শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার নয়

মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

গ্রামের পাড়ার মোড় বা হাটবাজারেই শুধু নয়, খোদ রাজধানী ঢাকা শহরেই এমন অনেক শিক্ষিত ও সচেতন মানুষজনও এখন অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের দ্বারস্ত হতে চান না। ওষুধের ফার্মেসিতে থাকা কোনো ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শেই ওষুধ কেনার কাজটি সেরে ফেলেন এবং ডোজ শেষ না করে মাঝ পথেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করেন। গ্রামের একজন দিন মজুর থেকে শুরু করে রাজধানীর উচ্চ শ্রেণির শিক্ষিত মানুষটিও অবলীলায় এই কাজটি করে যাচ্ছেন। শুধু মানুষজনের দেহেই অ্যান্টিবায়োটিকের ইচ্ছেমতো ব্যবহার হচ্ছে, ব্যাপারটি কেবল তাই নয়; সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে এই অযাচিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে খামারে লালন-পালন করা পশু-পাখিদের শারীরেও। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের অননুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ফলে ইতোমধ্যেই অনেকগুলো অ্যান্টিবায়োটিক মূলত এখন মানুষের দেহে অকার্যকর হয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞগণ জানিয়েছেন। আগামী দিনগুলিতে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবন না করতে পারলে চিকিৎসা জগতে খারাপ সময়ই অপেক্ষা করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ জন্য এখনই সচেতনতা বৃদ্ধি করা গোটা বিশ্বের জন্যই জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ১৮ নভেম্বর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনা সপ্তাহ পালিত হয়েছে। এই সপ্তাহ উপলক্ষে বিশ্বের নানা সংগঠন আলোচনা সভা, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা করেছে। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহারের ফলে আগামীতে মানুষের চিকিৎসা ক্ষেত্রে কতটা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে তা সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলাটা সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে।

এ বছর বাংলাদেশের জনগণের জন্য আনন্দের বিশেষ উপলক্ষ্য হলো বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আরেকবার নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়েছে এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্ট্যিান্স সংবরণকে সামনে রেখে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২ বছরের জন্য WHO, FAO I OIE কর্তৃক One Health Global Leaders Group on Antimicrobial Resistance এর কো-চেয়ার হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। শুধু নিজের দেশে নয়, সারা বিশ্বের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্ট্যান্স সংবরণে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে এই গ্রুপ। ইতোমধ্যেই গোটা দেশবাসীসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাহিদ মালেক, মন্ত্রণালয়ের সচিবদ্বয়সহ সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এই বিরল অর্জনের জন্য শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানিয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং জীবাণুসমূহ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেই চলেছে। জীবাণুসমূহ বহু প্রকার অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে পড়েছে। ফলে কম বা বেশি দামি সকল প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক সংক্রমণ চিকিৎসায় অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ধরনের রোগ জীবাণু ব্যক্তির জন্য প্রাণঘাতী হওয়া ছাড়াও সমাজে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করতে পারে।

আমাদের দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে ইতোমধ্যেই কৌশলপত্র, কর্মপরিকল্পনা, ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ইত্যাদি প্রণয়ন করেছে। ইতোমধ্যেই জাতীয় কর্মকৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারের উদ্যোগসমূহ ঠিক করা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি সারভেইল্যান্স চলমান রয়েছে এবং সারভেইল্যান্সটিকে আরো বেগবান করবার জন্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে রেফারেন্স ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমন্বিতভাবে ঔষধ প্রশাসন, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতের প্রচেষ্টা চলমান। সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ৬ মাসের মধ্যেই প্রায় ৬০০০ চিকিৎসক-নার্সদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং সকল হাসপাতালে আইপিসি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

অ্যান্টিমাইকোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সহনীয় মাত্রায় আনয়নের জন্য চিকিৎসকসহ সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা অতীব প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন এডভোকেসি সভার আয়োজন করা হয়েছে। কেননা, অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স প্রতিরোধে আমাদের সকলেরই ভূমিকা রয়েছে। প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে চিকিৎসক যেমন ভূমিকা রাখতে পারেন তেমনি যারা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন তারাও ভূমিকা রাখতে পারেন। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ক্ষতির কারণ। শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসক-এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় ও সেবনের মাধ্যমে রেসিস্টেন্সের হার অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সরাসরি ঔষধের দোকানে হাতুড়ে ও অন্য কোনো রোগীর, প্রেসক্রিপশন মোতাবেক অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় বা সেবন একেবারেই কাম্য নয়। যথোপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারই আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের রেসিস্টেন্স জীবাণুদের মরণঘাতী সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন