শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপরাধ ও মাদকে জড়াচ্ছে পথশিশুরা

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৪ এএম

কি নাম তোমার, জন্টু। থাকো কোথায়, কমলাপুর রেল স্টেশনে। কি করো, কাগজ টুকাই। মা-বাবা থাকে অন্য জায়গায়। হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতরে কি, স্যার এর ভেতর ড্যান্ডি খেলে নেশা হয়। কোনো সমস্যা হয় না। পরথমে বন্ধুদের কাছ থেইকা লইয়া সিগারেট খাইছি। হের বাদে গাঁজা আর মদ খাওয়া ধরছি। খুব মজা লাগে এসব খাইতে।
গত বুধবার রাতে রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশনের সামনে কথাগুলো বলছিল ১২ বছরের এক শিশু জন্টু। জন্টুর মতো কবীরও মাদকে আসক্ত। কবীর (১৪) থাকে মা-বাবার সঙ্গে কারওয়ান বাজার বস্তিতে। একসময় গাঁজা বহনের কাজ করত। অন্যদের দেখাদেখি সে প্রায় ছয় বছর আগে গাঁজা খাওয়া শুরু করে। এখন মাঝেমধ্যে মদ ও ইয়াবাও খায়। এ ধরনের হাজার হাজার পথশিশু রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি, বাসটার্মিনাল ও রেলস্টেশনগুলোতে রাত্রিযাপন করে। এদের নেই কোনো থাকার ব্যবস্থা, শিক্ষা, কর্মসংস্থা বা চিকিৎসা। এসব জায়গার বাইরে দিনের বেলায় রাজপথে এদের কর্মব্যস্ত থাকতেও দেখা যায়। এসব পথশিশুরা ছিনতাই, মাদকব্যবসা, চুরি ও হত্যাসহ নানা অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হলেও এদের সুষ্ঠু মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ কারো নেই।
একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোনও না কোনোভাবে মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও ৮ শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি মাদকের স্পট আছে। এসব স্পটে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জানুয়ারি ড্যান্ডি খাওয়াকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মহাখালীতে আরিফ হোসেন (১৬) নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রধান হামলাকারী মো. জনিকে (১৭) গণপিটুনি নিয়ে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা। মহাখালী সাততলা বস্তিতে ড্যান্ডি খাওয়াকে কেন্দ্র করে ওই কিশোরকে হত্যা করা হয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব শিশুরা গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, সিসা, ড্যান্ডি, ইয়াবা, পেথিড্রিন ইত্যাদি মাদকে আসক্ত। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণের কারণে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে।
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন ছাড়াও কারওয়ান বাজার, দোয়েল চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাইকোর্ট, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বর, চাঁনখারপুল, সদরঘাট লঞ্চটার্মিনাল, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাসটার্মিনাল, ঢাকা মেডিকেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে দেখা গেছে, শিশুরা বিভিন্ন ধরনের মাদক খাচ্ছে বা নিচ্ছে। এদের বেশির ভাগই পথশিশু। এসব এলাকায় সক্রিয় মাদক বিক্রেতারা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও মোস্ট অ্যাট রিস্ক অ্যাডোলসেন্ট (এমএআরএ) নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার লাখ ৪৫ হাজার পথশিশু আছে। এদের মধ্যে রাজধানীতে থাকে তিন লাখেরও বেশি পথশিশু।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো. আহসানুল জব্বার গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে কত শিশু মাদকাসক্ত, এর পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। মাদকাসক্ত কোনো শিশু পাওয়া গেলে আমরা বিনা খরচে আমাদের নিরাময় কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। যারা শিশুদের মাদকাসক্ত করছে বা নানা অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, মাদক দূর করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমরা সে কাজ করে যাচ্ছি। মাদক থেকে শিশু ও যুবসমাজকে দূরে রাখতে সকলকেই সচেতন হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পথ শিশুরা নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এদের আইনের আওতায় আনার চেয়ে জরুরি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংশোধন করা। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ডিএমপির মো. শফিকুল ইসলাম সকল জোনের ডিসি ও থানার ওসিদের নির্দেশ দিয়েছে মাদকাসক্ত পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করার জন্য। বিশেষ করে হার্ডওয়ারের দোকান বা অন্য কোথাও থেকে পথ শিশুদের কাছে যেন ড্যান্ডি বিক্রি করা না হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পথশিশুদের মাদকাসক্ত বা অপরাধমুক্ত জীবন গঠনে সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগও নিতে হবে এদের বিষয়ে। কারণ, বর্তমানে ঢাকা শহরে পথ শিশুদের সংখ্যা একেবারে কম নয় বলে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার মন্তব্য করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ড্যান্ডি নামে নতুন ও সহজলভ্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে পথশিশুরা। ড্যান্ডি একধরনের আঠা, যা মূলত সলিউশন নামে পরিচিত। এতে টলুইন নামে একটি উপাদান আছে। টলুইন মাদকদ্রব্যের তালিকায় আছে। এটি জুতা তৈরি ও রিকশার টায়ার টিউব লাগানোর কাছে ব্যবহার করা হয়। এটি খেলে ক্ষুধা ও ব্যথা লাগে না। দীর্ঘমেয়াদে খেলে মস্তিষ্ক, যকৃত ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শুধু বস্তি বা পথশিশুই নয়, মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিশুরাও।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন