পাচার হয়ে আসা স্বর্ণ ধরা পড়ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে। কাস্টমস ও আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যত স্বর্ণ ধরা পড়ছে, তার কয়েকগুণ বেশি স্বর্ণ পাচার হয়ে যাচ্ছে। যত ধরা পড়েছে তার চেয়েও বেশি স্বর্ণ নিরাপত্তাকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এসব স্বর্ণ চোরাচালানে নেয়া হচ্ছে নিত্য-নতুন কৌশল ও পদ্ধতির আশ্রয়। চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বাজারে সরবরাহ করছে। আর এ কাজে তারা নিজস্ব বাহক যেমন কাজে লাগাচ্ছেন, তেমনি টাকার টোপে কখনো পাইলট, কখনো ক্রু, কখনো বা বিমানবালাকেও কাজে লাগাচ্ছেন।
এছাড়াও প্লেনের ক্লিনার, ট্রলিম্যান এমনকি ইঞ্জিনিয়াররাও এই চক্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে স্বর্ণ পাচার চালিয়ে যাচ্ছেন। যাত্রীবেশি বাহকের সঙ্গে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মটর, দেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির উপরের হ্যান্ডেল, মানিব্যাগে করে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটছে। স্বর্ণবারের ওপর কালো অথবা সিলভারের প্রলেপ দিয়েও পাচারের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে কখনো কখনো। রোগী সেজে হুইল চেয়ারে, উরুতে অ্যাংকলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমর বন্ধনীর ভেতরে, শার্টের কলারের ভেতরে, স্যান্ডেলের সঙ্গে, সাবান কেসে করে, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপটরে লুকিয়ে, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কৌটায় করে, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতর, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতর, মানি ব্যাগের ভেতর ও গলায় স্বর্ণের চেইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে লকেট হিসেবে আনা হচ্ছে। চোরাচালানে জড়িত ২৫টি সিন্ডিকেটকে পুলিশ শনাক্ত করেছে। এই দলে একাধিক রাজনৈতিক নেতা, মানি এক্সচেঞ্জ ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নানা রকমের অপরাধ কর্মকান্ড ঘটছে। ওই সব বিমানবন্দরে অপরাধ কর্মকান্ডের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বর্ণপাচার। বিদেশি এজেন্টদের পাশাপাশি দেশি এজেন্টরা বেশি লাভের আশায় বেপরোয়া হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা বাংলাদেশিদের সঙ্গে আঁতাত করে পাচার করছে। এরই মধ্যে পাচারকারীদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। কোন কোন দেশের মাফিয়া বাংলাদেশে সক্রিয় আছে, তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তালিকায় ২৫ দুর্র্ধর্ষ চোরাকারবারির নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে ১১ জনই অবস্থান করছে দুবাইয়ে।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বর্ণ চোরাকারবারিদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে দুর্র্ধর্ষ চোরাকারবারিদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে তাদের ভাড়ায় খাটাচ্ছে তালিকাভুক্ত কারবারিরা। তালিকাভুক্তরা বেশ প্রভাবশালী। তাদের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাছাড়া আছে রাজনৈতিক কানেকশন। তাদের ছবিসহ জীবনবৃত্তান্ত সব কয়টি বিমানবন্দরে থাকলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কৌশলে তারা বাহকের মাধ্যমে স্বর্ণের চালান পার করে দিচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন হলো ফিরোজ আলম। বর্তমানে সে দুবাই অবস্থান করছে। আরেক স্বর্ণ পাচারকারীর নাম মোহাম্মদ আনিস। আরেক কারবারি মোহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান। তার বাসা সায়েদাবাদ। একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ করেছে। বর্তমানে সে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছে। তবে প্রায় সময়ই থাকে দুবাই। আরেকজন আবদুল আউয়াল। তার সঙ্গে শাসকদলের একাধিক নেতার যোগাযোগ আছে। ফারুক আহম্মেদ। বর্তমানে অবস্থান করছে দুবাই। দীর্ঘদিন ধরে সে স্বর্ণপাচার করছে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে। তাদের মধ্যে সোহেল রানা, সুমন সারোয়ার, খলিল রহমান, মনির আহম্মেদ, ওয়ায়েদউল্লাহর নাম রয়েছে। এছাড়া মিরপুরের সাইফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের মঞ্জুর হোসেন, পল্লবীর সামসুল হুদা, মুন্সীগঞ্জের ইসলাম শেখ, রাজবাড়ীর মোহাম্মদ হানিফ, মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ রুবেল স্বর্ণপাচারের সাথে জড়িত রয়েছেন।
সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে স্বর্ণ আসার পরপরই দেশের সীমান্ত এলাকাগুলো দিয়ে ১৭ জন ভারতীয় চোরাকারবারি সক্রিয় আছে। তারা বাংলাদেশের কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত চালান নিয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা, বেনাপোল ও হিলি সীমান্ত দিয়ে বেশি স্বর্ণপাচার হচ্ছে। ভারতীয় কারবারিরা বাংলাদেশের মোবাইল সিম ব্যবহার করছে। তারা এসএমএসের মাধ্যমে চালানের তথ্য আদান-প্রদান করছে। গোয়েন্দাদের তালিকা অনুযায়ী রূপসাহা, গোপাল বিজন, বিজন হালদার, লক্ষণ সেন, গোবিন্দ বাবু, লালু জয়দেব, গওহর প্রসাদ, সঞ্জীব, রামপ্রসাদ, মিন্টু, সুমন চ্যাটার্জি, রিয়াজ, তপন সাহা, ডালিম, মোনায়েম, ফারুক, বসাক চ্যাটার্জি ও স্বপন সাহা বাংলাদেশে স্বর্ণপাচারের সঙ্গে জড়িত।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপস অ্যান্ড মিডিয়া) মো. আলমগীর হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। নিয়মিতই অভিযান চালানা করা হচ্ছে। এ অপরাধের সাথে জড়িতদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, আগে অনেক বড় বড় চালান আসত। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে বর্তমানে আগের চাইতে বড় চালানগুলো আসা বন্ধ হয়েছে। তারপরও অসাধু কারবারিরা কৌশলে স্বর্ণ আনার চেষ্টা করছে। তাদের গ্রেফতারেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন বলে জানান তিনি।
একাধিক শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরে কর্মরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশে স্বর্ণের বড় চালান নির্বিঘ্নে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যায়। এ কাজে সহায়তা করেন শুল্ক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও বিমানের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ১০ তোলা ওজনের একেকটি সোনার বার বিমানবন্দর থেকে বাইরে এনে দিলে চোরাচালানিদের কাছ থেকে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পান তারা। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসার সময় বিমানের কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বর্ণ পরিবহনে সহায়তা করেন। বাহকদের হাতে স্বর্ণ ধরিয়ে দেন দুবাইয়ে অবস্থানরত চক্রের প্রধানরা। বাহক সেই স্বর্ণ বিমানের আসনের নিচে, শৌচাগারে বা অন্য কোনো স্থানে লুকিয়ে রেখে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। পরে বিমানবন্দরে কর্মরত লোকজন নিজ দায়িত্বে সেই স্বর্ণ বের করে বাইরে নিয়ে আসেন। মানি এক্সচেঞ্জের মালিকেরা স্বর্ণ হাতবদলে মধ্যস্থতা করে কমিশন পান, আবার তারা কখনো কখনো টাকা বিনিয়োগও করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন