সব আশঙ্কাই হলো সত্য। খুনোখুনি, ব্যাপক সংঘাত, সহিংসতা, হানাহানি, গোলাগুলি, বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্রের মহড়া, এজেন্টদের বের করে দিয়ে গণহারে ভোটকেন্দ্র এমনকি গোপন বুথ দখল, ভোটগ্রহণ স্থগিত, ভাঙচুরসহ তাবৎ অঘটন আর নৈরাজ্যের মধ্যদিয়ে গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। ২৭ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম ‘শান্তির শহর’ বন্দরনগরীতে ভোটের দিন সংঘাতে প্রাণ গেল দুইজনের। এই নিয়ে চসিক নির্বাচনী সংহিসতায় পাঁচজন মারা গেছেন। তারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থক নেতাকর্মী। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও হামলায় আহত হয়েছে অর্ধশত। এসব ঘটনায় পুলিশসহ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) ছিল বলতে গেলে নিরব দর্শক। বিভিন্ন এলাকায় বিরাজ করছে উত্তপ্ত পরিস্থিতি। ভোট উৎসবের পরিবর্তে ৭০ লাখ চট্টগ্রাম নগরবাসীর কাছে এবারের নির্বাচনটি ভয়-আতঙ্ক ও হতাশাতেই শেষ হয়েছে।
ভোটের শুরুতে সরকারি দলের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিদ্রোহীদের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নগরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভোটারদের আগ্রহে আরো ভাটাপড়ে। নগরীর বেশিরভাগ কেন্দ্র ছিলো ফাঁকা। শুরুতেই বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্রছাড়া করে নিয়ন্ত্রণ নেয় নৌকার সমর্থকেরা। বিএনপির মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ সবকেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে কেন্দ্র দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। ফলে কেন্দ্রমুখী হননি বেশিরভাগ ভোটার।
মাঘের শীত আর ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ‘ভোট পাগল’ অনেকে কেন্দ্রে গিয়েও ভোট না দিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের অনেকের ভোট আগেই দেয়া হয়েছে, অনেককে কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইভিএম এ ভোট দেওয়ার সময় নৌকার সমর্থকেরা গোপন কক্ষেও তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ভোটারেরা। নিজের উপর হামলা এবং দলীয় এজেন্ট বের করে দেয়ার প্রতিবাদ ও ভোটকেন্দ্রে ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ এনে দুপুরে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন ইসলামী আন্দোলনের হাত পাখার মেয়র প্রার্থী জান্নাতুল ইসলাম। নিজের ভোট নিজে দিতে না পেরে দুপুরের আগেই নির্বাচন প্রত্যাখান করেন সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী মেনোয়ারা বেগম মনি। নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত আহত হয়েছেন একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন।
ভোটকেন্দ্রে সরকারি দলের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে সমর্থকদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে আটক হয়েছেন পাথরঘাটা ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল বালি। প্রতিটি এলাকায় বিএনপিকে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখা গেছে। অনেক কেন্দ্রে তারা এজেন্টও দিতে পারেনি। বিএনপির অভিযোগ ভোটের আগের রাতসহ গত কয়েকদিন ধরে সরকারি দলের ক্যাডার মাস্তান আর পুলিশের কিছু অতিউৎসাহী কর্মকর্তা তাদের নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে ধরপাকড় আর মহড়া দিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে।
নির্বাচনী প্রচারে অব্যাহত সংহিসতায় ভোটের দিন সংঘাতের আশঙ্কা বাস্তব হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগরীতে র্যাব-পুলিশের তিনস্তুরের নিরাপত্তা নেওয়া হলেও রক্তপাত ঠেকানো যায়নি। ভোটের শুরুতেই নগরীর পাহাড়তলী ও আমবাগানে লাশ পড়ে দুই জনের। নগরীর ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমাবাগান ইউসেফ স্কুল ভোটকেন্দ্রের সামনে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে মারা যান আলাউদ্দিন (২৫) নামে এক যুবক। তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের কর্মী। সকাল সাড়ে ৯টায় ঝাউতলার ইউসেফ আমবাগান স্কুল কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে বন্দুকযুদ্ধে প্রতিপক্ষের ছোঁড়া গুলিতে নিহত হন তিনি। গুলিতে আহত হন আরো পাঁচ জন। এই হত্যাকান্ডের জন্য আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম চৌধুরীর অনুসারীদের দায়ী করেন মাহমুদুর রহমান। এই ঘটনার পর ঝাউতলা এলাকায় রেল লাইন অবরোধ করেন মাহমুদুর রহমানের সমর্থকরা।
এর আগে নগরীর পাহাড়তলীর পশ্চিম নাছিরাবাদ বার কোয়ার্টার এলাকায় ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হয়েছেন। দুই ভাই দুই কাউন্সিলর প্রার্থীকে সমর্থন করতেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে নির্বাচনের বিরোধে এ খুনের ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম নিজাম উদ্দীন মুন্না। অভিযুক্ত তার ভাই সালাউদ্দীন কামরুল। এদের মধ্যে নিজাম উদ্দীন মুন্না সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবের আহমদের সমর্থক ও অভিযুক্ত সালাউদ্দীন কামরুল আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আমিনের সমর্থক। এর আগে নির্বাচনী প্রচার চলাকালে সহিংসতায় নগরীর পাঠানটুলী এবং দেওয়ানবাজারে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুই কর্মী মারা যান। গত বছর হালিশহরে খুন হন আরও একজন।
এদিকে লালখান বাজার চানমারি রোডের শহীদ নগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এলাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক এবং বিএনপির কর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। সকাল পৌনে ৯টা থেকে সেখানে উেত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় হকিস্টিক, লাঠি নিয়ে হামলা চালানো হয়। কাচের বোতল, ইটপাটকেল ছোড়া হয় এলোপাতাড়ি। বোমা বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিজিবি-পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দামপাড়া পুুলিশ লাইন স্কুল কেন্দ্রেও মারামারিতে জড়ায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকেরা। সংঘাতের ঘটনায় বিকেলে পাহাড়তলী ৯ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জহুরুল ইসলাম জসিমকে আটক করে পুলিশ। এর প্রতিবাদে এলাকায় ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধ করে তার সমর্থকেরা। একপর্যায়ে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পুরো এলাকা কয়েক ঘণ্টার জন্য রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
দুপুরে নগরীর পাথরঘাটা বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল বালির সব এজেন্টকে বের করে দেয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী পুলক খাস্তগীরের এজেন্টরা। এর প্রতিবাদে স্থানীয়দের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে বালির সমর্থকেরা। এ সময় চারটি ইভিএম এবং ভোটকেন্দ্রের সামনে থাকা কয়েকটি বাস ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় বালিকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হলে থানার সামনে অবস্থান নেয় তার সমর্থকেরা। বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের হামলায় মহিলাসহ তার ১০ এজেন্ট আহত হয়েছেন। তাদের পিটিয়ে কেন্দ্র ছাড়া করা হয়েছে। কয়েকজন মহিলা এজেন্টকে হকি স্টিক দিয়ে পেটানো হয়।
মহানগরীর কয়েকটি এলাকায় সকাল থেকে ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, কেন্দ্রের বাইরে নৌকার সমর্থক, নেতাকর্মী ও উৎসুক মানুষের ভিড়-জটলা থাকলেও ভোটারের উপস্থিতি তেমন নেই। কয়েকটি কেন্দ্রে দুপুর পর্যন্ত তিন থেকে পাঁচ শতাংশ ভোট পড়তে দেখা যায়। ভোট কেন্দ্রের ভেতরে অবাধে যাতায়াত ছিল নৌকার সমর্থকদের। বেশিরভাগ কেন্দ্রে গোপন কক্ষে গিয়ে ভোটারদের নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটেছে।
ভোটকেন্দ্র দখলে নিতে গুলি
নগরীর ৯ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের বিশ্ব কলোনী কোয়াক স্কুল ভোটকেন্দ্র দখলে নিতে প্রকাশ্যে গুলির ঘটনা হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থী আফসার মিয়ার সমর্থকেরা প্রকাশ্যে গুলি করে। এ সময় হাসান নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করা হয়। একপর্যায়ে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী জহিরুল আলমের অনুসারীরা তাদের ধাওয়া করে। এ সময় দুই পক্ষ ব্যাপক গোলাগুলি করে। আকবরশাহ থানার ওসি জহির হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, অস্ত্রধারীদের ধরতে অভিযান চলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন