শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ফলে সবল অর্থনীতি

চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ের মিশ্র বাগানে নীরব বিপ্লব পাহাড়ি জমিতে পরিকল্পিত ফলচাষে হাজার কোটি ডলার রফতানি আয় সম্ভব : কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. মেহেদী মাসুদ চাহিদা অনুপাতে ঘাটতি ৬৫ ভাগ : করো

শফিউল আলম ও রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

কথায় বলে- ফলে বাড়ে বল। নিয়মিত ফল-ফলাদি খেয়ে শরীরে ভিটামিন-পুষ্টি যুগিয়ে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা, বল-শক্তি বৃদ্ধি পায়। শুধু কী তাই? রকমারি জাত ও স্বাদের ফলচাষ বাড়লে বাংলাদেশ পাবে সবল অর্থনীতি গড়ার টনিক। পুষ্টিবিদ ও কৃষি বিভাগের মতে, মাথাপিছু ফল খাওয়ার চাহিদা দৈনিক ২শ’ গ্রাম। কিন্তু খাওয়া হচ্ছে ৮০ থেকে একশ’ গ্রাম। দেশে ফলের চাহিদা অনুপাতে এখনও উৎপাদনে ঘাটতি ৬৫ শতাংশ। আমদানি করে ঘাটতির আংশিক পূরণ হয়। করোনাকালে ফল আমদানি বেড়েছে ২২ শতাংশ।

স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে ফলের চাহিদা বাড়ছেই। দু’চার বছর আগেও ফল খাওয়ার পরিমাণ আরও কমই ছিল। বিশেষ করে করোনাকারণে পুষ্টি, ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফলের কদর বেশি। ফরমালিন বিষমুক্ত দেশীয় ফলের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ। চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বিচিত্র ফলের আবাদ-উৎপাদন বাড়ছে। চাষিরা বাজারে ভালো দাম পাচ্ছেন। ব্যাপক সুযোগ-সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে ফলের উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি সম্ভব। ঘাটতি পূরণ করে উদ্বৃত্ত ফল বিদেশে রফতানির মাধ্যমে অর্থনীতি হবে সমৃদ্ধ।

দেশে সুস্বাদু রসালো হরেক জাতের ফলচাষের মানচিত্র ক্রমেই বড় হচ্ছে। বাগানে বিদেশি ফলও শোভা পাচ্ছে। অর্থকরী কৃষি পণ্যরূপে গুরুত্ব আগের চেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ের ভাঁজে, জুম চাষের ফাঁকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মিশ্র ফলের বাগানে নীরব বিপ্লব ঘটছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে ৪৫ রকম ফলের চাষ হয়। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, তরমুজ, বাঙ্গী, জাম, কুল, তাল, খেজুর, আনারস, জলপাই, আমড়া, আমলকি, কামরাঙ্গা, বাতাবি লেবু, বেল, জাম্বুরা প্রভৃতি। কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, চীনাবাদাম, নারকেল, ভূট্টাসহ হরেক শুকনো ফল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষিবিদ-মাঠকর্মী ও চাষিদের প্রচেষ্টায় দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় ফলের প্রজাতিগুলো আবার ফিরে আসছে। যেমন- কদবেল, সফেদা, আতা, শরীফা, ডেউয়া, ডালিম, করমচা, চালতা, বিলেতি গাব, বিলিম্বি, তেঁতুল, গোলাপজাম, ছুঁই-খাট্টা। স্ট্রবেরি, ড্রাগনফল, আঙুর, রাম্বুটান, থাই ও বার্মিজ আম, পেয়ারা, মরুদেশের খেজুরসহ বিদেশি ফলও দারুণ ফলছে। পর্যটকরা কিনছেন বিষমুক্ত সুস্বাদু ফল। বারোমাসি বিচিত্র ফলের মৌ মৌ গন্ধে পাহাড়ের চিত্র বদলেছে। অভাব বিদায় করে স্বনির্ভর অসংখ্য পরিবার।

খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় পাহাড়ি জমিতে মিশ্র ফলের বাগান গড়েছেন আতিউর রহমান। কলা, আম, পেঁপে, লেবু, মাল্টা, আনারসসহ একত্রে হরেক ফলের আবাদে ভালোই ফলন হচ্ছে জানিয়ে বলেন, বছরজুড়ে হাতে আয় আসছে লাখ লাখ টাকা। তার সাফল্যে অন্যরাও উৎসাহ পেয়ে মিশ্র ফলচাষ করছেন।
তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফলের আবাদযোগ্য জমি বেশিরভাগ এখনও অনাবাদী। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, উঁচু-নিচু-ঢালু উর্বর পাহাড়ি মাটি এবং আবহাওয়া প্রকৃতির দয়ানির্ভর ফলচাষের উপযোগী। ব্যাপক সুযোগ আজও অধরা। সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমির মধ্যে ফলচাষের আওতায় এসেছে মাত্র ৯৫ হাজার ৪২২ হেক্টর। তিন পার্বত্য জেলায় এ বছর ১৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫৭৭ মেট্রিক টন ফল উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। গেল বছর উৎপাদন হয় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ২৮৮ টন। তিন পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের আট জেলায় গত বছর ২৪ লাখ ৯০ হাজার ৯৮৪ টন ফল উৎপাদন হয়।

রফতানির হাতছানি হাজার কোটি ডলারের
কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. মেহেদী মাসুদ ‘পাহাড়ি অঞ্চলে বছরব্যাপী ফলচাষের সম্ভাবনা’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে জানান, পাহাড়ি এলাকায় ৮ লাখ ৩৮ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমি ফলচাষের আওতায় আনা যায়। দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বছরব্যাপী ফলচাষের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড়ি জমি ফলচাষের আওতায় আনা হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি ফল বিদেশে রফতানি এবং হাজার কোটি ডলার আয় সম্ভব।

এর বাস্তবায়ন ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন সুপারিশ করেন। যেমন- পানির সঙ্কট ও কষ্টসহিষ্ণু জাতের লাভজনক বারোমাসী ফল গাছের সমন্বয়ে মিশ্র বাগান সৃজন, পরিকল্পিত কমিউনিটি প্লান্টেশন, বিদ্যমান ফলদ গাছগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, চাষিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, উন্নত জাত নির্বাচন ও বীজ-চারা-কলম, দেশি-বিদেশি হাইভ্যালু ফল বাগান সৃজনে কৃষি প্রযুক্তিসহ চাষিদের প্রয়োজনীয় সহায়তা। ড্রাগনফল, রাম্বুটান, বিদেশি উন্নত জাতের কাঁঠাল, সফেদা, ম্যাংগোস্টিন, পার্সিমন, কাজু বাদাম প্রভৃতি চাষের জন্য পাহাড়ের মাটি খুবই উপযোগী।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. নাছির উদ্দীন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ফলচাষিদের মাঠ প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ, চারা-কলম দিয়ে সহায়তা করা হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারী, কক্সবাজারের ঝিলংঝা ও রামু, ফেনীর পাঁচগাছিয়াতে হর্টিকালচার বিভাগের গবেষক ও কর্মীরা ফলচাষে উৎসাহ দিচ্ছেন। ফলচাষ লাভজনক হওয়ায় একের সাফল্যের দেখাদেখি অন্যরাও আকৃষ্ট হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পার্বত্য অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. নাসিম হায়দার বলেন, তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়-সমতলে দেশি-বিদেশি ফলের আবাদ বাড়ছে। বিষমুক্ত ফল দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাহিদা পূরণ করছে। চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. আকতারুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রামে ফল বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হচ্ছে ফলের আবাদ।

চাহিদা বৃদ্ধির সাথে ফল আমদানিও বেড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গেল নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরের ১১ মাসে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৭০ টন ফল আমদানি হয়েছে। এ সময়ে এক হাজার ৮২৮ কোটি ৮৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকার ফল আমদানি হয়। এরমধ্যে আপেল আমদানি হয় ২ লাখ ৩২ হাজার ৫৬১ টন। আমদানিকৃত আপেলের মূল্য এক হাজার ৩৯ কোটি টাকা। কমলা আমদানি হয় এক লাখ ২৪ হাজার ৮৯৩ টন। যার মূল্য ৪৩১ কোটি ৭৫ লাখ ৭৭ হাজার ৩২৪ টাকা।

আঙুর আমদানি হয় ৩০ হাজার ৯৫১ মেট্রিক টন এবং মূল্য ২৫৩ কোটি ৮০ লাখ ৭৭ হাজার ৫৭৬ টাকা। মাল্টা আমদানি হয় ৩৯ হাজার ৩৬৯ টন। যার মূল্য ১৩৫ কোটি ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫৩৬ টাকা। ফল আমদানিতে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৪শ’ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, করোনাকারণে পুষ্টি সচেতনতা বেড়ে ফলের চাহিদা ও আমদানি বাড়ছে। ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল আমদানি হচ্ছে বেশি পরিমাণে।

দেশের স্থল বন্দরগুলো দিয়ে ভারত থেকেও আমদানি হচ্ছে প্রচুর ফল। তাছাড়া ভারত, মিয়ানমার, ভূটান ও চীন থেকে চোরাচালানে দেদারসে আসছে হরেক ফল। বৈশ্বিক সূচকে আপেল আমদানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। মাল্টা আমদানিতে বিশে^ পঞ্চম।
বান্দরবান থেকে স্টাফ রিপোর্টার মো. সাদাত উল্লাহ জানান, হরেক ফল আবাদের উর্বর ক্ষেত্র পার্বত্য এই জেলা। ফজলি, আম্রপালি আম, আনারস, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, লিচু, কমলা, মাল্টাসহ নানা জাতের ফলের ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। কম সময়-খরচ ও শ্রমে অধিক লাভজনক হওয়ায় চাষিরা ফলদ গাছ রোপনে বেশি আগ্রহী। রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জের মতো সুমিষ্ট ফজলিসহ বিভিন্ন জাতের আমের আবাদ হচ্ছে। পরীক্ষামূলক আবাদে সফলতা পেয়ে চাষিরা আমের আবাদে ঝুঁকেছেন।

সদর উপজেলার টংকাবতী এলাকার আম বাগান মালিক আবিদ হোসেন মানু জানান, আমি ২০ একর পাহাড়ি জমিতে আমের চারা লাগিয়ে মাত্র এক বছরের মাথায় সুফল পেয়েছি। অথচ এরআগে সেগুন, গামারী মেহগনীসহ বনজ গাছ রোপন করে সফলতা পেতে ১০/১৫ বছর লেগেছে। আমের ভালো ফলনে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। বান্দরবানে বারোমাসী নানা জাতের পুষ্টিকর কলা, বড় সাইজের জায়ান্ট-কিউ ও হানি কুইন আনারস চাষ বাড়ছে।

আলীকদমে মাতামুহুরী নদীর তীরে আগে তামাক চাষের জমিতে এখন বাদাম চাষের সমারোহ। বান্দরবান জেলা কৃষি অফিসার ড. এ কে এম নাজমুল হক জানান, ২০১৯-২০ সালে এই জেলায় আম, কলা, আনারস, পেঁপে, কাঁঠাল, মাল্টা, কমলা, লিচু, পেয়ারা, কুল, কাজু বাদাম, চীনাবাদাম, ভূট্টাসহ ফলের আবাদ ও উৎপাদন টার্গেট অতিক্রম করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন