আহমেদ জামিল
সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়- এই হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখ-তার প্রতি স্বীকৃতির কথাও বলা হয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হবে না। সংবিধানে এসব কিছু স্পষ্ট করে বলার পরও সংবিধানের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ভারত সফরের সময় ও পরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াইয়ে বাংলাদেশের সমর্থনদানের পরিকল্পনার কথা বলতে পারলেন কীভাবে। অথচ কাশ্মীরিদের ভারতীয় দখলদারিত্ব থেকে আজাদীর লড়াইয়ের ব্যাপারে তিনি নীরব থেকেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের নাগপাশ থেকে কাশ্মীরিদের আজাদীর লড়াই তীব্র হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বেলুচদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেন এবং বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারত উত্থাপন করবে বলেও জানান।
এ প্রসঙ্গে কট্টর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানবিরোধী বলে পরিচিত ভারতীয় আনন্দবাজার পত্রিকা ‘কথা রাখেননি জিন্নাহ, নবাবকে মেরেছে সেনা, মরিয়া যুদ্ধে বালুচিস্তÍান’ শিরোনামে ১৯ আগস্ট প্রকাশিত দীর্ঘ প্রতিবেদনের এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়, “বালেচরা (বালুচ) মনে করছেন, ইসলামাবাদ বিশ্বাসঘাতক। প্রায় সাত দশক ধরে পাকিস্তান সরকার যে নৃশংসতার সাহায্য নিয়ে দমন করতে চাইছে বালেচদের, তাতে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা বালেচদের মনে। ভারত সরকার পাশে দাঁড়ানোয় তাতে করে জোর পেয়েছে বালুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি। পাকিস্তান সেখানে চরম দমননীতি চালিয়ে কীভাবে রোজ পিশিয়ে দিচ্ছে মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক মহলের সামনে তা তুলে ধরেছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীকে তাই ধন্যবাদ জানিয়েছেন বেলুচিস্তানের বিদ্রোহী নেতারা। আগের চেয়েও উজ্জীবিত হয়ে ওঠা এই বিদ্রোহীদের রোখা আরও যে কঠিন হয়ে উঠেছে, ইসলামাবাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।”
অন্যদিকে প্রায় একই সময় টুইটারে প্রকাশ করা ভারতের ডিএনএ নিউজএজেন্সি ভারতের নীতিনির্ধারকদের বরাত দিয়ে জানায়, “কাশ্মীরে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের প্রত্যুত্তর দিতে হবে বেলুচিস্তানে ভারতের আরো সংশ্লিষ্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে।” বেলুচিস্তান ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখ-তাবিনাশী বক্তব্য রাখার পরপরই ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তাৎক্ষণিকভাবে মোদির বক্তব্য সমর্থন করেন। ভারতে অবস্থানকালে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী ভারতের বিজেপি নেতা অমিত শাহসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাথে বৈঠক করেন। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী বক্তব্য রাখেন।
গত ২০ আগস্ট অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন সংবাদ সম্মেলনে দেয়া তথ্যমন্ত্রী ইনুর বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরে। তাতে উল্লেখ করা হয়, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, শিগগিরই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বেলুচিস্তান বিষয়ক নীতিগত অবস্থান তুলে ধরবে। বুধবার ভারত সফরে গিয়ে একাধিক ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে জাতীয় ও ভূ-রাজনৈতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেন ইনু। সেখানেই বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ উঠে আসে।... বেলুচিস্তানে চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে ইনু দ্য হিন্দুকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে জাতিসত্তার আন্দোলনের প্রতি পাকিস্তানের ট্রাক রেকর্ড ভালো নয়। তাদের সেনা ব্যবস্থাপনা ক্রমাগত বিভিন্ন জাতিসত্তার ওপর আক্রমণ করছে। তারা ১৯৭১ থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পারেনি এবং একই নীতি অনুসরণ করছে বেলুচদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে। ট্রিবিউনের এতদসংক্রান্ত রিপোর্টে ইনুর বেলুচিস্তান ইস্যুতে বক্তব্যের আরও কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে।
বেলুচিস্তানের আন্দোলন বাংলাদেশ সমর্থন করবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইনু বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ জাতিসত্তার সংগ্রামকে সমর্থন করতে বাধ্য। বেলুচিস্তানের ক্ষেত্রেও আমরা শিগগিরই আমাদের আনুষ্ঠানিক নীতিগত অবস্থান ঘোষণা করব।’ ধারণা করা হয়, তথ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫(গ) অনুচ্ছেদের আলোকে বেলুচিস্তান ইস্যুতে কথা বলেছেন। যাতে সা¤্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের প্রতি কোনো জাতির মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থনদানের কথা বলা হয়েছে। এ কথা তো সবার জানা, সাবেক পূর্বপাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত ছিল। এই পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম।
কোনো উপনিবেশিক জোরজবরদস্তি নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল দ্বি-জাতি তত্ত্ব তথা ইসলামী জাতীয়তাবাদের আদর্শকে অবলম্বন করে পাঁচটি প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তার মানুষের স্ব-ইচ্ছা এবং সম্মতির ওপর ভিত্তি করে। তবে এ কথাও সত্য যে, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অপরিণামদর্শিতা, শাসন-শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন ইত্যাদি পাকিস্তানের কোনো কোনো প্রদেশের মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকামী মানসিকতার জন্ম দেয়। যার সূত্র ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। কিন্তু বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫(গ) অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে বেলুচিস্তানের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি যে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন তা বাস্তবসম্মত ও সমর্থনযোগ্য নয়। প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, আঞ্চলিক বৈষম্য থাকলেও বেলুচিস্তান পাকিস্তানের কোনো উপনিবেশ নয়। উল্লেখ্য, ভারতে আঞ্চলিক বৈষম্য আরো প্রবল।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের নামে বেলুচিস্তানে সেনা অভিযান চালানো হলেও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কোনো দায়িত্বশীল দেশি-বিদেশি মিডিয়া এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো তুলে ধরতে পারেনি। সুতরাং বাংলাদেশে ’৭১-এর মতো পরিস্থিতি বেলুচিস্তানে বিরাজ করছে না এটাই হলো বাস্তবতা। তাছাড়া বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ বালুচদের কোনো সংশ্রব এবং তাদের প্রতি কোনো সমর্থন নেই। তারা পাকিস্তানের অখ-তায় বিশ্বাসী। পাকিস্তানের এক অনলাইন পত্রিকা ছবিসহ একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সমর্থন প্রকাশের জন্য কোয়েটার রাস্তায় শত শত সাধারণ বালুচ নরেন্দ্র মোদির প্রতিকৃতিতে জুতার মালা পরিয়ে স্লোগানসহ মিছিল করছে। বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের মূল ¯্রােত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিপথগামী বেলুচদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে মদদ ও উসকানি দিচ্ছে ভারত। তাদের সমর্থন, আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণও দিচ্ছে ভারত।
ইতোমধ্যে শত শত ভারতীয় গোয়েন্দা ইরান ও ভারত সীমান্ত দিয়ে বেলুচিস্তানে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থান করছে এবং অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনী বহু ভারতীয় গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছে। এদের অনেকেই মুসলিম পরিচয় ধারণ করে বেলুচিস্তানে অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ও তার মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পশতুন বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও উসকানি দিয়েছিল। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে অস্ত্র বোঝাই ইরাকি বিমান পাকিস্তানের করাচি বিমানবন্দরে পাকিস্তানি সামরিক বিমান নামতে বাধ্য করে ওই বিমানে বহন করা অস্ত্রশস্ত্র উত্তর ও পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পশতুন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। যা হোক, বাংলাদেশের সরকারকে এ কথাও বুঝতে হবে যে, ভারতের ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত স্বার্থে চালিত হলে তাতে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম যেমন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তেমনি বেলুচিস্তান প্রদেশও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সার্ক ও ওআইসিভুক্ত দেশ এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উচিত হবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় অখ-তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। তাছাড়া বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবল বিরোধী চীন ও ইরান। বেলুচিস্তানের গোয়ান্দরে চীনের বিশাল ঘাঁটি রয়েছে এবং চীন সেখানে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে বিশাল শিল্প এলাকা গঠনের জন্য। সুতরাং বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতি সমর্থনদানে এসব দেশও বাংলাদেশের প্রতি ক্ষুব্ধ হতে পারে। ওআইসিও অসন্তুষ্ট হতে পারে। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, বেলুচিস্তান হলো পাকিস্তানের মূল ভূখ-ের সাথে লাগোয়া। তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে বেলুচিস্তানের বেলায় সেটা ঘটা কার্যত সম্ভব নয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বেলুচিস্তানের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হলেও কাশ্মীরিদের আজাদীর লড়াইয়ের ব্যাপারে নীরব থেকেছেন। অথচ বেলুচিস্তান নয়, দখলদারিত্বের অধীনে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ। আর সে দখলদার শক্তি হলো বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পরম মিত্র ভারত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে জম্মু-কাশ্মীর হলো বিরোধপূর্ণ এলাকা। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোটের কথা বলা হয়। অর্থাৎ গণভোটেই নির্ধারিত হবে কাশ্মীর ভারত না পাকিস্তানের সাথে অথবা সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। অথচ ভারতের প্রতিটি শাসক গোষ্ঠী জাতিসংঘের গণভোটের প্রস্তাবকে বারংবার পাশ কাটিয়ে গিয়ে অবৈধ দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কাশ্মীরে হত্যা, নির্যাতন, গ্রেফতার ও কারাবন্দি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী এ নিয়ে নীরব। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড একটা স্বাধীন দেশের বৈদেশিক নীতি হতে পারে না। তাই পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেলুচিস্তান ইস্যুতে ভারতীয় স্বার্থে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাংলাদেশকে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার দিকটিও বিবেচনায় আনতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
jamil201312@live.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন