চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ পালন করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্প্রেড অ্যাওয়ারনেস, স্টপ রেজিসট্যান্স’ অর্থাৎ সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়ে এন্টিবায়োটিকের অকার্যকরিতা প্রতিরোধ। এই দিবসের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কারণ, সারাবিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামান্য সংক্রমণ কিংবা সাধারণ রোগেও মানুষ মারা যেতে পারে, যেমনটি অতীতে হয়েছিল। বর্তমানে সাধারণ রোগে মানুষ মারা না গেলেও ভবিষ্যতে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বহু মানুষ মারা যেতে পারে, এমন আশংকা করা হচ্ছে। আমরা সাধারণত রোগ-জীবাণু থেকে মুক্তি পেতে অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাস নিরোধী ওষুধ ব্যবহার করি। ইদানিং অ্যান্টিবায়োটিকে অসুখ সারছে না, অ্যান্টিবায়োটিকের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে রোগ ও চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। অর্থনীতির উপর চাপ পড়ছে। সুপারবাগ সংক্রমণের আশংকা বাড়ছে।
প্রায় সব ওষুধের গায়েই লেখা থাকে শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ব্যবহার্য। অথচ এমন নির্দেশনা মানার দৃষ্টান্ত খুবই কম। অ্যান্টিবায়োটিকের কুফল সম্পর্কে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডবিøউএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয় ২০৫০ সালের পর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স-এর কারণে আর কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেরই কার্যকারিতা থাকবে না। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে নিউমোনিয়া, যক্ষা, টাইফয়েড জীবাণুবাহিত রোগগুলোর চিকিৎসা প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে হচ্ছে না, নতুন সংবেদনশীল ও উচ্চমূল্যের অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। কারণ, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তবে এটা যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। একই অ্যান্টিবায়োটিক বারবার ব্যবহার করায় ভাইরাস ও ফাঙ্গাসজনিত রোগের সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে দুদিক থেকেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। একদিকে অ্যান্টিবায়োটি কাজ করছে না। অপরদিকে অন্যান্য রোগ-জীবাণু শরীরে বাসা বাঁধছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি) হাসপাতালে সবচেয়ে বড় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে। আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে সুপারবাগ। ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট প্রকাশিত ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মাত্রারিক্তি ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা হয় না। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম। যে কেউ কিনতে চাইলে তা কিনতে পারে। ফার্মেসিতে গিয়ে চাওয়া মাত্রই পাওয়া যায়। এর কারণ হচ্ছে, কিছু কোম্পানির নি¤œমানের অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে যা বিক্রি করলে দ্বিগুণ লাভ হয়। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, বেশি লাভের আশায় এসব কোম্পানি একজন মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায়, সামান্য জ্বর বা সর্দি-কাশি হলেই মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। অথচ অ্যন্টিবায়োটিক সেবনের কিছু নিয়ম আছে। অনেকে এ নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। নির্দিষ্ট মাত্রা ও মেয়াদ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে না। উল্টো একই ধরনের নতুন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছে। ফলে ওষুধের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ওষুধে অসুখ সারছে না। অনেকে চিকিৎসকের দেয়া ওষুধের ডোজ পূর্ণ করে না। অর্ধেক ওষুধ খাওয়ার পর ভালো হয়ে গেলে আর ওষুধ খান না। গ্রামের ডাক্তার ও ফার্মেসী দোকানদার সর্বরোগের ওষুধ হিসেবে অযথা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছে। রোগী ফার্মেসিতি গিয়ে জ্বরের কথা বললেই অ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক দিতেও কুন্ঠাবোধ করছে না। এর ডোজ কয়টিতে হয়, কয়টি খেতে হবে, কখন খেতে হবে তা না জেনেই দিয়ে দিচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রচলিত বহুরোগ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন তার কর্মক্ষমতা বিভিন্ন পর্যায়ে শূন্য থেকে প্রায় ৮১ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ৮২ শতাংশ কমে গেছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এই দৃশ্যপটকে সামনে রেখে সতর্ক করেছে। কারণ, রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে, চিকিৎসা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। এ সমস্যা পৃথিবীর একক কোনো দেশের নয়, বলা যায় বৈশি^ক। এটাকে ঠেকাতে না পারলে দেখা যাবে, অসুখ আছে কিন্তু ওষুধ নেই। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা একদিকে যেমন সাবধানী বাণী উচ্ছারণ করেছে, অপরদিকে নিজেরাও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এব্যাপারে সচেতন এবং কার্যকরী ভূমিকা পালন করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। আমাদের দেশে একসময় উন্নতমানের হাসপাতাল ছিল না। এখন বেশ কিছু উন্নত মানের হাসপাতাল আছে। ভবিষ্যতে আরও হাসপাতাল হবে। তৈরি হবে হাজারো চিকিৎসক। কিন্তু অ্যঅন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় তখন তা রোগ উপশমের পরিবর্তে রোগ বাড়িয়ে তুলবে। তখন কারো কিছু করার থাকবে না। সামান্য সর্দি কিংবা জ্বরে মানুষ মারা যাবে। এজন্য এখন থেকে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, অ্যান্টিবায়োটিক কোনো চকলেট বা বিস্কুট নয়। এর ব্যবহার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এজন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আইনের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তির বিধান কার্যকর করতে হবে। এছাড়াও চিকিৎসকদের জন্য গুড প্র্যাকটিস নীতিমালা এবং প্রেসক্রিপশন অডিট হওয়া দরকার। এটা করতে পারলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া বা এর যথেচ্ছ ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে। আমাদের দেশে অসংখ্য ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা সবাই মানসম্মত ওষুধ তৈরী করছেন তা মোটা দাগে বলা যায় না। এব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন ও বিএমডিসি যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে পারে। প্রয়োজনে তাদের নজরদারি ও জনবল বাড়াতে হবে। জনগণকে এব্যাপারে সচেতন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে কার্যকরী পদক্ষে নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন