বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

আকাশের নীল পাখি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান

প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আতাউর রহমান সামাদ
২০ আগস্ট, ১৯৭১। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি লাল তারিখ। একাত্তরের এই দিনে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম এক নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। করাচির মৌরিপুর বিমান ঘাঁটির সূচিভেদ্য প্রতিরক্ষার খাঁচাকে ভেঙে বাংলার যে বীর সন্তান এই দিনটিতে দেশপ্রেম আর ঐতিহাসিক দুঃসাহসিকতার চরম গৌরবময় আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তিনি হলেন বাংলার অপ্রতিরোধ্য দুঃসাহসিক বৈমানিক মতিউর রহমান।
পদবি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। সীমাহীন নীলাকাশে মনের আনন্দে বিমান চালাতেই সকল আনন্দ। ইচ্ছে করলেই পশ্চিমের মরুরাজ্য পাড়ি দিয়ে অনায়াসে চলে যেতে পারেন মেঘমাল্লার অচিন কোনো রাজ্যে। আবার ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায়। যদি ইচ্ছা হয়, চলে যেতে পারে দক্ষিণে আরব সাগরের সফেদ ফেনিল ঢেউয়ের ক্যানভাসের ওপর। কোনো বাধা নেই। তারপর এ ক্রোবেট-ডিগবাজি খাও ডাইনে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে, খুশিমতো। কারো কোনো খবরদারি নেই। নেই কারো নজরদারিও। উচ্চাকাশে ‘ডগ-ফাইট’ একটি বিপজ্জনক লড়াই কৌশল। নিজেদের মধ্যে এই ‘ডগ-ফাইট’ একান্তই নিষিদ্ধ। শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। কিন্তু মতিউরের বড় শখ, বড় আনন্দ হয় যদি ঊর্ধ্বাকাশে কেউ তাকে এই মরণ খেলায় চ্যালেঞ্জ করেন। পশ্চিমা দেশের পাঞ্জাবি পাইলটরা অনেকেই মতিউরের প্রতিপক্ষ। একজন কালা আদমি, বাঙালি পাইলট। এত তার দাপট! তদুপরি বিমান চালনায় অকল্পনীয় দক্ষতা ও সাহসিকতার জন্য ইতোমধ্যে তিন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ‘সিতারা-ই-হারব’ খেতাব পেয়েছেন (১৯৬৭ সালের ৪ অক্টোবর)।
১৯৭১ সাল। ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের বছর। ছুটির দরখাস্ত করেছেন মতিউর। ছুটির অনুমতি পেতে সময় লাগতে পারে এই চিন্তায় বছরের শুরুতেই নিজ পরিবার-পরিজনকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন মতিউর। দেশের অবস্থা তখন ভালো যাচ্ছিল না। সর্বস্তরের মানুষের মনে ওই সময় একটাই আশঙ্কাÑপাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত সত্তরের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি রাজনীতিবিদের হাতেই নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর করবে নাকি পুরনো অভ্যাসের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কূটকৌশলেই লিপ্ত থাকবে? জনগণের আশঙ্কাই সত্য হলো শেষ পর্যন্ত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা ছিল, ৩ মার্চ, ১৯৭১ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে ঢাকায়। কিন্তু তা আর হলো না। ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল। ৩ মার্চের মাত্র দুই দিন আগে অর্থাৎ ১ মার্চ রেডিও পাকিস্তানের দুপুর ১২টার সংবাদে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে আসন্ন জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করল সরকার।
ড. আলাউদ্দিন আল-আহাদ, মতিউর রহমান, আমি ও আমার দুই ছোট ভাই মাহাবুব, মানিক সবাই মিলে সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে চলমান টেস্ট সিরিজের খেলাটি উপভোগ করছিলাম। তখন লাঞ্চের বিরতি। দেখলাম, ঘোষণাটি প্রচার হওয়ার সাথে সাথেই স্টেডিয়ামের দর্শকবৃন্দের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এক সময় তা বিক্ষোভে পরিণত হলো। বিক্ষোভে ফেটে পড়ল স্টেডিয়ামের দর্শকবৃন্দ। খেলাটি স্থগিত ঘোষণা করা হলো। স্টেডিয়ামের বাইরে এসে দেখলাম, সারাদেশের মানুষ যেন রাস্তায় নেমে এসেছে। বিক্ষোভে সারাদেশ যেন টালমাটাল। বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীকে রাস্তায় তলব করা হলো। এখানে-ওখানে সেনাবাহিনীর সাথে জনতার সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালাল বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর। ঢাকার মৌচাক আর ফার্মগেটে বহু লোক আহত-নিহত হলেন। তাছাড়া আরো খবর এলোÑ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, টঙ্গী, ময়মনসিংহসহ বহু জায়গায় বেশুমার গোলাগুলি হয়েছে। হতাহত হয়েছে অসংখ্য লোক।
এরপর এলো ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ মঞ্চের খুব কাছ থেকে শোনার জন্য তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে চলে এলেন মতিউর সকাল ১০টার আগেই। সঙ্গে ছিলাম সেই আমি ও আমার ছোট দুই ভাই। মাহাবুব-মানিক। আরো ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ড. আলাউদ্দিন-আল-আজাদ। তিনি লন্ডনে পিএইচডি সম্পন্ন করে ঢাকায় ফিরছেন মাত্র তিন মাস আগে। অপেক্ষায় আছেন নতুন পোস্টিংয়ের। থাকছেন আমাদের সাথে আজিমপুরের বাসায়। রেসকোর্সে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি মতিউরের খুবই পছন্দ হয়েছিল সেদিন। আসলে এটাই তো শেষ কথা হওয়া উচিত। “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” দেখতে দেখতে মতিউরের ছুটি শেষ হয়ে এলো। নিয়ম অনুযায়ী তিনি ছুটি বৃদ্ধির আবেদন করলেন কর্তৃপক্ষের কাছে। তার সেই আবেদন নামঞ্জুর হয়ে ফেরত এলো এবং সেই সাথে অবিলম্বে চাকরিতে যোগদানের নির্দেশও পেলেন তিনি। অবশেষে ১৪ মার্চ ১৯৭১। মতিউরের ছুটির মেয়াদ শেষ হলো। ছুটি শেষ হওয়ার মাত্র ৩/৪ দিন পরেই ঢাকাস্থ মতিউরের অফিসিয়াল ঠিকানায়, উপস্থিত হলো ঢাকাস্থ কুর্মিটোলা অবস্থান ঘাঁটি থেকে তিন সদস্যের একটি সেনাদল। ভাগ্য প্রসন্নই ছিল মতিউরের। আসলে একাত্তরের ওই সময়টাতে মতিউরসহ আমরা অনেকেই সেই বাসায় থাকতাম না। শেষ পর্যন্ত ২৩ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকা ছেড়ে চলে এলেন মতিউর গ্রামের বাড়িতে। আমাদের গ্রামের বাড়ি বৃহত্তর ঢাকা জেলার রায়পুরা থানার মুছাপুর ইউনিয়নের রামনগর গ্রাম। গ্রামটি ভৈরব শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত।
গ্রামে আমাদের ভালোই সময় কাটল। গ্রামের বহু লোকের সাথে সকাল-সন্ধ্যায় নদীর কিনারে হাঁটাহাঁটি করলাম। আলাপ-আলোচনা হলো, কিন্তু সমস্যা আরম্ভ হলো রাজধানী ঢাকা শহর থেকেই। ২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতেই ক্রেক ডাউন করল পাক সেনাবাহিনী ঘুমন্ত নগরবাসীর ওপর। মূলত সেই সময় হতেই পুরো দেশের সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ল ঢাকার। আমরাও যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়লাম। তারপর ঢাকায় কী হচ্ছে না হচ্ছে জানার কোনো উপায় ছিল না। এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ সদস্য কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতারও দেখা নেই। পুরো দেশটা যখন এই রকম বিভ্রান্তিতে দিশেহারা, তখন ২৭ মার্চ ১৯৭১, সকাল ৮টা সাড়ে ৮টা হবে, চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে অচেনা অজানা অজ্ঞাত এক মেজর, যিনি নিজেকে মেজর জিয়া আখ্যায়িত করে বিভ্রান্তিতে পর্যুদস্ত পথহারা দেশবাসীর উদ্দেশে এক বিপ্লবী ভাষণ দিলেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ঘুমন্ত জাতি যেন নতুনভাবে জেগে উঠল। চারদিকে উল্লাস আর উদ্দীপনার নতুন জোয়ার বইতে শুরু করল।
জিয়াউর রহমানের ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউর রহমানের ওপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করল গ্রামবাসী। এখন তো সময় হয়েছে এবার কিছু একটা বলুক মতিউর কিছু একটা করার। আসলে কিছু একটা করার জন্য মতিউর আগাম প্রস্তুত হয়েইছিলেন। পরদিন ২৮ মার্চ, ১৯৭১। সকাল ১০টায় গ্রামের উপকণ্ঠে রেলের মাঠে মতিউর রহমানের পরামর্শক্রমে এক জনসভার আয়োজন করলেন ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান। কিন্তু ৮টা থেকেই রেলের মাঠে এত জনগণের সমাবেশ হতে থাকল যে রেলের মাঠে উপস্থিত জনগণকে সামাল দেয়া কঠিন হবে ভেবে সভাস্থল পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের অদূরে মরাগাঙ্গের ওপারে দৌলতকান্দি হাইস্কুলের মাঠে। স্কুলের মাঠটি রেলের মাঠের চেয়ে অন্ততপক্ষে তিনগুণ বড় হবে। সভার কাজ যথানিয়মে শুরু হলো। সভায় প্রধান ও একমাত্র বক্তা হলেন আমাদের ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান। আসলে সেদিন একমাত্র মতিউর রহমানকে দেখতে এবং মতিউর রহমানের বক্তব্য শুনতেই দূর-দূরান্ত থেকে জনগণ সমবেত হয়েছিল। সেদিনের সেই জনসভায় এত লোকের সমাগম হয়েছিল, যা এখনো ভাবা যায় না। মতিউর রহমান তার ভাষণে বললেন, “আমি কোনো রাজনৈতিক নেতা নই। আমি সৈনিক। আমি সহজ ভাষায় আপনাদেরকে বলি, পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। ওরা ক্রমশ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে, ওরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সব ভেদাভেদ ভুলে এখন আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। জনতার জয় অবসম্ভবী। জয় বাংলা”।
এর পর থেকে মতিউরের কাছে প্রতিটি দিন হয়ে উঠছিল ক্রমশ অসহনীয়; প্রতিদিন সকাল-বিকাল পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমানগুলো খুব নিচু দিয়ে সশব্দে ছুটে যাচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া অথবা নতুন কোনো অঞ্চলের দিকে। প্লেনগুলোর শব্দ শুনলেই দ্রুত ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসত মতিউর এবং মাথা উঁচু করে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকত বিমানগুলোর গতিপথের দিকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত তা দৃষ্টির মধ্যে দৃশ্যমান থাকত। মতিউরের এই মতো আকস্মিক মানসিক পরিবর্তনে আমি চিন্তিত হলাম। কারণ মতিউরের নার্ভ সম্পর্কে অনেকের চেয়ে আমার ধারণা ছিল অন্যরকম। সেই অবস্থায় ৮-৯ দিনের মাথায় হঠাৎ একদিন মতিউর (২৩ এপ্রিল, ৭১) কারো সাথে কোনো কথা নেই, আলাপ নেই, শুধু মা’র অনুমতি নিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে চলে গেলেন ঢাকা। আমি আর বিলম্ব না করে মতিউরের খোঁজে বের হয়ে পড়লাম মেথিকান্দা স্টেশনের দিকে। কিন্তু স্টেশনে পৌঁছানোর সামান্য আগেই ট্রেনটি চলে যায়।
মতিউরকে ফিরিয়ে নিতে পরে আমি ঢাকায় এসেছিলাম কয়েকদিনের মধ্যে, দেখা হয়েছিল মতিউরের সাথে, ‘মতিউর তখন এক ভিন্ন মানুষ’। সে তখন একজন কেতাদুরস্ত পাইলট। সে আমার কোনো কথাই শুনল না। সে তার কর্মস্থলে ফিরে যাবেÑ এটাই তার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত। আমার সাথে হাত মিলিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কয়েক পা সামনে গিয়ে কী ভেবে সে আবার আমার কাছে ফিরে পাশের চেয়ারে বসল। মুখম-লে এক অচেনা হাসি এনে কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচুস্বরে বলল “ভাবছেন কেন, আমি তো আসলে যাচ্ছি না, যাচ্ছি ফিরে আসার জন্য”।
৩ মে ১৯৭১, দুঃখ ভরাক্রান্ত ও ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে তিনি চলে গেলেন করাচির মৌরিপুর। কর্মস্থলে পৌঁছার সাথে সাথে তার ওপর নেমে আসে দুর্ভোগ। তাকে চাকরিতে যোগদান করতে না দিয়ে বসিয়ে রাখা হলো। ২৪ ঘণ্টা তার চলাচলের ওপর বিশেষ নজরদারি রাখা হয়। বিভাগীয় তদন্ত হয়। তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালেরও ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর এ সবকিছুই অতিশয় ধৈর্য ও ঠা-া মাথায় মোকাবিলা করলেন মতিউর। বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক আর কোর্ট মার্শাল হোক, সব ক্ষেত্রেই মতিউরের বক্তব্য ছিল একই রকম। তিনি বলতেন, তিনি যদি দেশদ্রোহী হয়েই থাকবেন, তাহলে তিনি তার দুই মাসের শিশুকন্যা আর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে বাংলার মুক্তাঙ্গন থেকে পাকিস্তানে চাকরি করতে এলেন কোন যুক্তিতে? ধীরে ধীরে মতিউরের প্রতি আস্থাভাজন হয় প্রশাসন। তবে ফ্লাইং তার জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। নিয়োগ পেলেন ফ্লাইট সেফটি অফিসার হিসেবে।
মতিউরের একটি যুদ্ধবিমান চাই-ই-চাই। আর এই গোপন বাসনা বাস্তবায়নের জন্যই ছুটে এসেছেন শত্রুর দেশ সুদূর পাকিস্তানে। একটি যুদ্ধবিমান দখলে নিয়ে তিনি চলে যেতে চান যুদ্ধরত বাঙালিদের পাশে। মতিউরের এই স্বপ্ন কি আদৌ বাস্তবায়িত হবে? ফ্লাইং অফিসার রশিদ মিনহাজ। মতিউরের এক সময়ের প্রত্যক্ষ শিক্ষানবিস। তিনি কিছু দিন ধরে নিয়মিত ফ্লাইং করছিলেন। কখনো নতুন শিক্ষকের সাথে, আবার কখনো একাকী। ফ্লাইট সিডিউল চেক করে মতিউর দেখলেন, ২০ আগস্ট, ১৯৭১, মিনহাজের ফ্লাইট সিডিউল আছে। সকাল ১০টা ১৭ মিনিট। নিয়মিত উড্ডয়নের নির্ধারিত সময় এটা। রশিদ মিনহাজ মূল ভবনের উড়াল ইউনিট থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে একজন ইস্ট্রাক্টর। তারা হাঁটতে থাকেন টি-৩০ প্রশিক্ষণ বিমানগুলো যেখানে ছিল, সেদিকে। ওখানকার একটি ফাইটারের ককপিটে (টি-৩০, কোড নং ব্লু বার্ড) রশিদ প্রবেশ করলেন। নিয়মমাফিক তার ইনস্ট্রাক্টর তার পেছনের সিটে বসলেন। রশিদ প্লেন চালিয়ে ছুটে গেলেন রানওয়ের দিকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশার গভীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। খুব বেশিক্ষণ নয়, বিমানটি আবার মাটিতে নামল। ইনস্ট্রাক্টর শিক্ষানবিসের উড়ান কৌশল দেখে খুশি হয়েছেন। রশিদকে তিনি দ্বিতীয়বার আকাশে ‘একক’ উড়াল দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে অন্যদিকে চলে যান।
টাওয়ার থেকে দ্বিতীয়বারের মতো ওড়ার অনুমতি নিয়ে এগোতে থাকলেন প্রধান রানওয়ের দিকে মিনহাজ। সবকিছু লক্ষ করছিলেন মতিউর। মূল রানওয়েতে যাওয়ার আগে বিশ গজের মতো একটি ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে যেতে হয়, যার কিছুটা পাহাড়ের আড়ালে পড়ায় কন্ট্রোল টাওয়ারের দৃষ্টিগোচর হয় না। ফ্লাইট লে. মতিউর তার ব্যক্তিগত ‘ওপেল’ গাড়িতে উঠলেন এবং নিজেই ড্রাইভ করে এগিয়ে এলেন বিমানটির কাছে। বিমানের পাইলট রশিদ মিনহাজ তার শিক্ষক মতিউরকে চিনলেন। মতিউর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বিমানের পেছনের দিকে ইশারা করলেন। ককপিট খুলে দিলেন মিনহাজ। দরজা সংলগ্ন সিঁড়িটিও নামিয়ে দিলেন। মুখ বাড়িয়ে তিনি জানতে চাইলেন অসুবিধার কথা। ককপিট খোলামাত্রই প্লেনের ভিতর লাফিয়ে পড়লেন মতিউর।
মতিউর রশিদ মিনহাজের স্পিকার ও হেড ফোন থেকে রেডিও টেলিফোন বিচ্ছিন্ন করতে লাগলেন। হতচকিত মিনহাজ জলদি আবার টেলিফোন সংযুক্ত করে কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানিয়ে দিলেন, টি বার্ডকে হাইজ্যাক করা হয়েছে। মতিউর তৈরি হয়েই এসেছিলেন। এবার সে ক্লোরফরম সম্বলিত রুমালটি চেপে ধরলেন মিনহাজের নাকের ওপর। টি-৩৩ এখন মতিউরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। দ্রুত ছুটে চললেন তার গন্তব্যের দিকে। পৌঁছে গেলেন পাক-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি সিন্ধু প্রদেশের থাট্টা অঞ্চলের ‘ঝিলদ’ নামক একটি জলাশয়ের ওপর। আর মাত্র সামান্য পথ বাকি। ৪/৫ মিনিটের মধ্যেই ভারতের রাজস্থান মরুভূমিতে তিনি বেলী ল্যান্ড করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য মতিউরের। শেষ প্রান্তে এসেও কেবলমাত্র ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ব্যর্থ হয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে কখন যে রশিদের জ্ঞান ফিরে এসেছে তার দিকে খেয়াল রাখেননি। সে সময় বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বোধহয় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয় এবং এর ফলেই হয়তো বিমানটি মাটিতে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। মতিউরের পরনে কোনো জি স্যুট ছিল না। অফিসের সাধারণ ড্রেস পরেই তিনি উড়াল দিয়েছিলেন এক মহাকাব্যের জন্ম দিতে। হয়তো তিনি ‘বেল আউট’ করারও চেষ্টা করে থাকবেন। মতিউরের নিষ্প্রাণ অক্ষত দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল দুর্ঘটনাস্থলের সামান্য দূরে একটি টিলার ওপর। অপরদিকে রশিদ মিনহাজের দেহের কিছুই পাওয়া যায়নি। আগুনে জ্বলেপুড়ে তার দেহ শেষ হয়ে যায়।
মতিউর ছিলেন এক জ্বলন্ত অগ্নিপি-ের মতো। তার রক্তে-মাংসে-অস্থিতে ছিল এক নামÑ বাংলাদেশ। মতিউর আজ নেই বটে, কিন্তু তার স্বপ্নের স্বদেশ বাংলাদেশ স্মরণ করবে মতিউরের নাম আমরণ, অনন্তকাল।
লেখক : মতিউর রহমানের সহোদর বড় ভাই, সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও সভাপতি, পেট্রোবাংলা অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন