মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
রাজনীতি নিয়ে যে যত কথাই বলুক, আমার মনে হয় ভেতরে ভেতরে দেশে একটি নির্বাচনী মেরুকরণ চলছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই ভেতরে ভেতরে একটি আগাম সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গেল কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার দলীয় সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিএনপির ঢাউস আকারের কমিটি ঘোষণা দেখে মনে হয়, এটি একটি নির্বাচনমুখী কমিটি। তাছাড়া ১৮ আগস্টে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির মিটিংয়েও একটি আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায়। সব মিলিয়ে রাজনীতি একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশেষকরা মনে করেন। আগামী ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতেই সেই নির্বাচনের ডামাঢোল বেজে উঠতে পারে।
আমরাও চাই দেশে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে যাক এবং সেই নির্বাচনে সবদল অংশগ্রহণ করুক। কেননা গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে, সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সেই নির্বাচন কিভাবে, কোন সরকারের এবং কোন নির্বাচন কমিশনারের অধীনে হবে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও ঐক্যমত পৌছা প্রয়োজন। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর এসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি এবং কোনো ঐক্যমতও হয়নি। একতরফা একটি নির্বাচন দেশে হয়েছে এবং সেই বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দিয়েই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তাই দেশে বিভিন্ন অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং দেশের শান্তি ও স্থিতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সবদলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হয়ে গেলে-দেশে যেমন শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠিত হবে, তেমনি অপশক্তির বিষদাঁতও ভেঙে যাবে। সর্বোপরি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে; বাংলাদেশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশের সামনে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে চ্যালেঞ্জও। আগামী দিনগুলোয় চীন, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পিলিপাইনসহ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তুমুল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। এই প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করতে হলে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন ঐক্য প্রয়োজন; প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যা তৈরি হতে পারে সবদলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ একটি মধ্যপন্থার দেশ। উগ্রতা এখানে এক বিরাট ব্যাধির মতো এবং সেই ব্যাধি সবাইকে এড়িয়ে চলতে হবে। উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় দেশে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। চলছে দেশে ঘৃণ্য, জঘন্য ও বর্বরোচিত হত্যাকা-, যা মধ্যপন্থার দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ।
মধ্যপন্থার দেশ বলে এ দেশের জনগণের প্রিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র ও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের শাসনব্যবস্থা। এর কোনো বিকল্প বাংলাদেশের মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য। সত্যি কথা বলতে গণতন্ত্রের শিকড় এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের গভীরে প্রবেশ করেনি। এ ব্যর্থতা জনগণের নয়। এ ব্যর্থতা রাজনীতিকদের ও সমাজের অধিপতি শ্রেণীর। রাজনৈতিক নেতৃত্বের। রাজনৈতিক কাঠামোর। রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। তা সত্ত্বেও বলতে কোনো দ্বিধা নেই, গত দুই দশকে বাংলাদেশে যা অর্জিত হয়েছে তা মোটেও হতাশাজনক নয়।
গণতন্ত্রের পথ সব সময় কণ্টাকাকীর্ণ। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনেক চড়াই-উৎড়াই পার হয়ে প্রাশ্চাত্যে গণতন্ত্র উঁচু স্থানে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশকেও সেই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। এ জন্য বেশ কয়েকটি ধাপ বাংলাদেশকে অতিক্রম করা প্রয়োজন, ধীরে কিন্তু সাহসের সঙ্গে, ব্যবাহত গতিতে। অন্যতম পদক্ষেপ হলো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ এবং তার সার্থক গণতন্ত্রায়ণ। এর কোনো বিকল্প নেই।
বহুদলীয় গণতন্ত্র ও একাধিক রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতন্ত্রের ঘর সজ্জিত হয় না। গণতন্ত্রকে এ জন্য বলা হয়ে থাকে বহুদলীয় ব্যবস্থা ও বহুমাত্রিকতা। এ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য এ বহুমাত্রিক ব্যবস্থার সর্বস্তরে গণতান্ত্রিকতার সুষম বিকাশ ঘটানো অপরিহার্য, রাজনৈতিক দলে তো বটেই। যে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের বিকাশ এখনো ঘটেনি, সেই দল শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমাজব্যাপী, রাষ্ট্রব্যাপী গণতন্ত্রের ফুল ফোটাবে কীভাবে? আগে নিজে গণতান্ত্রিক হয়েই সর্বস্তরে গণতন্ত্রের বাণী প্রচার করা সম্ভব।
গণতন্ত্র হলো সার্বিক এক শাসনব্যবস্থা। আংশিক গণতান্ত্রিক বা আধা-গণতান্ত্রিকÑ এসব ধারণা অবান্তর। যেমন অর্ধত্রিভুজ হয় না, তেমনি অর্ধগণতন্ত্রও অবান্তর। অন্য কথায়, সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে এর প্রয়োগ। চাইলেই গণতন্ত্র ধরা দেয় না। এ জন্য মনেপ্রাণে প্রস্তুতি নিতে হয় এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশের জনগণ এ জন্য প্রস্তুত। সচেতন, সজ্ঞান ও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? এ সম্পর্কে কিছু বলার আগে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইতিহাস স্মরণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসের প্রতি বাঁকে রয়েছে হতাশা এবং ব্যর্থতার অসংখ্য নজির। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করে অনেক রাষ্ট্র প্রবেশ করেছে স্বৈরাচারী শাসনের অচলায়তনে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসও তেমনি হতাশাব্যঞ্জক। এখানে গণতন্ত্র বিধ্বস্ত হয়েছে যেমন সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা, তেমনি নির্বাসিত হয়েছে নির্বাচিত জননেতা কর্তৃকও। এমন একটি বাঁক ও সময় এখন বাংলাদেশ অতিক্রম করছে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মান অনেক অবনত। পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস জমাটবাঁধা পাথরের মতো আগলে রেখেছে সমষ্টিগত সমাজের মহামিলন উৎসবকে। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের অন্ধকারে নিমজ্জিত সামগ্রিক স্বার্থের চেতনা। আবেগের প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে যুক্তিবাদিতার গণমুখী ভাবনা, সৃজনশীলতার সার্বিক কলাকৌশল। অপরাজনীতি বেড়াজাল প্রতিনিয়ত ছিন্ন করছে আমাদের ব্যাপকভিত্তিক কল্যাণবোধকে। এই অবস্থা আর যাই হোক স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য কোনোভাবেই উপযোগী নয়।
গণতন্ত্র শুধু শাসন পদ্ধতি নয়, গণতন্ত্র সামাজিক নর্ম ও রীতিনীতিও। গণতন্ত্র এক ধরনের সমষ্টিগত সংস্কৃতিও। কোনো রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুধু কাঠামোগত পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন রাজনীতিকদের চিন্তা, মনন ও আচারণ-আচরণে গভীর পরিবর্তন। প্রয়োজন সামাজিক ব্যবস্থার সঠিক বিন্যাস। প্রয়োজন নাগরিকদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানসিকতা। তাই গণতন্ত্রের জন্য ভাঙতে হবে সংকীর্ণতার দেয়াল। আত্মস্বার্থকে প্রক্ষিপ্ত করতে হবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে। গড়ে তুলতে হবে আত্মস্বার্থের ভিত্তিতে সামগ্রিক স্বার্থের উচ্চতর সৌধ। পথ কিন্তু অত্যান্ত বন্ধুর। তবে সবদলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও পক্ষপাতহীন আগাম জাতীয় নির্বাচন হতে পারে এ পথের দিশারী।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধণবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন