‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/ রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও’ (জসিমউদ্দীন)। পল্লি কবির কবিতার এই পঙক্তি কিছুটা ঘুরিয়ে বলা যায় ‘যানজট দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/ মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে চলে যাও’। বাসভাড়ার মূল টাকা ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে- লাখ লাখ যাত্রীকে।
জ্যামের শহর ঢাকা। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে চারগুণ বেশি লোকসংখ্যা এবং অপরিকল্পিতভাবে সবকিছু নির্মাণ হওয়ায় যানজট নিত্যসঙ্গী। ১০ বছর আগে যে পথ অতিক্রম করতে এক ঘণ্টা সময় লাগত; এখন সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। প্রতিদিন মহানগরীর পথে পথে দীর্ঘ যানজটে মানুষের চরম ভোগান্তি নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে।
এক সময়ের মসজিদের শহর ঢাকা এখন ফ্লাইওভারের শহরে রুপ লাভ করেছে। কিন্তু যানজট কি কমছে? মানুষের ভোগান্তি কি কমছে? বরং যানজট বাড়ছে, ঘর থেকে বের হলেই যানজট নামক নিত্য ভোগান্তিতে পড়ছেন মানুষ।
যানজট থেকে পথচারীদের ভোগান্তি কমাতে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। কিছু ফ্লাইওয়ারে টোল না থাকলেও মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে যানবাহনকে টোল দিতে হয়। টোল সিস্টেম চালুর কারণে প্রতিটি গণপরিবহন যাত্রীদের কাছে অতিরিক্ত ৫ টাকা বেশি আদায় করেন। যাত্রীরাও যানজট এড়াতে অতিরিক্ত টাকা ভাড়ার সঙ্গে দিয়ে থাকেন। কিন্তু মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে যানজট নিত্যঘটনা হয়ে গেছে।
প্রায় প্রতিদিনই সায়েদাবাদ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে গণপরিবহন। ফলে যাত্রীরা যে উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন, সে সুফল পাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, ফ্লাইওভার ছাড়াও অন্যান্য সড়কগুলোতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা গণপরিবহন দাঁড়িয়ে থাকছে। ফলে ফার্ম গেইট থেকে সদরঘাট এক ঘণ্টার রাস্তায় অতিক্রম করতে সময় লাগছে ৩ ঘণ্টা থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। একই চিত্র অন্যান্য সড়কগুলোতেও।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে যানবাহন নামতে গেলেই যানজট। গুলিস্তান পয়েন্টে প্রতিদিন যানজট লাগছে। কখনও কখনও সে যানজট ফ্লাইওভারের পেছনে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ হয়। ভুক্তভোগিদের মতে, এ যেনো ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ভোগান্তি কেনা।
সড়কে যানজট হলে কোনো কোনো যাত্রী বাস থেকে নেমে পায়ে হেটে গন্তব্যে যান। কিন্তু ফ্লাইওভারে যানজটে পড়লে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও পুলিশের অবহেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
সরেজমিনে ফ্লাইওভারের কুতুবখালী প্রান্তে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা টু চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে যেসব লোকাল বাস আসছে, ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে সেগুলো যাত্রী ওঠানামা করানোর জন্য দাঁড়াচ্ছে। এতে করে ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। একই স্থানে আবার রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা থাকায় কিছুক্ষণ পর পর ফ্লাইওভারের কর্মীরা রাস্তা বন্ধ করে যাত্রী পারাপার করছে। তাতেও অনেক যানবাহন আটকা পড়ছে।
আবার যেসব গাড়ি ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে যাবে, সেগুলো সরু রাস্তায় যেতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। মূল রাস্তার প্রায় সবটুকু দখল করে নিয়েছে ফ্লাইওভার। ফলে ফ্লাইওভারের নিচে সামান্য সরু রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচলে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলে ফ্লাইওভারের কুতুবখালী প্রান্তে তিন রাত ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। ভুক্তভোগি কয়েকজন বলেন, ফ্লাইওভারের মুখে বাস থামার কারণেই মূলত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বাসগুলো ফ্লাইওভারের মুখে না দাঁড় করালে এভাবে যানজটের সৃষ্টি হতো না।
অন্যদিকে গুলিস্তানে চাঁদাবাজির জন্য গণপরিবহন আটক করায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, বেশ কিছু গাতি রাস্তায় পার্ক করে রাখা হয়েছে। সরু রাস্তা ওই সব গাড়ি দখল করেছে। আর পুলিশের সামনে তিন থেকে চারজন চাঁদা আদায় করছেন। কোনো বাসের ড্রাইভার চাঁদা দিতে দেরি করলে যানজট লেগে যায়। আবার চাঁদা আদায়ে সুবিধার জন্য গাড়িগুলোকে আটকে রাখা হয়।
নিয়মিত ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করেন ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, শুরু থেকেই ফ্লাইওভারের আয়ের জন্য কর্তৃপক্ষ যাচ্ছেতাই করছে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। চালু হওয়ার পর পরই ফ্লাইওভারের উপরে বাস স্টপেজ বানানো হয়েছিল। ফ্লাইওভারের মাঝখানে বাস দাঁড়াতে গিয়ে চলন্ত গাড়িগুলোর সমস্যা হতো। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বাসস্ট্যান্ড ও সিঁড়ি অপসারণ করা হয়েছে।
দনিয়ার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট তসিরুল হোসেন বলেন, একটা গাড়ি ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত টোল দেয় সামান্য পথ নিরাপদে যাওয়ার জন্য। সেখানে ফ্লাইওভারে উঠতে এবং নামতে যানজটে পড়তে হবে- এটা কেউ কী মেনে নিতে পারে? আবার যাত্রীদের প্রত্যেককে ৫ টাকা করে অতিরিক্ত দিতে হয়। তারপরও গুলিস্তানে চাঁদাবাজির জন্য পরিকল্পিতভাবে যানজটের সৃষ্টি করা হচ্ছে।
হানিফ ফ্লাইওভারের গোলাপবাগ দিয়ে কমলাপুর বা রামপুরাগামী গাড়িগুলো নামে। এদিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গাড়ি নামে। অথচ সন্ধ্যা হলেই গোলাপবাগে নামতে গিয়েও প্রতিদিন যানজটে আটকে থাকতে হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, ফ্লাইওভার থেকে নামার আগেই বাসগুলো দাঁড় করিয়ে যাত্রী নামানো হয়। এতে করে পেছনের দিকে যানবাহনের দীর্ঘ সারি থেকে যানজটের সৃষ্টি হয়। একই সময় ফ্লাইওভারের মুখেই নিচের রাস্তার গাড়িগুলো ঘুরানো হয়। দুটো মিলে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো ফ্লাইওভারের নামর মুখেই ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করে। সাথেই উপ-পুলিশ কমিশনারের (ওয়ারী) কার্যালয়। পুলিশের সামনে যানজটের সৃষ্টি হলেও পুলিশ বরাবরই নীরব থাকে। কয়েকজন ভুক্তভোগির অভিযোগ, ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ ডিএসসিসিকে ম্যানেজ করে নিচের রাস্তাগুলো সংস্কার করতে দেয়নি। সেই সাথে পুলিশকেও নিস্ক্রিয় করে রেখেছে।
গুলিস্তানের যানজট আরো ভয়াবহ। গুলিস্তানে যানবাহন নামতে গেলে যানজটে পড়তে হবে- এটা যেনো নির্ধারিত বিষয়। এখানেও ফ্লাইওভার অতিক্রম করার আগেই গাড়িগুলো ডান দিকে মোড় নেয়ার নামে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। পেছনের গাড়িগুলো আর সামনে এগুতে পারে না। এভাবে ফ্লাইওভারের উপরে কয়েক কিলোমিটার যানজট হয় হরদম।
ফ্লাইওভারের ঢাকা মেডিক্যাল অংশের চিত্র আরও ভয়াবহ। সেখানে এক লেনকে দুইভাগে ভাগ করে গাড়ি চলাচল করে। নামার আগেই ডানে মোড় নিতে গেলে পেছনের সব গাড়ি এক সাথে দাঁড়িয়ে যায়। আর যে সব গাড়ি সোজা যায় সেগুলো ঢাকা মেডিক্যাল মোড় পর্যন্ত গিয়ে আটকে থাকে। পুলিশ ফ্লাইওভারের গাড়ি আটকিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডসহ পুরান ঢাকার গাড়িগুলো পার করতে ব্যস্ত থাকে। এতে করে ফ্লাইওভারের মুখে ভয়াবহ যানজট লেগেই থাকে।
শনির আখড়া থেকে গুলিস্তানে নিয়মিত যাতায়াত করেন হোসেন আলী। বঙ্গবাজারের একটি দোকানের এই কর্মচারী গতকাল বলেন, নিচের রাস্তা দিয়ে গুলিস্তান গেলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট লাগে। দ্রুত যেতে ফ্লাইওভারে উঠেছি। ভাড়ার চেয়ে ৫ টাকা বেশি দিয়ে দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও গুলিস্তান পৌঁছাতে পারিনি।
চিটাগাং রোড টু গুলিস্তান রুটের বাস চালক হোসেন মোল্লা বলেন, এ যানজট শুধু আজ না, প্রতিদিনই হচ্ছে। তবে আজ বেশি হওয়ায় আপনারা খোঁজ নিচ্ছেন। প্রতিদিনই ফ্লাইওভার থেকে নামতে জ্যামে পড়ে থাকতে হয়। তারা টাকা নিতে ঠিকই জোড়াজুড়ি করে অথচ রাস্তা পরিষ্কার করে না। আর পুলিশের সামনে ব্যাপক চাঁদাবাজির কারণেও যানজট লেগে থাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন