রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

দেশে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন টিভির পর্দা কিংবা খবরের কাগজে চোখ রাখলেই দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসা হরেক রকমের নারী নির্যাতনের খবর। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই। যদিও অনেকেই মনে করেন, এটা যতটা না মাঠের বাস্তবতা, তার চেয়ে বেশি মিডিয়া জগতের অতিরঞ্জন। তবে আসকের মতো সংগঠনগুলোর বছরওয়ারী পরিসংখ্যানকে আমলে নিলে স্বীকার করতেই হবে, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণসহ নারীঘটিত অপরাধের সংখ্যা ও ব্যাপ্তি আসলেই বেড়েছে।

এসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণকে ভীষণভাবে আলোড়িত করছে। সবাই উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। যে যার মতো করে ভাবছে, কেন এমন হলো, পরিত্রাণের উপায়ই বা কী? বিজ্ঞজনেরা সমস্যার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে করণীয় বাৎলাচ্ছেন। তরুণ-যুবা, রাজনীতিক-সমাজকর্মীরা রাস্তায় নেমে মিটিং-মিছিল, শ্লোগান-বিক্ষোভে চারিদিক মুখরিত করে তুলছে। সবার মুখে একই বক্তব্য, একই ধ্বনি: অপরাধীদের দ্রæত গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে, কঠোরতর করতে হবে আইনের বাঁধন। খুঁজে বের করতে হবে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের। এমন শাস্তি বিধান করা চাই, যা অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

যদি মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের দিকে তাকান যায় তা হলে দেখা যাবে, অনাদিকাল থেকে দেশে দেশে বিভিন্ন অবয়বে মানব সমাজে নারীক‚ল নিগ্রহের শিকার হয়ে আসছে। ঘরে কী বাইরে, পথে-প্রান্তরে, কর্মক্ষেত্রে কোথায় নয়? যুদ্ধ-বিগ্রহে নারীরা অন্যতম সহজ টার্গেট হয়েছে ‘বিজয়ী বীরপুরুষ’দের বিকৃত লালসার। নারীর আহাজারিতে বারে বারে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। কী অপরাধ তাদের? এরাই তো সদা মায়ের আদরে, বোনের স্নেহে, স্ত্রীর ভালবাসায় পুরুষকে আগলে রেখেছে, প্রেরণা যুগিয়ে গেছে। সমাজ-চিন্তকদের একটি অংশ মনে করেন, এ সবেরই মূলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজব্যবস্থা। পুরুষ নারীকে কেবল ‘নারী’ হিসেবে দেখে এসেছে, ‘মানুষ’ হিসেবে নয়। তাকে বিবেচনা করেছে ভোগ্যপণ্য, মনোরঞ্জনের সামগ্রী কিংবা শুধুই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। যুদ্ধক্ষেত্রে লুটের মাল। অসহায়, বিপন্ন নারী দেখলে যেন ‘বীরপুরুষ’দের ‘পৌরুষ্য’ জেগে উঠে।

নারীর প্রতি সহিংসতা ও অপরাধ বিশ্লেষণে এ ব্যাখ্যাকে অনেকেই আবার একদেশদর্শী মনে করেন। তাদের ধারণা, এখানে নারী ও পুরুষকে পরষ্পরের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে, ফলে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও সন্দেহ-অবিশ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে, সমাজে এক সার্বিক অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি প্রেম-ভালবাসার মায়াকাননের পরিবর্তে পরিণত হচ্ছে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও পারষ্পরিক সহিংসতার এক অগ্নিবলয়ে। এটা তো অনস্বীকার্য যে, যুগে যুগে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানব সভ্যতা বিনির্মাণে, একে এগিয়ে নিতে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে গেছে। বিপদে আপদে, সময়ে অসময়ে একে অপরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে প্রশান্তির বাতায়ন। পুরুষ যখন মাঠে-ঘাটে ঘাম ঝরিয়ে গেছে, নারী তখন পরম যতেœ আগলে রেখেছে তার ঘর। প্রিয় পুরুষের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় পথ-পানে চেয়ে থেকে অধীর আগ্রহে বসে থাকার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে এক অনাবিল আনন্দ। মায়ের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ মমত্ব কিংবা স্ত্রীর প্রতি অতুলনীয় ভালবাসার অনেক গল্প ইতিহাসে চিরকালের জন্য অমর হয়ে আছে। বায়েজিদ বোস্তামী কিংবা বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির সেই হৃদয়স্পর্শী কাহিনীগুলো একবার ভেবে দেখুন না কেন? মাকে নিয়ে গাওয়া জেমসের গানটি কেন এত জনপ্রিয়? পৃথিবীর যত নভেল-নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা গল্প-উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য নর-নারীর পারষ্পরিক প্রেম-ভালবাসাই নয় কি? সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রেমময়ী স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মারক হিসেবে তাজমহল নির্মাণ করে আজও কীভাবে অমর হয়ে আছেন তা কি একবার ভেবে দেখেছেন? স্মরণ করুন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর দু’টি চরণ: ‘এ পৃথিবীর যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

নীতিবাদীরা অবশ্য দায় চাপাতে চান সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের উপর। তাঁরা মনে করেন, দিনের পর দিন সমাজটি উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তরুণ-যুবাদের মানসপটে গেড়ে বসেছে টিক-টক কিংবা লারে-লাপ্পা সংস্কৃতি। তাদের চিন্তা-চেতনার চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘খাও, দাও, ফুর্তি কর’। অনেকেই আবার জীবনকে উপভোগ করতে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে বুঁদ হচ্ছে মাদকের নেশায়। চা-বিস্কুট, চকলেট-চানাচুরের জায়গা দখল করেছে, ইয়াবা-হেরোইন-ফেন্সিডিল। এমনিতেই, এ বয়সের ছেলে মেয়েদের যৌন আবেগ প্রবল, এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়ার একটি অংশ বিভিন্ন কায়দায় যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে ক্রমাগত তাদের আবেগকে আরও উস্কে দিচ্ছে। তার উপর সবার হাতেই এখন এক বা একাধিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন। যখনি মন চায়, বাটনের এক চাপে অন্ধকার জগতে হারিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। ফলে, ভালো কাজ, ভালো চিন্তা কিংবা সমাজকল্যাণধর্মী কর্মকান্ডে যে মানসিক স্থিরতা ও নৈতিক প্রেরণা দরকার, তা তাদের জুটছে না। এ বয়সের ছেলে-মেয়েরা তো সদা কিছু না কিছু করতে চায়। ভালো কিছু যখন হচ্ছে না, তারা জড়িয়ে পড়ছে চুরি-চামারি, ছিনতাই-ছ্যাঁচড়ামি, গুন্ডামি-পান্ডামি, ইভ-টিজিং, খুন-ধর্ষণসহ তাবৎ অপকর্মে। কাজেই, তাদের মতে, সমাজে তরুণ যুবাদের অপরাধপ্রবণতা রুখতে হলে নৈতিক শিক্ষার উপর গুরত্ব আরোপ করতে হবে, ছেলে-মেয়েদের গঠনমূলক ও সমাজ কল্যাণ ধর্মী কর্মকাÐে সম্পৃক্ত করতে ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিল্প-সংস্কৃতির আড়ালে যৌন সুড়সুড়ি দানকারী সব ধরনের এন্টারটেইনমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও দেখার সুযোগ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

সমাজের একটি অংশের ভাবনা, এসব কিছুই না। আসল ঘটনা সুশাসনের অভাব ও সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। এলাকায় এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে এসব গুন্ডা-মাস্তানদের পুষেণ, তাদের ছত্রছায়া দিয়ে যান। ফলে এরা কারও পরোয়া করার ধার ধারে না। যখন যা ইচ্ছে করে বেড়ায়। পাড়ায় মহল্লায় মোড়ে মোড়ে বসে আড্ডাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, ওড়না ধরে টানাটানি, প্রেম প্রস্তাবের নামে জোরপূর্বক তাদের সাথে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে বাধ্য করা, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, খুন-ধর্ষণ, একে ওকে মারধর করে নিজের অবস্থান জানান দেয়া, মাঝে মাঝে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করাÑ এসবই তাদের নিত্যকার কাজ। থানা-পুলিশকে তারা থোড়াই কেয়ার করে।
দেশময় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মৃত্যুদÐের বিধান সংযোজন করেছে ধর্ষকের শাস্তি হিসাবে। প্রশ্ন জাগে, আইনি বাঁধন কঠোর থেকে কঠোরতর করে সমস্যার সমাধানে কতটুকু অগ্রগতি হবে? আইন যত কঠোরই হোক, তা প্রয়োগ করতে হলে অপরাধীকে তো বিচারালয় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। যেসব সহায়-সম্বলহীন নারী সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তদের হাতে নিপীড়িত-ধর্ষিত হয় তাদের ক’জন থানা-পুলিশ কোর্ট-কাছারি পর্যন্ত যাওয়ার সাহস বা সংগতি রাখে? বিষয়টি একবার কোর্ট পর্যন্ত গড়ালে নিষ্পত্তি হতে যে সময় লাগবে, সে সময়কাল পর্যন্ত ভিকটিমকে অপরাধীচক্র, তাদের দোসর ও পৃষ্ঠপোষকদের আক্রোশ থেকে সুরক্ষা দিতে আমরা কতটুকু সক্ষম? কোর্টে মামলা সাক্ষ্য-সাবুদের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষীদের মধ্যে ক’জনা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে নিজেরাও ভিকটিমাইজড হতে রাজি হবে? অর্থ-বিত্তে বলীয়ান দুর্বৃত্তরা পানির মতো টাকা ঢালবে, ঝানু সব আইনজীবীদের হায়ার করবে, ঠিক একই ব্যবস্থা কি ভিকটিম করতে পারবে? কাজেই, কঠোর আইন ধর্ষক ও দুর্বৃত্তদের একটি কড়া বার্তা দেবে, তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু, সঠিক ফল পেতে হলে সরকার ও সমাজকে দুর্বৃত্তরা যেন প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। তা হলে এসব অপরাধ এমনিতেই কমে আসবে, কোর্ট পর্যন্ত যাওয়া লাগবে না।
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ৩১ অক্টোবর, ২০২০, ১২:২৪ পিএম says : 0
Only answer is to rule our country by the Law of Allah.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন