হাতে লাল সবুজের পতাকা আর রং-বেরং এর ফুল, হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে মানুষের ঢল সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। যাদের রক্তের বিনিময়ে দুইযুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটেছিল, বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৪৯তমবার্ষিকীতে সেই বীর সন্তানদের স্মরণ করছে জাতি। গতকাল বুধবার ভোর ৬টা ৩৪ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদের সামরিক সচিবরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জানা যায়, প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম শামিম উজ জামান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী। সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় সামরিক কায়দায় সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। অন্য বছর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বিজয় দিবসে সাভারে গিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে অন্য অনেক রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির মতো এবারের বিজয় দিবসের কর্মসূচিও সীমিত করে আনতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষেও শহীদ বেদিতে ফুল দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানও এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রধান বিচারপতি ও তিন বাহিনীর পক্ষ থেকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রদ্ধার ফুলে ভরে উঠতে থাকে শহীদ বেদি।
এদিকে, সকাল ৯টায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আ.লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশকে বিনষ্ট করার যে আশা নিয়ে ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তাদের সে স্বপ্ন সত্যি হয়নি। যে স্বপ্ন দেখে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন জাতির পিতার নেতৃত্বে, সে স্বপ্ন নতুন প্রজন্ম তুলে নিয়েছে। তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দুয়ারে দাঁড়িয়ে, তখনও একটি অশুভ শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রদায়িক এই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটনই হবে এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার। এ বছরের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার হচ্ছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই সাম্প্রদায়িক শক্তিদের রুখব। একদিকে সাতচল্লিশের চেতনা, অন্যদিকে একাত্তরের চেতনা। একদিকে সাম্প্রদায়িকতা, আরেকদিকে অসাম্প্রদায়িকতা। আজকে আমাদের এ দুটি ধারা চলছে।
এফবিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করেছে। দারিদ্র্যসীমা ৪৬ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স, ক্লাইমেট সবকিছুতে আমরা এগিয়েছি। যত সীমাবদ্ধতা আছে, তা পার করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। জাতির পিতার ভাস্কর্যের বিরোধিতায় সাম্প্রতিক মৌলবাদী তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে না জানানোর কারণে এক ধরনের একটি গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। এখন সম্মানিত আলেম সমাজের লেবাসে একটি রাজনৈতিক অপশক্তি অপপ্রচার চালাচ্ছে।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আহসান উল্লাহ বলেন, প্রত্যেকে নিজের মত প্রকাশ করবে; কিন্তু তা যেন কোনোভাবেই আমাদের দেশের স্বাধীনতাবিরোধী না হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী না হয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সেদিকে যেন না যাই।
বিজয় দিবসের সকালে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন মিরপুর বাংলা কলেজের শিক্ষার্থী নিশি আক্তার। তিনি বলেন, বেশ কিছু সংস্কৃতি আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে গেছে, সেগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আকলিমা আক্তার এশা বলেন, আজকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মৌলবাদীরা তার ভাস্কর্য ভাঙচুরের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। নয়তো ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রাম শুরুর পর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন যুদ্ধে পাকিস্থানকে নেতৃত্ব দেয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী।
গতকাল বুধবার সেই বিজয়ের ৪৯তম বছর পূর্তির দিনটি পালিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের বাকস্বাধীনতা নেই, মৌলিক স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে। অধিকারকে হরণ করা হয়েছে। আজকে আমরা বিজয় দিবসে সেজন্য শপথ গ্রহণ করেছি, স্মৃতিসৌধে আমাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য, অবশ্যই এ দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখব। অবশ্যই আমরা বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হব। তিনি আরও বলেন, বিজয় পেয়েছি, মুক্তি কি মিলেছে? না, মুক্তি আমাদের মেলেনি, সেই মুক্তির জন্যই আমাদের সংগ্রাম করছি৷
এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ আরও অনেক নেতৃবৃন্দ। এ সময় ঢাকা জেলা ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদল ও জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের ব্যানারে প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীও শ্রদ্ধা জানাতে আসেন৷
মহান বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে সাভার উপজেলা পরিষদ ও সাভার উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান এমপি, সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মঞ্জুরুল আলম রাজীব এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আরা নীপা।
ভিআইপিদের শ্রদ্ধা জানানোর পর জাতীয় স্মৃতিসৌধ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পরে লাল সবুজের পতাকা আর ফুল হাতে জনতার ঢল নামে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে। ফুলে ফুলে ভরে উঠতে থাকে শহীদ বেদী। তবে সকালের দিকে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীর সংখ্যা। বিভিন্ন সংগঠনের মধ্য কৃষক লীগ, যুবলীগ, এফবিসিসিআই, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাসদ, বাসদ ও ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব ড্যাব ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
বিজয় দিবস উদযাপনে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় নেয়া হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শতাধিক সদস্য। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনাকে ঘিরে চোখে পড়েনি কোনো বাড়তি নিরাপত্তা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রুপ করে ভেতরে লোক ঢুকানোর কথা থাকলেও মানা হয়নি সেসব কিছুই। যে যার মতো মাস্ক ছাড়াই দলবদ্ধ হয়ে ঘেঁষাঘেষি করে ভেতরে প্রবেশ করে শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যে যার মতো চলে যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন