রাজধানীতে কয়েকগুণ বেড়েছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলির মোড়ে, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, চায়ের দোকান, বিপণিবিতান, বেশি যানজটের সড়ক ও ট্রাফিক সিগন্যাল, মসজিদ, বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনাল, এটিএম বুথ, শপিং মলের সামনে হাজার হাজার ভিক্ষুক ভিক্ষা করছেন। কোন একটি স্থানে দাঁড়ালেই চার থেকে পাঁচ জন ভিক্ষুক ভিক্ষা চান। যা অতীতের তুলনায় ঢেড় বেশি। অসহায় ভিক্ষুকদের পাশাপাশি পেশাদার ভিক্ষুকদের ভীড়ে অসহায় ভিক্ষুক এখন কম। সমাজকল্যাণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে নিয়মিত ভিক্ষুক রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার। তবে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বর্তমানে এ সংখ্যা অন্তত আড়াই লাখ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরো রাজধানী জুড়েই অসংখ্য অসহায় নারী, বয়স্ক পুরুষ যারা কাউকে দেখলেই সাহায্য প্রার্থনা করছেন। সবার দ্বারে দ্বারে গিয়ে হাত পাতছেন। মানিব্যাগ বের করলে বা কেউ গাড়ির দরজা খুললেই সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এসব নারীর সঙ্গে থাকছে শিশুসন্তানেরাও। মায়ের সঙ্গে তারাও করুণ চাউনি নিয়ে তাকিয়ে থাকছে কিছু পাওয়ার আশায়। বেশির ভাগ মধ্যবয়সি এসব নারী কখনোই ভিক্ষুক ছিলেন না। পথে পথে মানুষ বসে আছে ভিক্ষার আশায়। বিভিন্ন পেশার শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে এখন ভিক্ষা করছেন।
ভিক্ষার মূল পুঁজি সহানুভূতি আর ধর্মীয় অনুভূতি। তবে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। এরপরও অনেক সময় অসহায়, দুর্বল, দরিদ্র ও পঙ্গুরা ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও। অপমানকর হলেও পুনর্বাসন আর ভরণপোষণের ব্যবস্থা না থাকায় তারা ভিক্ষা করতে বাধ্য হন। কিন্তু এ ধরনের ভিক্ষুকের সংখ্যা এখন খুবই কম। কয়েক দশক ধরে রাজধানী ঢাকায় গড়ে উঠেছে চক্রের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি। রীতিমতো এটিকে অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দিনকে দিন রাজধানীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। রাস্তাঘাট, অলিগলি সবখানেই আছে দুষ্টচক্রের অধীনে ভিক্ষায় নিয়োজিত ভিক্ষুকরা।
দেশে এখন প্রকৃত কত মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করছে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে রাজধানীতে নিয়মিত ভিক্ষুক রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার বলে জানিয়েছে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের তথ্য। করোনা পরিস্থিতির পর বর্তমানে এ সংখ্যা অন্তত আড়াই লাখ। যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ভিক্ষাবাণিজ্য হয়ে থাকে। মাসে এই ভিক্ষার টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকা। সংঘবদ্ধ ভিক্ষুক চক্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্য ও এলাকাভিত্তিক অনেক প্রভাবশালীকে ম্যানেজ করে চালায় বলে ভিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না। তথ্য বিশ্লেষণে আরও জানা যায়, করোনাভাইরাসের আগে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ভিক্ষুক ছিল। তবে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) হিসাবমতে এই সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। তবে করোনার পরে ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখে গিয়ে ঠেকেছে।
রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, বেইলি রোড, ফার্মগেট, আজিমপুর, হাইকোর্ট মাজার, মতিঝিল, কমলাপুর, ওয়ারী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, শ্যামলী, গাবতলী ও উত্তরাসহ অন্তত ২০টি পয়েন্টে কাজ করছে এ চক্র। তাদের বিভিন্ন নামে রয়েছে নিজস্ব অফিস, আছে ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি নামে অন্তত ৫০টি সংস্থা। এসব সমিতিতে প্রতিদিন ভিক্ষুকদের জমা দিতে হয় ৩০-৪০ টাকা। ভিক্ষা শুরুর আগে ২০০-৩০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতিতে। একেকটি চক্রের আওতায় রয়েছে ৩০০ থেকে দুই হাজার ভিক্ষুক। কয়েকটি সমিতি সূত্রে জানা গেছে, একজন ভিক্ষুকের দিনে গড়ে আয় ৩০০ টাকা। প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে শুরু করে বড় সমিতিতে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা হয় চক্রের আওতায়।
রামপুরার ভিক্ষুকদের দালাল জানান, ১৫ বছর আগে চাকরির সন্ধানে রাজধানীতে আসেন তিনি। তারপর একজনের মাধ্যমে ভিক্ষুকদের দালালির কাজে যোগ দেন। ১০০ টাকা রোজ কাজ শুরু করে এখন তার আয় প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা। তিনি আরো জানান, প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এসব চক্রের পেছনে রয়েছেন। এলাকাভিত্তিক ২০-৩০ জনের কমিটি এসব ভিক্ষুক নিয়ন্ত্রণ করে। এসব চক্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ভিক্ষুকরা জানান, ভিক্ষাবৃত্তি ঘিরে চলে চাঁদাবাজিও। অন্তত ৩০০ পয়েন্টে একজন করে লাইনম্যান ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
কয়েকজন ভিক্ষুক জানান, খিলগাঁও ডিসিসি মার্কেট এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভিক্ষুকদের একটি চক্র। ২০ জনের একটি চক্র ভিক্ষাবাণিজ্যে জড়িত। বাড়তি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে তারা নানা প্রলোভনে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী-পুরুষ ও শিশুদের অগ্রিম টাকা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় এ চক্রের তহবিলে। এ টাকায় তাদের নিরাপত্তা ও ভিক্ষার জায়গার নিশ্চয়তা মেলে। ক্ষেত্রবিশেষে ভিক্ষার পয়েন্ট সুরক্ষিত থাকে। তবে ভিক্ষুকদের সারা দিনের আয়ের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয় রাতে।
প্রতিদিন প্রতিটি পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাঁচ হাজার ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদেরও একটি বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হয় চক্রকে। দিন দিন ভিক্ষাবৃত্তি যেন পরিণত হচ্ছে লাভজনক বাণিজ্যে। পেশাদার ভিক্ষুকদের উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। রাজধানীর কিছু এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য তাতে কাঙ্খিত ফল মিলছে না। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সেগুনবাগিচা মসজিদের সামনে জুমার নামাজের আগে জড়ো হন প্রায় অর্ধশত ভিক্ষুক। মৌসুমী এসব ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা করেন সপ্তাহে একদিন। এছাড়াও অনেকেই আছেন, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কাজ না করে বিভিন্ন অজুহাতে ভিক্ষাকেই অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এতে মুসল্লীরা বিরক্ত হলেও তারা অনেকটা অসহায়। একজন মুসল্লী বলছিলেন, এদের তো অনেকে কম বয়সী। কাজ করতে পারবে, কিন্তু করবে না। অনেকে আবার বাচ্চাদেরও নিয়ে এসেছে। ভিক্ষার জন্য এরা খুবই জবরদস্তি করে। ভিক্ষা না দিলে অনেক সময় গালাগালও করে। কিন্তু এদেরকে ভিক্ষা দেই না। যারা অসহায় তাদের দেই।
তবে ভিক্ষুকদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে তছনছ হয়ে গেছে তাদের জীবনযাত্রা। অনেকে নতুন যুক্ত হয়েছেন এই পেশায়। পেটের দায়ে নগরীর পথে পথে ভিক্ষা করছেন তারা। অবশ্য করোনার আগে রাজধানীতে তুলনামূলক ভিক্ষুকের উপস্থিতি কম ছিল।
তেমনই একজন গৃহকর্মী রহিমা বেগম (৩০)। দুই সন্তান নিয়ে মিরপুর এলাকায় থাকতেন। স্বামী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। বাসাবাড়ির কাজও পাচ্ছেন না আগের মতো। আগে চার-পাঁচটি বাড়িতে কাজ করলেও বর্তমানে তিনটি বাসা থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। মহামারির প্রাদুর্ভাবের শুরুতে অন্যের ত্রাণের টাকায় চললেও এখন নিরুপায় তিনি। তাই বাধ্য হয়ে সন্ধ্যার পর ভিক্ষা করেন। আগের মতো বাসাবাড়ির কাজ পেলে ভিক্ষা করবেন না বলে জানিয়েছেন রহিমা।
গতকাল মহাখালী এলাকার ভিক্ষুক রহিমা জানান, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভিক্ষা করছেন তিনি। কাজ পেলে ভিক্ষা করবেন না। শুধু রহিমা নন, এমন অসংখ্য নারী ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন, যারা আগে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন। মৌসুমি ভিক্ষুকের সংখ্যা এমন বৃদ্ধি পেয়েছে যে নগরীর জনাকীর্ণ কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করলে পাঁচ থেকে ছয় জন ভিক্ষুকের মুখোমুখি হতে হয়।
কাওরান বাজারে বাবার চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চাইছিলেন নূরজাহান। ভিক্ষা করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বাবা ভ্যানচালক। মা অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। বাবা বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ। কিন্তু চিকিৎসার ব্যয় বহনের ক্ষমতা নেই তাদের। তাই বাবার চিকিৎসার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছেন।
কমপক্ষে ২০ জন নারী ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরা কেউ গৃহশ্রমিক, মার্কেটের দর্জির কাজ, সেলাই শ্রমিক, বিভিন্ন দোকানে পানি সরবরাহ, হোটেলে রাঁধুনীর কাজ, উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে বসতভিটা ডুবে যাওয়ায় ঢাকায় কাজের আশায়, ফুটপাতে দোকানদার, কেউ বিভিন্ন মার্কেটে আলু-পেঁয়াজ বাছাই করার কাজ করতেন। সামান্য যে বেতন পেতেন, সেই টাকা আর স্বামীর আয় মিলিয়ে তারা ভালোই চলতেন। অনেকেই আবার বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা হওয়ায় নিজের আয় দিয়েই কষ্ট করে সংসার চালাতেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির পর নিম্ন বা স্বল্প আয়ের এই শ্রমজীবী সংগ্রামী নারীদের জীবনে নেমে এসেছে এক দুর্বিষহ ঘোর অন্ধকার।
ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠির পুর্ণবাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান খাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪ কোটি টাকা। যা ২০২০-২১ অর্থ বছরে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। বরাদ্দ বাড়ার সাথে কমার কথা ভিক্ষুকের সংখ্যা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা উল্টো বাড়ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন