মহিউদ্দিন খান মোহন
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির নতুন জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে গত ৬ আগস্ট শনিবার। এ কমিটিতে ১৭ জন স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য, ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৭৩ জন উপদেষ্টাসহ মোট ৫৯২ জনের নাম রয়েছে। স্ট্যান্ডিং কমিটির দুটি পদে এখনো পর্যন্ত কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। হয়তো অচিরেই তা দেয়া হবে। এছাড়া আরো ছয়টি সম্পাদকীয় পদ খালি রয়েছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নয়াপল্টন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এ কমিটি ঘোষণা করেন। কমিটি ঘোষণাকালে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি জানান- দলের চেয়ারপার্সন এ কমিটি তৈরি করেছেন। অত্যন্ত ভাইব্রেন্ট কমিটি হয়েছে, ডায়নামিক একটি কমিটি হয়েছে, যেসব কোয়ালিটি একটি সংগঠনের জন্য প্রয়োজন, প্রতিটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এ কমিটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উপযোগী ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সঙ্গত কারণেই বিএনপির নতুন জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রতি দেশবাসীর আগ্রহ ছিল প্রচ-। বিশেষত তিন বছরের স্থলে প্রায় সোয়া ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত কাউন্সিল-অধিবেশন মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল। কাউন্সিলের পর বলা হয়েছিল- যথা শিগগিরই নতুন জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সে কমিটি ঘোষণা করতে সাড়ে চার মাস লেগে যাওয়াটা অনেকেরই কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। বলা হয়েছিল, কাউন্সিল দায়িত্ব অর্পন করায় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ কমিটি গঠন করবেন। মাঝেমাঝে খবর বেরুত যে, খালেদা জিয়া কমিটির ব্যাপারে একাই কাজ করছেন, যাচাই-বাছাই করছেন। তিনি ‘সুচিন্তিত’ একটি কমিটি গঠনের চেষ্টা করছেন। যেটি আগামীদিনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ফলে জনমনে প্রত্যাশা ছিল যে, এমন একটি কমিটি আসবে যেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকবে না, দল বা দলের বাইরে প্রশ্ন উঠবে না।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল কমিটি ঘোষণা পর এবার যে ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, ইতোপূর্বে কখনোই কমিটি ঘোষণার পর এমনটি হয়নি। আগের কমিটিগুলো ঘোষণার পর সন্তোষ-অসন্তোষের ঘটনা ঘটলেও পদত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। এবার কমিটি ঘোষণার চার ঘণ্টার মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু ও সহ-প্রচার সম্পাদক শামিমুর রহমান শামীম কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। এর পরদিন পদত্যাগ করেছেন ছাত্রদলের এক সময়ের তুখোড় নেতা ও জিয়া পরিষদের সহকারী মহাসচিব অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার। গত ১০ আগস্ট দল থেকে পদত্যাগ করেছেন সাবেক এমপি কাজী সলিমুল হক কামাল ও ভোলার দৌলতখান পৌর বিএনপির সভাপতি হারুন অর রশিদ খান। এছাড়া আরো অনেকেই দল ছাড়া অথবা দলে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার আভাস দিয়েছেন।
কমিটি ঘোষণার পর অনেক পরীক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ এবং যোগ্য নেতা তাদের নাম কমিটিতে অথবা যথাস্থানে না দেখে বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এদেরমধ্যে দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী চট্টগ্রামের নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি স্থায়ী কমিটিতে স্থান পাবেন এমন একটি ধারণা দলের নেতাকর্মী এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ছিল। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে দেখা গেল স্থায়ী কমিটিতে নোমান ঠাঁই পাননি, ঠাঁই পেয়েছেন সাবেক যুগ্ম মহাসচিব বর্তমানে ভারতের শিলং এ বসবাসরত সালাহ উদ্দিন আহমেদ। আব্দুল্লাহ আল নোমানের মতো একজন অভিজ্ঞ ও ঝানু নেতাকে কেন বঞ্চিত করা হলো তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে স্থায়ী কমিটি হলো দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম। সেখানে প্রয়োজন অভিজ্ঞ ও রাজনীতিতে পরিপক্ব নেতাদের।
এ দিকে কমিটি ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে নানা রকম খবর প্রকাশিত হয়েছে। ওইসব খবরে কমিটি গঠনের নেপথ্যের অনেক বিষয় বেরিয়ে এসেছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপার্সনের একজন বিতর্কিত বিশেষ কর্মকর্তা, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সেজন্য কমিটির গরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তাদের পছন্দের লোকেরা স্থান পেয়েছেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো ৬ আগস্ট কমিটি ঘোষণার পরদিন জাতীয় দৈনিকগুলোর বেশিরভাগ শিরোনাম ছিল নেতিবাচক। আর ভেতরে ছিল বঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া নেতা এবং দলের ভালো চান এমন কর্মীদের ক্ষোভ ও হতাশার খবরে ভরা। একটি পত্রিকাতেও কোনো জেলা বা উপজেলা কমিটি থেকে নতুন নির্বাহী কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়ে কোনো বিবৃতি দেখা যায়নি।
বরং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি ও কোটারি স্বার্থ রক্ষার খবর ছিল বেশি। বাংলাদেশ প্রতিদিন ৭ আগস্ট একটি রিপোর্ট লিখেছে- নতুন এ কমিটি নিয়ে দলের অনেক সিনিয়র নেতার বক্তব্য- ‘কমিটি হয়েছে চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ের ক্ষমতাধর বিতর্কিত এক কর্মকর্তা আর নয়াপল্টন কার্যালয়ের এক নেতার মনমর্জি অনুযায়ী। তাদের অনুগত ব্যক্তিরা বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। যারা তাদের তুষ্টি অর্জন কিংবা চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন তারাই সাবেক সহ-দফতর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনির মতো কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন, বাদ পড়েছেন সম্পাদক পদ থেকে।’ একই প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘আগের কমিটির একাধিক ভাইস চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চেয়ারপার্সন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে ব্যানার হিসাবে সামনে রেখে ও তাদের নাম ভাঙিয়ে একটি চক্র এই পদবাণিজ্য করেছে। যারা নিজেরাই বিতর্কিত এবং দলের ভিতরে সরকারের বড় এজেন্ট হিসাবেও পরিচিত। এসব বিতর্কিত ব্যক্তিই এ কিমিটি গঠন করেছেন। যে কমিটিতে ত্যাগী, দক্ষ, পরীক্ষিতদের তেমন কোনো স্থান হয়নি।’ দৈনিক কালের কণ্ঠ লিখেছে- ‘বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বাসায় সার্বক্ষণিক বসবাসকারী তাঁর বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের পছন্দের লোকজনই ঘোষিত কমিটিতে প্রাধান্য পেয়েছেন। কারণ অন্য কোনো সিনিয়র নেতা এমনকি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কমিটি সম্পর্কে আগে ভাগে কিছু জানতেন না।’ (৭ আগস্ট ২০১৬)।
কমিটি ঘোষণার পর দলের মধ্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা আর চাপা থাকেনি। নেতাকর্মীদের ক্ষোভের কথা ইতোমধ্যেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মোসাদ্দেক আলী ফালু, শামীম এবং বাহারের পথ আরো অনেকেই অনুসরণ করতে পারেন এমন আভাস দিয়েছে প্রায় সবগুলো গণমাধ্যম। ৮ আগস্টের দৈনিক যুগান্তর লিখেছে- ‘বিএনপির ঘোষিত কমিটি নিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচ- ক্ষোভ ও গভীর হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। একই দিন বাংলাদেশে প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে ভাইস-চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষুব্ধ নোমান বলেছেন- ‘এক সময় আমি যখন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক তখন অনেকেই দলের সদস্য ছিলেন না। তারাও আজ বড় বড় পদে। রাজনীতিতে এমনটা হয়। তবে নেতাকর্মীরা কষ্ট পেয়েছে। আমিও কষ্ট পেয়েছি। আমি হতাশ ও বিস্মিত হয়েছি। পদে থাকার ইচ্ছা আমার নেই। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।’
এদিকে কমিটি ঘোষণার পরদিন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম প্রতিবেদন প্রচার-প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে- একটি রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কমিটি ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের যে ধরনের ভিড় ও প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায় ৭ আগস্ট বিএনপির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তা একেবারেই ছিল না। বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে- ‘নতুন কমিটিতে যারা বড় বড় পদ পেয়েছেন তারাও গতকাল নয়া পল্টনে যাননি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রায় জনশূন্য ছিল কার্যালয়টি। জানা যায়, এবারই প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী কমিটি ঘোষণার পরদনি বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল একেবারেই দলীয় নেতাকর্মী শূন্য। এ প্রসঙ্গে যুবদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি জাকির আহমেদ পত্রিকাটিকে বলেছেন- ‘বহুদিনের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও অভিজ্ঞ নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়নই হচ্ছে দল ও দলীয় কার্যালয়ের এই দূরবস্থার কারণ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ইতোমধ্যেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বিএনপির ঘোষিত কমিটি দলটিকে বেগবান করার চাইতে অধিকতর শ্লথ করে দিতে পারে। আগামী দিনের রাজনীতি এবং আন্দোলন-সংগ্রামে এ কমিটি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে সে প্রশ্নও উঠেছে। এ প্রশ্ন ওঠার কারণ হলো কাউন্সিলের আগে পরে বিভিন্নভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিগত আন্দোলনে যারা নিষ্ক্রিয় ছিল, দায়িত্ব পালন করেনি, তাদেরকে এবার কমিটি থেকে বাদ দেয়া হবে। এমনকি সংবাদ মাধ্যমে এমন খবরও বেরিয়েছিল যে, ক্ষুব্ধ চেয়ারপার্সন নিষ্ক্রিয় ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ নেতাদের তালিকাও তৈরি করেছেন। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর দেখা গেল ব্যর্থ নিষ্ক্রিয়দেরকে বাদ তো দেয়া হয়ইনি, উপরন্তু তাদের বেশিরভাগেরই পদোন্নতি হেেছ! আর যারা আন্দোলন সংগ্রামে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন, তারা বঞ্চিত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক যুগান্তর গত ৮ আগস্ট ‘নেতারা কি পথে নামবেন’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদনে কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের অভিমত তুলে ধরেছে। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন- ‘ঘোষিত এ কমিটি দিয়ে কীভাবে বিএনপি তার হারানো ইমেজ ও আন্দোলন পুনরুদ্ধার করবে তা বোধগম্য নয়। এমনিতে দলটি বিগত আন্দোলনে সফল না হওয়ায় তাদের নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় যে প্রক্রিয়ায় নতুন কমিটিতে নেতা নির্বাচন করা হয়েছে তাতে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের আস্থা হারানোর ঝুঁকি থাকবে।’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেনÑ ‘যারা বিগত আন্দোলন সংগ্রামে সম্পদ রক্ষার জন্য আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তারাই বিএনপির নতুন কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। তাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজনের জায়গা হয়েছে। ফলে বিগত আন্দোলনের মতো সামনের কর্মসূচিগুলোতেও এসব নেতা নিষ্ক্রিয়ই থাকবেন। আবারো তাদের ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দেখা যাবে। জনস্বার্থের কোনো কর্মসূচি দেয়া হলেও তা সফল হবে না। কারণ এ দলে কেউ সক্রিয় নন। শুধু পদ পাওয়ার জন্য দলের নেতারা সেভাবে সক্রিয় থাকনে, কিন্তু কর্মসূচি পালনের জন্য তাদের ন্যূনতম সক্রিয়তা দেখা যায় না।’ একই পত্রিকাকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে.জে. মাহবুবর রহমান (অব.) বলেছেন- ‘দলের স্থায়ী বা নির্বাহী কমিটি আরো সুন্দর হওয়া উচিত ছিল। যারা দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, বা করার জন্য প্রস্তুত, সে ধরনের নেতাদের স্থান দেয়া উচিত ছিল। আমি মনে করি নতুন কমিটি নিয়ে খালেদা জিয়ার যে রূপকল্প তা বাস্তবায়ন করা সহজসাধ্য হবে না।’
এদিকে ৯ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ বিএনপির ঘোষিত কমিটি নিয়ে দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ক্ষুব্ধ। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তার মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এ নিয়ে তিনি মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়- তারেক রহমানের একটি প্রতিনিধি দল গত ৭ আগস্ট গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার সঙ্গে এ নিয়ে বাকবিত-ায় জড়িয়ে পড়েন। সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে- ‘তারেক রহমানের পরামর্শের ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপার্সনকে ভুল বুঝিয়েছেন মহল বিশেষ।’
একই দিনে দৈনিক যুগান্তর ‘টালমাটাল অবস্থা বিএনপির’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে লিখেছেন- ‘নতুন কমিটি নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো ওড়া তো দূরের কথা শুরুতেই হোঁচট খেল বিএনপি। দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা ছিল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের পরপরই দ্রুততম সময়ে বিএনপি জনগণের সামনে নতুনভাবে আবির্ভূত হবে, নিদেনপক্ষে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশের ঘোষণা আসবে। দলীয় চেয়ারপার্সন রাজপথে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হবেন। কিন্তু এসব প্রত্যাশার রঙ শুরুতে ফিকে হতে বসেছে। কমিটি গঠন পরবর্তী ক্ষোভ অসন্তোষ নিয়ে দলটিকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।’
কেউ কেউ আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে, নেতাকর্মীদের ক্ষোভ-অসন্তোষকে আমলে নিয়ে দলের হাই কমান্ড হয়তো ঘোষিত কমিটিতে কিছুটা পরিবর্তন আনবে। কিন্তু মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি মন্তব্য তাদের সে প্রত্যাশার গুড়ে বালি ছড়িয়ে দিয়েছে। কমিটি ঘোষণার দুই দিন পর গত ৮ আগস্ট নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেনÑ কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন আমি বঞ্চিত হয়েছি- তাহলে তার উচিত হবে পরবর্র্তী কাউন্সিলের জন্য অপেক্ষা করা। তিনি বলেন, বিক্ষোভ করে তো কোনো লাভ হবে না। আর ধৈর্য তো ধরতেই হবে।’
পত্র-পত্রিকায় নেতাকর্মীদের বক্তব্য মন্তব্য থেকে অনুমান করা যায় যে, ঘোষিত কমিটি বিএনপিকে চাঙ্গা করার পরিবর্তে নতুন করে স্থবির করে দিতে পারে। মহাসচিব মির্জা আলমগীর যতই বলুন কমিটি ভাইব্রেন্ট ও ডায়নামিক হয়েছে কিন্তু আদতে তা কতোটা হেেয়ছ সেটা বেশ অনুমান করা যাচ্ছে। তবে, কমিটি নিয়ে যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তাতে এ কমিটি বিএনপিকে কোন পথে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে। কাউন্সিলের পর মির্জা আলমগীর বলেছিলেন- বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উঠে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বিএনপি এখন ঝড়ো হাওয়ায় ডানাভাঙা পাখির মতো পড়ে আছে। সেখান থেকে ডানা ঝাঁপটে কবে সে পাখি আবার আকাশে উড়তে পারবে তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে।
এবারের কাউন্সিলে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন করে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে সর্বস্তরে ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি অনুসরণ করা হবে। সে অনুযায়ী মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতি ও কৃষকদলের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে বহুসংখ্যক নেতা একই সঙ্গে একাধিক পদে অধিষ্ঠিত আছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ একইসঙ্গে দলের দফতর সম্পাদকের দায়িত্বও হাতে নিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, যারা আইন তৈরি করেছেন তারাই যদি তা ভঙ্গ করেন তাহলে সে আইন কার্যকর হবে কী করে?
আবার কথা উঠেছে এবারের কমিটিতে নেতাদের সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজনদের পদ দেয়া নিয়ে। কোনো কোনো নেতার কন্যা-পুত্রবধূও নির্বাহী কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। কোন যোগ্যতা বলে তারা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেলেন এ প্রশ্ন সবার। পিতা বা অভিভাবকের বড় নেতা হওয়াই যদি যোগ্যতার মাপকাঠি হয় তাহলে বলতেই হয় ওরা ভাগ্যবান।
এ লেখাটি যখন শেষ পর্যায়ে তখন সুনামগঞ্জ থেকে ফোন করলেন সাবেক একজন ছাত্র নেতা। তিনি বললেন- ‘ভাই, বিএনপির একজন বড় নেতা দিতে পারেন যিনি আমার পিতা হতে রাজী হবেন।’ জিজ্ঞেস করলাম- কেন? বললেন, ভাবছি এফিডেফিট করে তাকে পিতা বানাব। আবারও জিজ্ঞেস করলাম- কেন? নাদির বললেন- চৌত্রিশ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করি। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো এ দলের জন্য ব্যয় করলাম। কিন্তু এবারও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হতে পারলাম না। অথচ বাবার নামে কতজন কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে গেল! সে জন্যই পিতা বদল করতে চাই।
সাবেক ছাত্রনেতার এই বক্তব্যে যে ক্ষোভ-হতাশা ফুটে উঠেছে তা আজ অনেকের মনেই তুষের আগুনের মতো জ্বলছে। কেউ প্রকাশ করতে পারছে, কেউ করছে না। এ তুষের আগুন যদি আরো ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বিএনপি যে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে সে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো- বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা এটা উপলব্ধি করতে পারছেন কিনা?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
mohon91@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন