দ, কোথাও বিটুমিনের ওপর দেড়-দুই ইঞ্চি মাটি জমে ঢাকা পড়েছে রাস্তা। স্থানীয়রা জানান, গত এক-দেড় বছর ধরে বিভিন্ন সড়কের সংস্কার কাজ চললেও শেষই হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণের পর থেকে চলমান কাজগুলোও বন্ধ আছে। এতে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। সড়কজুড়ে ইটের খোয়া ও পাথরের সুরকি পড়ে থাকায় মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দক্ষিণ বনশ্রীর। এই এলাকার অধিকাংশ সড়কই ভাঙাচোরা।
স্থানীয়রা জানান, মেরাদিয়া বাজার থেকে মাদারটেক যাওয়ার প্রধান সড়কটি গত পাঁচ বছরেও ঠিক হয়নি। দীর্ঘদিন ভোগান্তির পর বছর দুই আগে একবার কার্পেটিং করা হয়েছিল। কিন্তু সরু সুয়ারেজ লাইনের কারণে বৃষ্টি এলেই এলাকা তলিয়ে যেত। কাজ শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই সড়কের বিভিন্ন জায়গা দেবে যায়। বড় বড় গর্ত তৈরি হয়। এখন আবার বড় সুয়ারেজ লাইনসহ নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। সেটাও চলছে বছরব্যাপী। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে কাজ বন্ধ আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন