ত্রিমুখী সঙ্কটে পড়ে গেছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাত। করোনা মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কা দরজায় কড়া নাড়তেই নতুন কার্যাদেশ কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। পাশাপাশি যেসব কার্যাদেশ আসছে সেগুলো উৎপাদন খরচের চেয়েও কম মূল্য প্রস্তাব করছেন ক্রেতারা। ক্রেতাদের ধরে রাখতেই লোকসান দিয়ে কার্যাদেশ নিতে হচ্ছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে। এদিকে করোনায় ইতোমধ্যে বিজিএমইএভুক্ত ৩ শতাধিক কারখানা বন্ধ হওয়ায় ৭১ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এছাড়া ছোট আকারের অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে বলে জানা গেছে।
করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো ছিল কার্যত বন্ধ। পণ্য জাহাজিকরণও অনেকটা থমকে ছিল। এই পরিস্থিতিতে এপ্রিল মাসে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করা সম্ভব হয়; যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৫ শতাংশ কম। তবে ইউরোপের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি এবং দেশের পোশাক কারখানাগুলো খুলতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এ খাত।
গার্মেন্ট খাত নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৩৯ ভাগ তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন ব্যয়ের চেয়েও কম মূল্যে কার্যাদেশ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এই হ্রাসকৃত মূল্যও চুক্তিকৃত সময় ৯০ দিনের মধ্যে পাচ্ছেন না গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা। মূল্য পরিশোধে ২২০ দিন পর্যন্ত সময় চাচ্ছেন তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পোশাকের রফতানিমূল্য গত বছরের একেই সময়ের তুলনায় কমেছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর কেবল সেপ্টেম্বর মাসে রফতানিমূল্য কমেছে আগের বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। জানতে চাইলে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মো. হাতেম বলেন, সংগঠনের অধিভুক্ত ৩০-৩৫টি কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো কয়েকটি কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। এতে ৩০-৩৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। ছাঁটাই হয়েছে আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। বিজিএমইএ’র পরিচালক রেজওয়ান সেলিম বলেন, করোনার ধাক্কায় বিজিএমইএভুক্ত ৩ শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে ৭১ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। এছাড়া ছোট আকারের যেসব কারখানা বন্ধের খবর বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে বিজিএমইএ জ্ঞাত নয়।
করোনা মহামারির প্রথম ধাক্কার পর তৈরি পোশাকের বাজার খোলার পর আশার আলো দেখা যাচ্ছিল। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধির খবর এসেছিল পোশাক খাত থেকে; অক্টোবর মাসে এসে সেই ধারায় ছেদ পড়েছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার আশংকায় আবার তৈরি পোশাকের কার্যাদেশ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। পাশাপাশি কম চাহিদার কথা উল্লেখ করে ক্রেতারা তৈরি পোশাকের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এটা খাত সংশ্লিষ্টদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।
গার্মেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার ভয়ে ক্রেতারা কার্যাদেশ দেয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবছেন। এর ওপর ক্রেতাদের পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব এই খাতের উদ্যোক্তাদের দ্বিগুণ আতঙ্কিত করে তুলেছে।
গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানা যেখানে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করে। নাম প্রকাশ না করে কারখানার মালিক জানান, কাজের পরিবেশ নিরাপদ করার জন্য এই কারখানায় প্রায় সাত কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর বিদেশি ক্রেতাদের চাপে পড়ে তিনি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। পাশাপাশি সেটি পুষিয়ে নেবার জন্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্যও বিনিয়োগ করেছেন। ফলে পোশাক রফতানির অর্ডার পাবার জন্য কারখানাগুলোর মধ্যেও চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলাদেশেই যদি আরেকটি প্রতিষ্ঠান কম অফার করে, তাহলে বায়াররা (ক্রেতারা) কেন স্বপ্রণোদিত হয়ে দাম বাড়াতে যাবে? তাই বেতন-বোনাসসহ নানা কারণে বিপাকে পড়তে হচ্ছে গার্মেন্টস মালিকদের। আর মালিকরাও যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটি মনে করেন না শ্রমিক পক্ষ। যা শঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে যে তৈরি পোশাক শিপমেন্ট হয়েছে তার মূল্য ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ পূর্বের তুলনায় কমেছে। এখন ক্রেতারা অস্বাভাবিকভাবে দাম কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করছে। মূলত কার্যাদেশকৃত পণ্য না নেয়া কিংবা দেরিতে নেয়ার উদ্দেশ্যেই অস্বাভাবিক কম মূল্য প্রস্তাব করছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া ক্রেতারা ২২০ দিন পর্যন্ত ডেফার্ড পেমেন্টের (একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর মূল্য পরিশোধ) প্রস্তাব করছে, যদিও গার্মেন্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ক্রেতাদের কার্যাদেশের চুক্তিতে ৯০ দিনের মধ্যে মূল্য পরিশোধের শর্ত ছিল।
কারখানা মালিকরা বলছেন, পণ্যমূল্য কমছে, উৎপাদন খরচ কমছে। রফতানির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের জন্য নতুন কার্যাদেশ এসেছে আগের বছরের তুলনায় কম।
ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের যে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক খাতে পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল বাংলাদেশ, যা মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশের মতো। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের ঋণ সহায়তা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাহস করে কারখানা চালু করাসহ আরও কিছু কৌশল নিয়ে বাংলাদেশে অল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। এখন যেহেতু নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে, আগের পদক্ষেপগুলো মূল্যায়ন করে নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়া উচিত।
করোনা মহামারির ধাক্কা বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে স্পষ্ট হয় মূলত মার্চ মাসের শুরুতে। ২০১৯ সালের মার্চে যেখানে ২৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল, চলতি বছরের মার্চে তা ২২৫ কোটি ৬২ লাখ ডলারে নেমে আসে।
মে মাসে ১২৩ কোটি এবং জুন মাসে ২২৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানির মধ্য দিয়ে ধাক্কা অনেকেটা সামলে ওঠা সম্ভব হয়। জুনে পোশাক রফতানিতে ৬ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও পরের তিন মাসের (জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর) পরিস্থিতি কারখানা মালিকদের মনে সাহস ফিরিয়ে আনে। কিন্তু অক্টোবরের ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আবার নতুন করে শঙ্কা জাগাচ্ছে।
সরকারি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও পোশাক রফতানিকারক সমিতির তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উভেন পোশাক রফতানি খুব ভালো করতে না পারলেও নিট পোশাকের রফতানি ছিল বেশ আশাব্যঞ্জক। সব মিলিয়ে জুলাই মাসে পোশাক রফতানিতে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়, এরপর আগস্ট মাসে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু অক্টোবর মাসে এসে আগের বছরের ওই মাসের চেয়ে রফতানি কমে গেছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ইপিবি’র তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালের প্রথম ১০ মাসে যেখানে ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে হয়েছে ২২ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের।
বছর শেষে এই ব্যবধান আরও কমে আসবে বলেই আশা করছিলেন বাজার বিশ্লেষকরা। আর ব্যবসায়ীরা আশা করছিলেন, ডিসেম্বরে বড়দিনের উৎসবকে ঘিরে ক্রেতা দেশগুলোতে বিক্রি আরও বাড়বে। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়ে যাচ্ছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশে নতুন করে লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরাও নতুন করে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন।
এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমরা আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। ক্রেতা দেশগুলো অর্ডার বাতিল বা নতুন অর্ডার না করলেও আগের অর্ডার স্থগিত করে রাখছে। একই সঙ্গে কি ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করছে। ডিসেম্বরে বড়দিনের উৎসবকে ঘিরে ক্রেতা দেশগুলোতে বিক্রি বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশেও করোনা রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। তাই দেশের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে করোনার কারণে কিছুটা হলেও বিপাকে আছে গার্মেন্ট শিল্প।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন