সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ভূমিকা

প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
গত ১৮ আগস্ট এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। আনন্দ উল্লাসের ছবি স্থান পেয়েছে দেশের জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায়। এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় ১০ বোর্ডে জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ২৭৬ জন শিক্ষার্থী। পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসিতে শতভাগ পাশসহ জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির যে মহোৎসব শুরু হয়েছে সেটাকে ইতিবাচক বলা চলে। শিক্ষার্থীদের এ অর্জনকে স্বাগত জানাই। কেননা, ভালো ফলাফলের মূল্যই আলাদা। তবে ফলাফল ভালো হলেও গোটা দেশের ‘শিক্ষার মান’ নিয়ে কম বেশি সকলেই উদ্বিগ্ন। সেই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থেকেই নানাজন নানামত পোষণ করেন। কেউ সুন্দর ফলাফলের পক্ষে আবার কেউ সু শিক্ষার পক্ষে। কেউ আবার ফলাফল যাই হোক যথাযথ শিক্ষা, যোগ্যতা ও দক্ষতার পক্ষে। আবার অনেকেই বলেন শিক্ষকের মধ্যে গুণগত মান নেই বলেই শিক্ষার মান নেই। এভাবেই কখনো শিক্ষক কখনো শিক্ষার্থীকে দোষারোপ করেই ক্ষ্যান্ত হই না। চলে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও লেখালেখি। বিতর্কের শেষ নেই। এ যেন এক চলমান প্রক্রিয়ার নাম। তবে এটিও সত্য যে, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ‘জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীরা নিদারুণ অযোগ্য’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে শিক্ষার্থীদেরকে হতাশায় ফেলে দিয়েছেন। অপরদিকে আনিসুল হক লিখেছেন, ‘জিপিএ ফাইভ পাওয়া ভালো, না পাওয়াও মন্দ নয়’। আবার অধিকংশ মানুষ শিক্ষার্থীদের মেধা বা সাফাল্য মূল্যায়নে জিপিএ ফাইভকে চূড়ান্ত মাপকাঠি মনে করেন। এ ধারণাকে পাল্টে দিতে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর তার এক বক্তৃতায় প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘সাকিব আল হাসান কি জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলেন?’ এখন এ তিনটি শিরোনামকে পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলে একটি সঠিক ধারণা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে শিক্ষার হার ৬১ শতাংশ। গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৫৩ দশমিক ২ ভাগ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ছিল শতকরা ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। পাস বেড়েছে, জিপিএ ফাইভ বেড়েছে, কমেছে মান। পাস এবং মানের মধ্যে পার্থক্য কি তা নিরূপণ করতে অনেকেই আমরা ব্যর্থ। সরকার পাস বাড়াতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। কিন্তু পাস করা এ শিক্ষার্থীরা কোথায় ভর্তি হবে, এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কোথায় হবে এ নিয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ স্পষ্ট নয়। তবে টাকার গরম আর গলার স্বর যাদের লম্বা (রাজনীতিবিদ) তারা হয়তো কিছুটা লাভবান হবেন। আর অন্যরা? বেকারের সাইনবোর্ড তুলে ঘুরবেন এটাই হয়তো তাদের বড় পরিচয়।
২০০৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ পদ্ধতি চালু হয়। সারাদেশে জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল মাত্র ২০ জন। এর তের বছর পর ২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় ১০ বোর্ডে জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ২৭৬ জন শিক্ষার্থী। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অথবা দাখিল ও আলিম উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়া বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বরও পাচ্ছেন না। শিক্ষার্থী ভুল-শুদ্ধ যা-ই লিখবে, তাতেই নম্বর দিতে হবে কিংবা বাড়িয়ে বাড়িয়ে নম্বর দিতে এ কারণেই জিপিএ ফাইভ এর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কেউ যদি নিজ যোগ্যতার বলে ৬০ অথবা ৭০ পাওয়ার যোগ্য হয়, তাকে সকল বিষয়ের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে একটু নম্বর বাড়িয়ে দিলেই সে জিপিএ ফাইভ পেয়ে যায়। এভাবে নম্বর বাড়িয়ে দিলে তাতে শিক্ষার মান বেড়েছে তা বলা যায় না। শিক্ষার্থীদের বৃহৎ একটি শ্রেণি শুধু সার্টিফিকেট পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করছে! অধিকাংশ শিক্ষার্থী শুধু জিপিএ-৫ পাওয়ার স্বপ্নেই বিভোর থাকছে। নিজের জ্ঞানকে সম্মৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে তারা উদাসীন।
মোটাদাগে বলা যায়, শিক্ষায় দুর্নীতি বন্ধ না হলে শিক্ষার মান বাড়বে না। শিক্ষার মান ধ্বংসের বড় কারণগুলোর একটি হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রশ্ন ফাঁস হলেও তা বলার সুযোগ নেই। যে বলবে তাকে প্রমাণ দিতে হবে। আমাদের দেশে কোনো বিষয় কেউ প্রমাণ দিতে গেলে তাকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। যে কারণে সহসা কেউ এ ধরনের কোন কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে না। ‘গত চার বছরে পাবলিক পরীক্ষায় ৬৩টি প্রশ্নপত্র ফাঁস’। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে ২০১৩-১৪ সালে। এ সময় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার (পিইসিই) সব পরীক্ষার সব প্রশ্ন ফাঁস হয়। এভাবে পাসের হার বাড়িয়ে দিয়ে শিক্ষার মান আদৌ কি শিক্ষার মান অর্জন করা সম্ভব? পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বেল্লালের পা দিয়ে লিখে জিপিএ ফাইভ পাওয়া এবং লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ফিরোজের মুখ দিয়ে লিখে ৩.৫০ পাওয়া আর ফাঁসকৃত প্রশ্ন পেয়ে নকলের সহায়তায় জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা কখনই এক নয়। দুর্নীতি করে পাস করা মূলত নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে জীবনকে ধ্বংস করা। নিজ যোগ্যতার চেয়ে সার্টিফিকেটের ওজন যখন বেশি হয় তখন সেই সার্টিফিকেট শিক্ষার্থীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। নকল ও প্রশ্নফাঁস থেকে নতুন প্রজন্মকে মুক্ত রাখতে হবে।
শিক্ষার মান উন্নয়নে কেবল শিক্ষার্থী নয় শিক্ষকদের দক্ষতা অর্জন বেশি প্রয়োজন। বিগত দিনে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেয়ায় শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যিনি অর্থনীতি পড়াচ্ছেন তিনি অর্থনীতিবিমুখ। ইতিহাসের শিক্ষক ইতিহাসে কাঁচা। বিজ্ঞানের শিক্ষক নিজেই অন্যমনষ্ক। যারা মান নির্ণয়ের অংক শিখাচ্ছেন তাদের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। এমন অবস্থার মধ্যদিয়ে যে সব প্রতিষ্ঠান চলছে তাতে কাক্সিক্ষত মানের পাঠদান নিয়ে আশঙ্কা থাকাই যুক্তিযুক্ত। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। একই দিনে অনেকগুলো ক্লাসের বোঝা বহন করার চাপ কমাতে হবে। দুটি ক্লাসের মাঝখানে শিক্ষককে যথেষ্ট পরিমাণে সময় দিতে হবে। তা করা না হলে শিক্ষক ডায়েরি ও ম্যানুয়েল নাম মাত্র বাস্তবায়ন হবে। দেশের অধিকাংশ স্কুলে প্রতিটি শ্রেণিতে ৫০/৬০-এর অধিক শিক্ষার্থী থাকায় সকলের প্রতি সমভাবে দেখভাল করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। একজন শিক্ষককে প্রত্যহ ৫-৬টি ক্লাস নিতে হয় বলে শিক্ষক যথেষ্ট সময় পান না। একটি ক্লাস থেকে আসার পর অন্য একটি ক্লাস নেয়ার আগে ন্যূনতম ৩০ মিনিট বিরতি থাকা দরকার। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে সে সুযোগ না থাকায় শিক্ষকরা যথেষ্ট চাপে থাকেন। এতে করে সঠিকভাবে পাঠ উপস্থাপন করা যায় না। চাপে পড়ে পরপর কয়েকটি ক্লাস নিলেও তা মান সম্মত হয় না। শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো-সুযোগসুবিধা, শিক্ষকদের পাঠদানের যোগ্যতা, পাঠ্যক্রম, পাঠদানের পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষায় আধুনিকীকরণ, শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির ব্যবহারসহ সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার ওপর শিক্ষার মান নির্ভর করে। একই সাথে এটাও বলতে চাই, শিক্ষার নামে বাণিজ্যিকীকরণের ফাঁদে পড়ে চটকদার, মনোহারী বিজ্ঞাপন দেখে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেক অভিভাবকও প্রতারিত হচ্ছেন। কতিপয় শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের শিক্ষায় আন্তরিক না হয়ে তার বাসা বা কোচিং-এ প্রাইভেট এর নামে বাণিজ্য করছেন। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাক্সিক্ষত পাঠ সেবা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। শিক্ষকদের পাঠদান কার্যক্রম সঠিকভাবে মনিটরিং করা হয় না। কোচিং ও প্রাইভেটের বিরুদ্ধে নীতিমালা বা আইন থাকলেও তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় সাফল্য আসছে না। তাই এসব বিষয় খতিয়ে দেখা উচিত।
সর্বোপরি, সময়কে অবহেলায় কাটানো ঠিক নয়। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত পরিকল্পিতভাবে অতিবাহিত করা দরকার। তা না হলে কর্মজীবনে পস্তাতে হবে। যারা সফল হয়েছেন তাদের কর্ম ও সাধনার দিকগুলো জানা থাকলে নিজের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা করা সহজ হয়। প্রেরণা পাওয়া যায়। উৎসাহ পাওয়া যায়। পড়–য়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই নগণ্য। পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয়ে পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া, সহজ উপায়ে দীর্ঘমেয়াদি সফল হওয়ার প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরতায় শিক্ষার্থীদের গড়পড়তা মান আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভাষার ভিত্তি মজবুত করা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানকে গভীরে পৌঁছে দেয়া, কোচিং সেন্টার নির্ভরতা কমিয়ে আনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক চিন্তা ও কাজকে নিজের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার মান উন্নয়ন করা যেতে পারে।
য় লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Sha Emran Siddiquee ২০ মে, ২০১৭, ১০:৩৭ পিএম says : 1
আমি ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাসবিমুখতার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে টার্ম লেখার জন্য বিস্তারিত জানতে চাই।
Total Reply(0)
mukter ৪ আগস্ট, ২০১৭, ১০:৪৯ এএম says : 0
Please give me good mothers and I will give you a good n ation
Total Reply(0)
আহমেদ খালিল ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৯:৩৭ এএম says : 1
আমার দেশের বাইরে যাউয়া খুব যরুরি, আমার খুব অভাব, লেখা পরা সেস কিন্তু চাকরি নাই, ভাত খামু সে টাকা নাই, ছট ভাই বন লেখা পরা করে টাকা দিতে পারি না, এ বেপারে আমাকে পরাপরশ দিন
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন